ব্লকচেইন এলসি : বাণিজ্যে নতুন মাত্রা

ময়েজ শরীফ

সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সহযোগী প্রতিষ্ঠান কনট্যুরের মাধ্যমে কর্পোরেট গ্রাহক ভিয়েলাটেক্স লিমিটেডের জন্য একটি ব্লকচেইন এলসি সম্পন্ন করেছে (দ্য ডেইলি স্টার, ১৬.০৮.২০২০)। এর দ্বারা আমাদের দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্লকচেইন এলসির যাত্রা শুরু হলো। এটি মূলত এলসির মাধ্যমে আমদানি মূল্য পরিশোধের একটি ডিজিটাল মেকানিজম, যা কাগজবিহীন, সময়, ব্যয়, ও শ্রম সাশ্রয়ী, এবং জাল-জালিয়াতি ও দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর। নিঃসন্দেহে ব্লকচেইনের প্রয়োগ শুধু এলসি নয়, সামগ্রিকভাবে অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।

ব্লকচেইনের থিওরেটিক্যাল কনসেপ্ট এক দশকের পুরনো। কিন্তু এর কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায় বিগত বছরগুলোতে ভার্চুয়াল কারেন্সি বিট কয়েনের লেনদেনে। ব্লকচেইনকে একটি যৌথ ও সমন্বিত ডিজিটাল খতিয়ান বলা যায়। এতে একটি নির্দিষ্ট কম্পিউটার নেটওয়ার্কের  সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীরা তাদের  লেনদেন সংক্রান্ত ডাটা ইনপুট ও শেয়ার করতে পারে।

যখন কোন লেনদেন সম্পন্ন হয় (চিত্রে ধাপ ১), তা ডিজিটাল তথ্যের একটি ব্লক হিসেবে সিস্টেমে রেকর্ড হয়ে যায় (ধাপ ২)। বিষয়টি সকল ব্যবহারকারীর নিকট নোটিফাই (ধাপ ৩) এবং ভেরিফাই (ধাপ ৪) হলে, উক্ত ব্লকটি ধাপ ১ হতে ধাপ ৪ পর্যন্ত উৎপন্ন ডাটার সাথে লক হয়ে পড়ে (ধাপ ৫)। এভাবে একের পর এক ব্লক ধারাবাহিকভাবে পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে একটি সুরক্ষিত ভার্চুয়াল চেইনের মাধ্যমে সংযুক্ত হতে থাকে, যা অল্টার করা দুঃসাধ্য। কেউ নতুন লেনদেন আরম্ভ করতে চাইলে চেইনে নতুন ব্লক তৈরী করে  প্রথমেই অন্যান্য পক্ষের সম্মতি অর্জন আবশ্যক।

বাণিজ্যের  লেনদেনে অনেকগুলো পক্ষ থাকে। ক্রেতা, বিক্রেতা, আর ব্যাংক থেকে শুরু করে শিপিং কোম্পানী, ফরওয়ার্ডার, ইনস্যুরেন্স কোম্পানী, কাস্টমস অফিস, ইন্সপেকশন ব্যুরো, এবং বিভিন্ন রেগুলেটরী বডি। এ অবস্থায় সকল পক্ষ একাধারে  যুক্ত হয়ে ব্যবহার উপযোগী কোন খতিয়ান পুরো ইন্ডাস্ট্রির ট্রান্সপারেন্সি এবং সিকিউরিটির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে। ব্লকচেইন ঠিক তাই। এটি পারচেজ অর্ডার, প্রোডাকশন, ইনভেন্ট্রি, ডেলিভারি, এবং পেমেন্টসহ যাবতীয় তথ্যের  একটি অকৃত্রিম প্রবাহ উৎপাদনে সক্ষম।

একটি ব্লকচেইন এলসি  সাধারণত তিনটি পর্যায়ে সমাপ্ত হয়। প্রথম পর্যায়ে, আমদানিকারক একটি এলসি দরখাস্ত প্রিপেয়ার করে এবং তার ব্যাংকের রিভিউর জন্য সেটি ব্লকচেইনে স্টোর করে। আমদানিকারকের ব্যাংক দরখাস্তটি রিভিউর জন্য নোটিফিকেশনপ্রাপ্ত হয় এবং প্রদত্ত ডাটার ভিত্তিতে তা অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। চেকিংয়ের পর তা অনুমোদিত হলে দরখাস্তটি এলসি আকারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রপ্তানিকারকের ব্যাংকের নিকট সম্মতির জন্য উপস্থাপিত হয়। রপ্তানিকারকের ব্যাংক এলসিটি অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করে থাকে। অনুমোদিত হলে রপ্তানিকারক এলসির শর্তসমূহ ও আবশ্যক ডকুমেন্টস এর লিস্ট দেখতে পায়। সেই সাথে আমদানিকারকের দরখাস্তটিও অবলোকন করতে পারে। 

দ্বিতীয় পর্যায়ে, রপ্তানিকারক শিপমেন্ট সম্পন্ন করে ইনভয়েস, রফতানি সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত, এবং অন্যান্য দলিলাদির  ফটো ইমেজ নেটওয়ার্কে উপস্থাপন করে। বৈধতা প্রতিপন্ন হলে এগুলো ব্লকচেইনে সঞ্চিত হয়। ডকুমেন্টসমূহ রপ্তানিকারকের ব্যাংক কর্তৃক পরিদর্শিত এবং অতঃপর অনুমোদিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়। 

তৃতীয় পর্যায়ে, আমদানিকারকের ব্যাংক এলসির বিপরীতে উপস্থাপিত ডকুমেন্টস রিভিউ করে এবং কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে আমদানিকারকের গোচরীভূত করে। সেগুলো অনুমোদনপ্রাপ্ত হলে এলসিটি সরাসরি নিষ্পন্ন স্ট্যাটাস লাভ করে, অন্যথায় আমদানিকারকের কাছে সেটেলমেন্টের জন্য প্লেস হয়। কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে আমদানিকারক প্রয়োজনমত রপ্তানি দলিলাদি রিভিউ সাপেক্ষে সেগুলো অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

বাংলাদেশে ব্লকচেইন এলসির ব্যবহার অতি সাম্প্রতিক হলেও, এলসি ব্লকচেইন প্লাটফরম কনট্যুর আত্মপ্রকাশ করেছে দু’বছর আগেই। ২০১৮ তে যাত্রাকালে এর নাম ছিল ভলট্রন এবং ফাউন্ডিং মেম্বার ছিল আটটি ব্যাংক - ব্যাংকক ব্যাংক,বিএনপি পারিবাস, সিটিবিসি হোল্ডিং, এইচএসবিসি, ইং, ন্যাটওয়েস্ট, এসইবি, এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড।

 ২০১৮র মে মাসে এইচএসবিসি সিঙ্গাপুর প্রথম ব্লকচেইন এলসির সফল প্রয়োগ ঘটায়। তারা ফুড এন্ড এগ্রিকালচার কংগ্লোমারেট কারগিল এর জন্য আর্জেন্টিনা থেকে মালয়েশিয়ায় সয়াবিন আমদানির লক্ষ্যে ইং ব্যাংকের অনুকুলে একটি ব্লকচেইন এলসি ইস্যু করে। গতানুগতিক পেপার বেইজড ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়াটি পুরো হতে ৫ থেকে ১০ দিন সময় লাগত। কিন্তু এক্ষেত্রে সময় লেগেছিল মাত্র ২৪ ঘন্টা। 

এই নতুন প্রযুক্তিতে ব্যাংকগুলো গোটা সাপ্লাই চেইনের একটি সুস্পষ্ট ও তাৎক্ষণিক চিত্র ধারনে সক্ষম হয়। লেনদেন পেপারবিহীন হওয়ায় ডাটার ম্যানুয়াল প্রসেসিং এবং ম্যাচিংয়ের আর প্রয়োজন পড়ে না।  ফলে রিসোর্স সেভিংয়ের পাশাপাশি মূল্য পরিশোধ ও অর্থসংস্থানের প্রক্রিয়া গতিশীল হয়। ব্লকচেইনের আরেকটি সুবিধা হলো ‘স্মার্ট কন্ট্রাক্ট’ এর ব্যবহার। অপশনটির মাধ্যমে আমদানিকারক পণ্য গ্রহণ করা মাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে রপ্তানিকারকের অনুকুলে ফান্ড রিলিজ সম্ভব। পরিশেষে, কোন পক্ষকে বাইপাস করে লেনদেন হয় না বিধায় ব্লকচেইন এলসি জাল-জালিয়াতি (ডাবল ফাইন্যান্সিং অথবা ফেইক ডকুমেন্টস প্রেজেন্টেশন) এবং দুর্ঘটনা  (মিসিং অফ ডকুমেন্টস) রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। 

জাতিসংঘের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বৈদেশিক বাণিজ্যের  পেপারওয়ার্ক ডিজিটাইজ করা গেলে একদিকে ৩১শতাংশ  ব্যয় কমানো যেতে পারে, অন্যদিকে ২৫৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি বৃদ্ধি সম্ভব। তবে ব্লকচেইন এলসির ব্যাপক সামর্থ্যই এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। এই মেকানিজমের কালেকটিভ নেচারের কারণে লেনদেন সংশ্লিষ্ট একটিমাত্র পক্ষও যদি নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে ব্যর্থ বা অসম্মত হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিই অকার্যকর হয়ে পড়ে।

ব্লকচেইন এলসির সুবিধা পেতে হলে  প্রথমে একটি অনলাইন প্লাটফরমের মেম্বার হতে হবে। আমাদের দেশে এমন অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন যারা ছোট ছোট মূল্যের এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করেন। আবার অনেক আমদানিকারক সারাবছরে গোটাকতক এলসির মাধ্যমে কয়লা, পাথর, বা এ জাতীয় পণ্য আমদানি করেন। এরা স্বপ্রণোদিতভাবে মেম্বারশীপ গ্রহণে আগ্রহী না-ও হতে পারেন।

বাংলাদেশে সারাবছর বিভিন্ন্ ইন্ডাস্ট্রিতে মেটাল ইংগট, বোল্ডার্স, ক্লিংকার্স,গম, সয়াবিন,সুগার চাঙ্ক, তুলা প্রভৃতি পণ্য বাল্ক আকারে  আমদানি হয়ে থাকে। এসব পণ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে নন-লাইনার ভাড়াটে জাহাজে পরিবহন করা হয়। আবার ভারত, নেপাল, ও ভুটান থেকে আমাদের দেশে স্থলপথে ট্রাকে পরিবাহিত হয়ে প্রচুর আমদানি হয়। এ দুই ধরনের পরিবহন সংস্থার বেশিরভাগেরই ব্লকচেইনের মত উচ্চমাত্রার প্রযুক্তি আত্মস্থ করার উপযোগী সেট আপ বা দক্ষতা নেই।

ব্লকচেইন এলসি বাস্তবায়নের আরেকাট বড় চ্যালেঞ্জ হলো ইউনিফর্মিটির অপরিহার্যতা। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য মূলত আমদানি নির্ভর। এশিয়া,ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা - সকল মহাদেশ থেকেই আমাদের  দেশে পণ্য আসে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে বিভিন্ন দেশে ব্লকচেইন প্লাটফরমের প্রকার এবং বিদ্যমানতার হার বিভিন্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবহারকারীদের একটি কমন প্লাটফরমের আওতায় নিয়ে আসা জরুরী যা দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ।

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে SWIFT [সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন] এর প্রচলন হয় সীমিত পরিসরে। শুরুতে কেবল বিদেশী ব্যাংকগুলো এর সদস্য ছিল। অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার কারণে স্থানীয় ব্যাংকগুলো পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সার্বিক সুবিধার বিবেচনায় তারা ক্রমান্বয়ে মেম্বার হতে থাকে। দুই দশক পেরিয়ে সকল তফসীলি ব্যাংক বর্তমানে SWIFT এর সদস্য। এখন যে কোন এলসি SWIFT এর মাধ্যমে ট্রান্সমিট হয়। এমনকি লোকাল এলসির পেমেন্টও SWIFT এ দেয়া হচ্ছে। একই ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল ট্রান্সফর্মশেনর এই যুগে ব্লকচেইন এলসি একটি বাস্তবতা। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এর উত্তরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেই আলোকে প্রথম ব্যাংক হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড এবং প্রথম কাস্টমার হিসেবে ভিয়েলাটেক্সের নাম ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলো, বলাই বাহুল্য।

লেখক: ব্যাংকার
[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন