নীতি প্রণোদনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোলার হোম সিস্টেম বাংলাদেশে

শামীম রাহমান

ভালো নীতির ভালো ফল

গত এক দশকে খাতভিত্তিক বেশকিছু ভালো নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। এসব নীতির সুফল নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে দেশে যখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা (সোলার হোম সিস্টেম) চালু হয়, তখন এর সম্প্রসারণটা ছিল খুবই শ্লথগতিতে। যাত্রার প্রথম এক দশকে সারা দেশে সোলার হোম সিস্টেমের সংখ্যা ছিল তিন লাখের কম। ২০০৮ সালে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নের পর পরবর্তী এক দশকে সোলার হোম সিস্টেমের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ লাখেরও বেশি। মূলত কর অব্যাহতিসহ সরকারের নীতি প্রণোদনায় সোলার হোম সিস্টেমের দাম যেমন কমেছে, তেমনি সহজলভ্যও হয়েছে তা। এক দশকের ব্যবধানে পাল্টে গেছে জাতীয় গ্রিডবঞ্চিত দেশের প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলের চিত্র। ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব মানুষের নাগালে এসেছে সৌরবিদ্যুৎ। উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা এখন তিন কোটির ঘরে উন্নীত হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্রুতবর্ধনশীল সোলার হোম কর্মসূচি হিসেবে আখ্যা পেয়েছে বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রিক উদ্যোগ।

এক দশক আগে ২০ ওয়াট ক্ষমতার একটি সোলার হোম সিস্টেমের দাম ছিল ২০ হাজার টাকার ওপরে, যা দিয়ে তিনটি বাতি একটি মোবাইল চার্জার চালানো সম্ভব হতো। বর্তমানে - হাজার টাকায় এর চেয়ে বেশি ক্ষমতার সোলার হোম সিস্টেম পাওয়া যায়, যা দিয়ে লাইট, চার্জারের পাশাপাশি ফ্যান টেলিভিশনও চালানো সম্ভব। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে সোলার সিস্টেমের দাম যেমন কমেছে, তেমনি দেশে সোলার সিস্টেমের দাম কমাতে ভূমিকা রেখেছে যন্ত্রাংশ আমদানিতে কর মওকুফ সুবিধা। দাম কমে যাওয়ায় ছোট পরিসরে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের জন্য গ্রাহকদের তেমন ঋণেরও দরকার পড়ছে না এখন।

যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) মাধ্যমে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহারের জন্য ক্রেতাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে এখনো। ইডকলের কর্মসূচিতে সোলার হোম সিস্টেমটি কেনার সময় ক্রেতাকে মোট দামের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ এককালীন পরিশোধ করতে হয়। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য দেয়া হয় তিন বছর পর্যন্ত কিস্তি সুবিধা। সোলার পণ্য আমদানিতে কর ছাড়, কিস্তি সুবিধার পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে মানুষকে সচেতন করতেও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার।

পল্লী অঞ্চলের জনগণের দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়ার ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটির শিল্প অন্যান্য পেশার মানুষ সৌরবিদ্যুতের সুফল ভোগ করছে। শিক্ষার্থীরা অধিক রাত পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। সেলফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছে মানুষ। টেলিভিশনের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনোদন ছাড়াও দেশ-বিদেশের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে গ্রামীণ জনসাধারণের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। এসবের প্রভাবে আরো গতিশীল হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

২০০৮ সালের আগে সারা দেশে সোলার হোম সিস্টেমের সংখ্যা ছিল তিন লাখের কম। এরপর নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। সৌরবিদ্যুতের জন্য আমদানি করা যন্ত্রাংশে কর মওকুফ করা হয়। ইডকলের মাধ্যমে ক্রেতাদের সহজ শর্তে অধিকতর ঋণ ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়। এসব নীতির সুফল পাওয়া যায় পরের পাঁচ বছরেই। ২০১৪ সালেই দেশে সোলার হোম সিস্টেমের সংখ্যা ৩০ লাখ এবং ২০১৯ সালে ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে আসে দেশের প্রত্যন্ত পিছিয়ে থাকা দেড় কোটির বেশি মানুষ।

সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পরের পাঁচ বছরে আরো ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকার। তৈরি করা হয় পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান। এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। নেয়া হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্মসূচি। নবায়নযোগ্য শক্তি কার্যক্রমের সার্বিক সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠন করা হয় সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (স্রেডা) খাতটিতে বেসরকারি উদ্যোগগুলোকেও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের সুফলও এসেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে সারা দেশে স্থাপন হওয়া সোলার হোম সিস্টেমের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে বদলে গেছে প্রান্তিক এলাকার তিন কোটি মানুষের জীবন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে মানুষের ব্যাপক আগ্রহও খাতটিকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্রেডা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন দেশে সোলার হোম সিস্টেমের ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য মোটা দাগে চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন। সম্পর্কে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সহজ ঋণ সুবিধা, কারিগরি সহযোগিতা, বিক্রয়োত্তর সেবা উদ্ভাবনী বিক্রয় পদ্ধতি চারটি বিষয় সাধারণ মানুষকে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহারে উৎসাহী করেছে।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কাজটি শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। এর পেছনে ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি। তবে সারা দেশে কর্মসূচিটি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দরকার ছিল একটি সরকারি উদ্যোগ। বিশ্বব্যাংক গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) অনুদানে ২০০৩ সালে দেশে সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচি শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইডকল। পরবর্তী সময়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, জিআইজেড, কেএফডব্লিউ, আইডিবি, ইউএসএআইডি ডিএফআইডির মতো প্রতিষ্ঠানও ইডকলের সোলার হোম কর্মসূচিতে অর্থায়ন করে।

গ্রামীণ শক্তির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। সারা বিশ্বে এটা উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এখন মডেল অনুসরণ করা হয়। তবে এর বাইরেও সৌরবিদ্যুতের সুযোগ রয়েছে। সেচকাজে এখন বাংলাদেশে ১৩ লাখ ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার হয়। এর মধ্যে দুই লাখ পাম্প সৌরবিদ্যুতে চালানো সম্ভব। সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারি বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

বর্তমানে সারা দেশে ৬৬টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মাঠ পর্যায়ে সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে ইডকল। ক্রেতা তৈরি, সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের পাশাপাশি বিক্রয়োত্তর সেবাও দেয় এসব প্রতিষ্ঠান। ইডকল সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুদান সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। কর্মসূচির মাধ্যমে গত ১০ বছরে সারা দেশে প্রায় ৩৭ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে ইডকল। ২০২১ সালের মধ্যে সারা দেশে ৬০ লাখ ইউনিট সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের লক্ষ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

বাংলাদেশের সোলার হোম সিস্টেমের কর্মসূচি এরই মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অফ-গ্রিড রিনিউয়েবল এনাজি প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অগ্রযাত্রার পেছনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইডকলের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ইনামুল করিম পাভেল বণিক বার্তাকে বলেন, সোলার হোম সিস্টেমে সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকার গৃহীত কয়েকটি উদ্যোগ। ব্যবহারকারীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ায় কর্মসূচিটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি সোলার সিস্টেমের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে কর ছাড় দেয়ায় বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের খরচ অনেকটা কমে এসেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে সরকারের নীতিও সাফল্যের পেছনে পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে বলে মত দেন তিনি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে। আগামীতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হবে বলে মনে করেন স্রেডার সদস্য (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) সালিমা জাহান। তিনি বলেন, বর্তমানে সোলার ইরিগেশন, রুফটফ সোলার সিস্টেম, সোলার টেলিকম টাওয়ার, সোলার পার্ক, সোলার মিনি গ্রিড, সোলার স্ট্রিট লাইট, সোলার ড্রিংকিং সিস্টেমের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন