আলোকপাত

বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা ও বর্তমান কৃষির অগ্রগতি

ড. জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সব খাতেই এই অগ্রগতি লক্ষণীয়। সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই তা দেখা যায়, অনুভব করা যায়। স্বাধীনতার আগে, ষাটের দশকে ঘরে ঘরে অন্নাভাব ছিল। কৃষি খাতে উৎপাদন ছিল কম। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। চিরায়ত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করত সবাই। উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, পানি সেচ বালাইনাশকের ব্যবহার ছিল খুবই নগণ্য। ষাটের দশকে সারা পৃথিবীতে সবুজ বিপ্লব শুরু হলেও বাংলাদেশে তখন তা সম্প্রসারিত হয়নি। দেশে ছিল চরম খাদ্যাভাব। বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল আমাদের। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পেতেন না। প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের সংকট ছিল, বাজারে ছিল উপকরণের দুর্মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহ ছিল না কৃষকদের। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। তত্কালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সিংহভাগ আসত পাট পাটজাত পণ্যের রফতানি থেকে। কিন্তু পূর্ব বাংলার গরিব পাটচাষীরা তাতে লাভবান হতেন না। তামাক, চা, আখ উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হতো কৃষকদের। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। জীবনধারণের অবস্থা ছিল খুবই নিম্নমানের।

শুধু পাকিস্তান আমলেই নয়, ব্রিটিশ আমলেও দেশের কৃষকরা ছিলেন শোষিত। উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কৃষকদের প্রতিকূলে। ফলে উৎপাদনে তাদের উৎসাহ ছিল কম। প্রতি ইউনিট উৎপাদন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নমানের। ফলে দেশ ছিল ঐতিহাসিকভাবে একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। ব্রিটিশ আমলে গঠিত বিভিন্ন কৃষি কমিশনের প্রদত্ত প্রতিবেদনের তথ্য থেকে এখানকার চরম খাদ্য ঘাটতির চিত্রটি ফুটে ওঠে। কৃষকদের অশিক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, তাদের সার্বিক দৈন্য, কুসংস্কার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিতে স্বল্প বিনিয়োগ ছিল কৃষিতে নিম্নমুখী উৎপাদন খাদ্য ঘাটতির মূল কারণ।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে দেশে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষি উৎপাদন। ওই সময় লাঙল ছেড়ে যুদ্ধের অস্ত্র হাতে তুলে নেন অনেক কৃষক। বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধশিবিরে চলে যায় অনেক কৃষকের সন্তান। পাকিস্তানি খান সেনাদের ভয়ে দেশের অভ্যন্তরে অনেকে যাযাবর জীবন বেছে নেয়। বেঁচে থাকার আশায় এখান থেকে সেখানে, গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় অনেকে। ফলে কৃষিতে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। বিঘ্নিত হয় কৃষির নিয়মিত পরিচর্যা। প্রয়োজনীয় বীজ, সার অন্যান্য উপকরণের অভাবে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাট যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে কৃষিপণ্যের চলাচল বাজারজাত দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৯৭২ সালে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমার চাল নাই, ডাল নাই, রাস্তা নাই, রেলওয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে, সব শেষ করে দিয়ে গেছে ফেরাউনের দল। ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে। তখন থেকেই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ধারণ উৎসাহিত করা হয়। সহজ সুলভ করা হয় কৃষি উপকরণ সরবরাহ। পানি সেচ সম্প্রসারিত করা হয়। অনেকটা নিশ্চিত করা হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সংগত মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছে কৃষকদের। বেড়েছে কৃষির সার্বিক উৎপাদন। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। পরনির্ভরতা খুবই কম। চাল উৎপাদনে এখন আমরা উদ্বৃত্ত। এক্ষেত্রে ফসলের জাত উদ্ভাবন উন্নয়নে আমাদের স্থান সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, পাট রফতানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়। ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে চার কোটি টনেরও ওপরে। গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবস্থার উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর প্রায় শতাংশ হারে। সময় সারা বিশ্বের গড় উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর দশমিক শতাংশ হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল সারা বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে ওপরে। সময় গম উৎপাদন বেড়েছে বার্ষিক গড়ে দশমিক শতাংশের হারে, ভুট্টা ১৬ শতাংশ হারে, ডাল দশমিক শতাংশ হারে। তৈলবীজ শতাংশ হারে, আলু দশমিক শতাংশ হারে এবং সবজি দশমিক শতাংশ হারে। এখন মৎস্য মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ম্ভর। দুধ ডিম উৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। আশা করা যায়, আগামী পাঁচ বছরে ঘাটতি মিটিয়ে স্বয়ম্ভর হবে দেশ। বর্তমান অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রায় লাখ টন চাল রফতানির উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত বছর আলু রফতানি করা হয়েছে প্রায় কোটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের। মাছ রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে বছরের পর বছর। বাড়ছে সবজি রফতানি। চিরকালের খাদ্য ঘাটতি, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই বিপুল উন্নয়ন। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (কৃষি কৃষক, জাহাঙ্গীর আলম, পালক পাবলিশার্স, ঢাকা ২০১০)

বঙ্গবন্ধু জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের এক গ্রামে, টুঙ্গিপাড়ায়। ওই সময় বাংলাদেশে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা ছিল কৃষি। অবহেলিত বঞ্চিত ছিলেন কৃষক। তারা ছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ধান, পাট, সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ইত্যাদির চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতে হতো কৃষকদের। হালের গরু আর দুধেল গাই প্রতিপালন মাছ চাষ করে তাদের কিছু বাড়তি আয় হতো। হাঁস-মুরগি প্রতিপালন করে পেতেন ডিম, মাংস। এভাবেই চলত তাদের সংসার। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই এদের কষ্ট দেখেছেন। অবহিত হয়েছেন এদের বঞ্চনা নিরীহ জীবনধারা সম্পর্কে। বড় হয়ে যখন রাজনীতিতে এসেছেন তখন এদের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। মানসপটে এদের মুক্তির ছবি এঁকেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন যে বাংলার কৃষককুল কত পরিশ্রম গায়ের ঘাম ঝরিয়ে সব মানুষের অন্ন জোগায়। অথচ জীবনভর তাদের অভাব মেটে না, সুদিনের দেখা মিলে না। সেজন্য তিনি কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন তাদের মঙ্গল নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু ওই নির্বাচনী জোটের অংশীদার ছিলেন। প্রার্থী হন কোটালিপাড়া-গোপালগঞ্জ আসনে। ওই জোটের ২১ দফা কর্মসূচির মধ্যে প্রধান ছয়টি দফাই ছিল কৃষি কৃষকের উন্নয়নের জন্য নিবেদিত

. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি সব খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায়সংগতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে।

. পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেঙ্কারি তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।

. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে এবং সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।

. পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্পের বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হইবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে এবং তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হইবে।

. খাল খনন সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।

. পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে।

[সূত্র: ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রাজনীতি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮০৯, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।]

উল্লিখিত একুশ দফার ছয় দফার মধ্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। খাজনা হ্রাস সার্টিফিকেট কেইস রহিত করার অঙ্গীকার ছিল। বাংলার পাটচাষীদের বঞ্চনার কথা বিবেচনা করে পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। খাল খনন সেচের মাধ্যমে দেশকে বন্যা দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। সর্বোপরি দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জোটের অন্যতম একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ওই নির্বাচন প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম একজন প্রণেতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর এর শরিক দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি বনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তিনি পরবর্তী কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এভাবে তিনি পঞ্চাশের দশকে কৃষি গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষকদের মঙ্গলের জন্য কাজ করার সুযোগ পান। 

পাকিস্তান আমলে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আলাপচারিতা বক্তৃতার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রামীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। তার ৭০ সালের ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত বেতার টেলিভিশন ভাষণে তিনি সেই চিত্রের কিছুটা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলার বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। জনগণকে সেই অনাহার থেকে রক্ষা করতে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে যেক্ষেত্রে প্রতি মাসে মোটা চালের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে সে চালের দাম ছিল গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাংলায় যে আটার দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের সরিষার তেলের দাম ছিল আড়াই টাকা, বাংলাদেশে তার দাম ছিল টাকা। এসব উদাহরণ টেনে তিনি বাংলাদেশের কৃষক গ্রামীণ মানুষের দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। সেই সঙ্গে অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে সামন্ত প্রভুদের অফুরন্ত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং গরিব কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন, ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সামন্ত প্রভুরা রাজকীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে। তারা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তাদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকদের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে। ওই ভাষণে তিনি ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ বকেয়া খাজনা মওকুফের অঙ্গীকার করেন। পাটচাষীদের সুরক্ষার জন্য তিনি পাট ব্যবসা জাতীয়করণ পাট গবেষণা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি চাষীদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি কৃষি বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক বলে দিকনির্দেশনা দেন। তার ভাষণের সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

-যাবৎ বাংলার সোনালি আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া ব্যাপারীরা পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করছে। পাটের মান, উৎপাদনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবস্থা জাতীয়করণ, পাট গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। তুলার প্রতি একই ধরনের গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সেজন্য আমরা মনে করি, তুলা ব্যবসাও জাতীয়করণ করা আবশ্যক। তুলার মান উৎপাদনের হার বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। বিগত সরকারগুলো আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল চা, আখ তামাকের উৎপাদনের ব্যাপারেও যথেষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। ফলে এসব অর্থকরী ফসল আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষীদের ন্যায্য স্থিতিশীল মূল্য দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থায় বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

ভূমি রাজস্বের চাপে নিষ্পিষ্ট কৃষককুলের ঋণভার লাঘবের জন্য অবিলম্বে আমরা ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ এবং বকেয়া খাজনা মওকুফ করার প্রস্তাব করেছি। আমরা বর্তমান ভূমি রাজস্ব প্রথা তুলে দেয়ার কথা ভাবছি। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক তত্পরতা চালাতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের বনজ সম্পদ, ফলের চাষ, গো-সম্পদ, হাঁস-মুরগির চাষ, সর্বোপরি মৎস্য  চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। পানিসম্পদ গবেষণা নৌ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য অবিলম্বে একটি নৌ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। ...বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রথম কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে একটি সুসংহত সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা আশু  প্রয়োজন।

[সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন রাজনীতি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৩১ ৮৩২। বাংলা একাডেমি, ঢাকা]

(পরবর্তী অংশ)

 

. জাহাঙ্গীর আলম: কৃষি অর্থনীতিবিদ; উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট

গবেষণা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন