করোনাকালের শিশুরা কি দীর্ঘমেয়াদি ট্রমায় ভুগবে?

বণিক বার্তা ডেস্ক

চলমান মহামারীর ফলে সৃষ্ট সামষ্টিক উদ্বেগ অনেক বেশি সর্বব্যাপী, যা কিনা লকডাউনে জন্ম নেয়া শিশুরা তাদের বাকি জীবন ট্রমায় ভুগবে কিনা সে সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক বিতর্কের দিকে আমাদের ঠেলে দিয়েছে। আপনি যদি অবাক হন যে এমনটা আসলেই ঘটবে কিনা, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকান তুষারঝড়ের দিকে তাকাতে।

রেডিওলজিস্ট ক্যাথেরিন লেবেল বলেন, পূর্ব অন্টারিও দক্ষিণ কিউবেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ঝড়টি শক্তি দেখানোয় বাড়িতে গর্ভবতী নারীদের বরফ-ঠান্ডা তাপমাত্রা সহ্য করতে হয়েছিল। যা তাদের বাচ্চাদের ওপর জৈবিক চিহ্ন রেখে গিয়েছিল।

তুষারঝড় সংক্রান্ত একটি গবেষণায় যাদের মা সে সময় গর্ভবতী ছিল এমন ৩৩ জন ছেলেশিশু এবং ৩৩ জন মেয়েশিশুর ব্রেইন স্ক্যান করে তাদের অ্যামিগডালা (মস্তিষ্কের একটি অংশ যা আবেগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত) পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেখানে দেখা গেল বিপর্যয়ের মাঝে জন্ম নেয়া শিশুদের মাঝে এক দশক পর আরো বড় অ্যামিগডালা ছিল। এই বর্ধনশীলতা আগ্রাসী আচরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে, যা মেয়েদের মাঝে তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা গেছে। বাবা-মার উদ্বেগ অ্যামিগডালার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে বলে চিন্তা করা হয়। পাশাপাশি এর আকার সম্ভবত কারো হতাশা, উদ্বেগ আগ্রাসী মনোভাবকে প্রভাবিত করে।

লেবেল বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি একটি গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা কিনা মাসিক ভিত্তিতে কানাডাজুড়ে গর্ভবতী নারীদের নিরীক্ষণ করবে এবং আইসোলেশনের কারণে করোনাকালে জন্ম নেয়া শিশুদের ওপরও একই ধরনের প্রভাব ফেলবে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করবে। লেবেলের মতে, প্রসবপূর্ব সময়কালকে আমলে না নেয়া বোকামি।

লেবেল অন্যান্য গবেষকরা বলছেন, এই নারীরা অত্যধিক চাপ এবং আইসোলেশনের মুখোমুখি হচ্ছেন, যা তাদের ভ্রূণকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের মতে, পরিস্থিতি জেনারেশন সি-এর ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। ফলে জ্ঞানীয়, মানসিক, আবেগময় শারীরিক অবস্থাগুলোর একটি বিস্তৃত প্রদর্শনীর দেখা মিলতে পারে।

মে মাসে এরাসমাস ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের স্যাম শোয়েনমেকারর্স এবং অন্য চারজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, নিওন্যাটালজিস্ট এবং মেডিকেল এথিস্ট একটি মতামত প্রকাশ করেছেন দ্য ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে। যেখানে বলা হয়, করোনাকালে জন্ম নেয়া শিশুরা সমান্তরাল ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। তারা লক্ষ করেছেন যে কিছু প্রতিবেদনে ১৯৪০-এর দশকে নেদারল্যান্ডসের পশ্চিমাঞ্চলে নািসদের দখলদারির কারণে দুর্ভিক্ষের সময় জন্ম নেয়া শিশুদের মাঝে সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্বের সমস্যা এবং সংক্ষিপ্ত জীবনকালের দেখা মিলেছে।

একইভাবে ২০১২ সালের সুপারস্ট্রম স্যান্ডির প্রেক্ষিত গবেষণা করে দেখা গেছে, বিপর্যয়ের সময় জন্ম নেয়া শিশুদের মেজামের রূপরেখা পরিবর্তিত হয়েছে। শিশুগুলো অধিকতর ভীতি বিষণ্নতায় ভোগে।

লেবেলের কভিড-১৯ প্রজেক্ট এরই মধ্যে কিছু উদ্বেগজনক ফলাফল দিচ্ছে। এপ্রিলে দলটি দুই হাজার গর্ভবতী মহিলাকে যুক্ত করে মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্নাবলি পূরণ করার জন্য। সেসব জরিপে ৩৭ শতাংশ নারী ক্লিনিক্যালি প্রাসঙ্গিক হতাশার উপসর্গের কথা বলেছে এবং ৫৭ শতাংশ বলেছে উদ্বেগের কথা।  অতীত থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, গর্ভবতী নারীদের মাঝে এমন মনোভাব তাদের বিকাশমান শিশুদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

কিন্তু সবাই অবশ্য মনে করে না যে করোনাকালের শিশুদের জটিলতা পূর্বনির্ধারিত। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নোয়েল হান্টার বলেন, সমান্তরাল ক্ষতির যে ধারণা তা অতিসরলীকৃত এবং পরিসংখ্যানও পর্যাপ্ত না। তিনি বলেন, পূর্ববর্তী গবেষণাগুলো দেখিয়েছে, শিশুদের শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের পরবর্তী সমস্যাগুলো কেবল পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, সেগুলো কার্যকারণ সম্বন্ধমূলক না। 

তার কাছে, পারস্পরিক সম্পর্কগুলো মানসিক চাপের পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে (যেমন চলমান মহামারী), যা শিশুদের প্রতি প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। হান্টারের মতে, বাবা-মায়ের শরীর প্রসবপূর্বকালকে দোষারোপ করার পরিবর্তে জন্মের অনেক বছর পর বাচ্চাদের প্রভাবিত করে এমন ট্রমাগুলো নিয়ে গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানো উচিত।

অন্য বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে যেকোনো গবেষণার ফ্যাক্টর হতে পারে কভিড-১৯ কীভাবে সিস্টেমেটিক বর্ণবাদ কিংবা আয়বৈষম্যের কারণে বিদ্যমান নানা ভঙ্গুরতাকে ছেদ করে তা। মনস্তত্ত্ববিদ আলিশা আলী বলেন, যেসব মানুষ যথাযথ পুষ্টি সুবিধা লাভ করে না, মেডিকেল কেয়ার পায় না এবং সে সম্পর্কিত আরো নানা সংস্থান থেকে বঞ্চিত তাদের মাঝে যাদের বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, তারা এখন আরো বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

লেবেল নিজেও অবশ্য সমান্তরাল ক্ষতি মতো টার্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যদিও মহামারীকালীন শিশুদের মাঝে তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিণতির আশঙ্কা করছেন। লেবেল বলেন, এখন থেকে ২০ বছর পর পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর চেয়ে আমরা উচ্চমাত্রার হতাশা উদ্বেগ দেখতে পাব।

সহায়ক স্বাস্থ্যসেবা

মহামারী করোনাকালের শিশুদের কীভাবে প্রভাবিত করবে তা জানতে সময় লাগবে। কিন্তু এখন বাবা-মায়েরা চাইলে প্রভাবকে হ্রাস করতে পারে। যেমন লেবেলের গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলগুলো বলছে, কভিড-১৯ দেখিয়েছে সামাজিক সমর্থন এবং বর্ধনশীল কার্যক্রম উদ্বেগজনিত উপসর্গগুলো গর্ভবতী মহিলাদের হতাশাকে কমতে পারে।

সম্পর্ককে উৎসাহিত করাএমনকি ভার্চুয়াল কিংবা সামাজিকভাবে দূরের কারোর সঙ্গেও, তা ঘরের মাঝে আইসোলেশনে থাকা এবং পিতৃত্ব মাতৃত্বকালে নতুন দায়িত্বের যে দ্বৈত অভিজ্ঞতা তাকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে।

আলী বলেন, বাবা-মা হতে যাওয়া সবার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ যে শুরু থেকেই পরিকল্পনা করে এগোনো। শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে একজন সহায়ক ব্যক্তি প্রয়োজন, যাকে বিশ্বাস করা যায়। তিনি হতে পারেন স্বামী বা স্ত্রী, বাবা-মা কিংবা কাছের কোনো বন্ধু। যিনি প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করতে পারেন। যা ভার্চুয়ালও হতে পারে।

সামাজিকভাবে যেসব বাবা-মা ভঙ্গুর অবস্থায় থাকেন তাদের অতিরিক্ত সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে এসব বাবা-মা নিজেদের জন্য এবং সন্তানের জন্য উন্নত পুষ্টি লাভ করেন।

হান্টার পরামর্শ দেন আনন্দময় কিছু কার্যক্রম করে নিজেদের উত্ফুল্ল রাখতে, যেমন বোর্ড গেম খেলা, গানবাজনা করা, টিকটক ভিডিও বানানো কিংবা নিজেদের ভালো লাগার যেকোনো কিছু করা। একইভাবে নতুন কিছু শেখার মাধ্যমেও বাবা-মা সুবিধা লাভ করতে পারেন।

হান্টার বলেন, শিশুরা ভালো থাকবে যদি তাদের বাবা-মা নিজেদের যত্ন নেন এবং জীবনের অর্থপূর্ণ বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেন। যখন আমরা একসঙ্গে কাজ করব এবং একে অন্যকে সমর্থন দেব, তখন যেকোনো বাধা অতিক্রম করতে পারব।

দ্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন