সিস্টেমিক বৈষম্য নিরসনই হতে হবে নিউ নরমালের মূল সুর

আসিফ সালেহ ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক। ২০১১ সালে ব্র্যাকে যোগদানের পর সামাজিক পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ ও সামাজিক উদ্ভাবনে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠানটির কৌশলগত দিকনির্দেশনায় তার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। করোনায় দেশের এনজিও খাতের ওপর প্রভাব, অর্থায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, কর্মসংস্থানসহ নানা বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

এনজিও খাতে করোনা মহামারীর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?
এনজিও খাতে করোনা মহামারীর নানামুখী প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। তবে ধাক্কাটা মূলত আর্থিক। কাজ করার প্রয়োজন (নিড) বাড়লেও অর্থায়নে বড় ধরনের ঘাটতি চোখে পড়ছে। লকডাউনের কারণে প্রায় আড়াই মাস ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলো মাঠে থাকতে পারেনি। কিন্তু বিপুল জনশক্তিকে তাদের বহন করতে হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের কাজটা প্রধানত অর্থ দেয়া-নেয়ার এবং এখানে একটা ক্যাশ ফ্লোর ব্যাপার রয়েছে। কাজেই ছোট অবয়বের অনেক এনজিও টিকে থাকতে তুমুলভাবে লড়েছে, এখনো লড়ছে। যারা এ ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি, তারা মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে সবকিছু খুলে দেয়া হলে করোনার ধাক্কা মোকাবেলায় মানুষের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সেটা জোগান দেয়াটাই এখন চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে খেলাপিও কিছুটা বাড়বে। সেটি ধরে নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। এটি অনেকের পক্ষে সামাল দেয়া একটু কষ্টকর হচ্ছে।

আমরা দেখছি যে বৈদেশিক ঋণের ওপর যারা নির্ভরশীল, তাদের বিদ্যমান সাহায্য (গ্রান্ট) কভিডের জন্যই খরচ করতে বলা হচ্ছে। নতুন করে অর্থ দিচ্ছে না। আবার বিদ্যমান গ্রান্টকে কেটে-ছেঁটে অন্য সংস্থাগুলোকে কভিডের জন্য দিচ্ছে দাতা সংস্থাগুলো। এ কারণে অনেক এনজিও আর্থিক সংকটে পড়েছে। একই সঙ্গে আগামী দিনগুলোয় গ্রান্ট কতটা আসবে, তা নিয়ে একটা বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। কারণ যেসব দেশ এসব সাহায্য দিয়ে থাকে, তারা প্রত্যেকেই একটা বড় রকমের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আমাদের একটি বড় দাতা ইউকে এইড বা ডিএফআইডি বিলুপ্ত হয়েছে। ইউকে এইড বা ডিএফআইডির সঙ্গে দেশটির ফরেন অফিসকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তার মানে অর্থনৈতিক সাহায্যটা যাবে মূলত তাদের রাজনৈতিক কৌশল বা ফরেন পলিসির অংশ হিসেবে। সেখান থেকে আর প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ সাহায্য যাবে না, যা এতদিন ধরে হয়ে আসছিল। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে বা ফরেন পলিসি অনুযায়ী বাংলাদেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার ওপর নির্ভর করবে এখানে কতটা এইড আসবে এবং বাংলাদেশের জন্য যে বরাদ্দ, তার থেকে কতটা এনজিওগুলো পাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের এনজিও খাতের জন্য একটা বড় অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

আমাদের অর্থায়নের উৎস মূলত তিনটিই। সোস্যাল এন্টারপ্রাইজগুলো, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং বৈদেশিক সাহায্য ও ব্যাংকে থাকা ইনভেস্টমেন্ট। সেদিক থেকে প্রত্যেকেই মোটামুটি সংকটে রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব ঘুরে দাঁড়াতে, তার পরেও মনে হয় দু-এক বছর খুব টানাপড়েনের মধ্যে যাবে।

বিভিন্ন খাতের জন্য সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও এনজিওগুলোর জন্য এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এটাকে কীভাবে দেখেন?
এটা খুব জরুরি ছিল। কারণ এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। অনেক সময় খাতটি সেভাবে স্বীকৃত নয়। আমাদের খাতের সমস্যাগুলো নীতিনির্ধারক মহলে তুলে ধরার জন্য প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি আজকাল বেশ অনুভব করছি, যার কারণে আমরা খুব ভুগছি। বিভিন্ন এনজিও এখন একসঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলছে। আশা করছি অচিরেই হয়তো একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন তৈরি করতে পারব, যাতে সংকটকালে এনজিওগুলোর সমস্যা নিরসনে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে ধরনের সম্পৃক্ততা, স্বীকৃতি ও সহযোগিতা দরকার, তা নিশ্চিত করতে পারি। এ নিয়ে সুখবর হয়তো অচিরেই আপনারা শুনতে পারবেন।

আগেই বলেছি, আমাদের মতো বড় সংগঠন হয়তো এ সংকট মোকাবেলা করে কোনোমতে বছরটা উতরে যাবে। আমরা হয়তো আগামী বছরের জন্য তাকিয়ে থাকব, কী অবস্থা হয়। কিন্তু ছোট অনেক এনজিওর জন্য এই ঝড়টা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তাতে একদিকে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো ব্যাহত হবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের জায়গাটিও সংকোচনের একটি শঙ্কা দেখছি। 

কভিডের সময়ে কোন দিকগুলোয় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন?
কভিডের আগে একটি বাস্তবতা ছিল যে এনজিওগুলোর মাধ্যমে দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে একটি বড় অগ্রগতি হয়েছে। এখন করোনার ধাক্কায় নতুন দরিদ্রের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সাড়ে ২০ শতাংশ থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ চলে গেছে। প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। এ জায়গায় আবার কাজ করতে হবে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি আরেকটি গ্রুপ রয়েছে, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পড়ে। যারা কারো কাছে হাত পাততে পারছে না, সরকারি সহায়তা পাচ্ছে না এবং কোনো সামাজিক বলয়ের মধ্যেও নেই, কিন্তু তারা কষ্টে আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি তারা প্রতি মাসের শুরুতে বাসাভাড়া না দিতে পেরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। এ গ্রুপের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। তাদের লক্ষ্য করেও কর্মসূচি নিতে হবে। তার মানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি ব্যাপার আছে। এক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার দরকার রয়েছে আর আশির দশকে এনজিওগুলো যেভাবে কাজ করেছিল, সেভাবে কাজ করারও প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকের সঙ্গে সামাজিক দিকেও নজর দেয়া জরুরি।

আমরা শিক্ষায় অনেক দূর এগিয়েছিলাম। শিক্ষায় অভিগম্যতা, লিঙ্গসমতায় যে অগ্রগতি হয়েছিল, সেটি এখন বড় হুমকির সম্মুখীন। কারণ প্রায় ছয় মাস ধরে স্কুল বন্ধ এবং আরো কতদিন বন্ধ থাকবে তা জানি না। যখন স্কুলগুলো খুলবে, তখন সব শিশুকে স্কুলে পাব না। অনেক শিশু ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কাজেই তাদের শিক্ষার একটা বড় কাজ আমাদের সামনে আছে।

বাল্যবিবাহ আবার বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নারীদের ওপর  সহিংসতা বাড়ছে। তার মানে এসব নতুন সামাজিক সমস্যা যেমন আছে, পাশাপাশি আগের সমস্যাগুলো—তরুণদের বেকারত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা এসব তো ছিলই। আমরা যে এখন একটি প্রলম্বিত বন্যা দেখছি, ঘন ঘন বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি, এটাই কিন্তু অনুমান করেছিলেন অনেক বিজ্ঞানী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সংকট আমাদের সামনে আসবে। কিছুদিন একটা সুপার সাইক্লোন গেছে, এখন প্রলম্বিত বন্যা দেখছি। তার মধ্যে চলছে মহামারী। সব মিলিয়ে এই নতুন বাস্তবতার মধ্যেই কিন্তু আমাদের থাকতে হবে। এ অবস্থা সরকারের একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হবে না। এনজিওগুলোকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। নতুন সামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেই জায়গায় নতুন মডেল তৈরি করতে হবে। এ কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

সবকিছু সঠিকভাবে এগোলে আগামী বছর ভ্যাকসিনের একটি বড় কাজ আসছে। কভিড-১৯ টিকা দেয়ার জন্য মানুষকে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ, সেখানে সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হবে। এনজিওগুলোর যে কমিউনিটি আউটরিচের ক্ষমতা রয়েছে, তা সরকারকে কাজে লাগাতে হবে। আমার মনে হয়, এ ধরনের অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত, শিক্ষা ও সামাজিক বিভিন্ন কাজেই আমাদের আগামী দুই বছর ফোকাস করতে হবে। সরকারকে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে যে সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে এনজিওগুলোকে কীভাবে সচল রাখা যায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায়। আশা করছি সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নেই এনজিওগুলো কাজ করতে পারবে।

কভিড সংকটে দেখা যাচ্ছে সরকার নিজেই কাজ করতে চাইছে। এনজিওগুলোকে খুব একটা সম্পৃক্ত করছে না। এ প্রবণতা কেন বলে মনে হয়?
আমরা চেষ্টা করছি যেসব জায়গায় সরকারের গ্যাপ ছিল সেগুলো পূরণ করার। সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোরও চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়, আমরা হয়তো মহামারীর সবচেয়ে খারাপ সময় পার করে এসেছি। জুন-জুলাইয়ে ভাইরাসের তীব্রতা বাড়ছিল, অনেকেই সংক্রমিত হচ্ছিল। মানুষ হাসপাতালে জায়গা পাচ্ছিল না। সেই সংকটটা আমরা পার হয়েছি। এখন মোটামুটি মানুষ সচেতন হয়েছে কী করতে হবে, অসুখটা হলেই হাসপাতালে ছুটছে না, বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছে, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, হাসপাতালেও জায়গা আছে। ভাইরাসের সঙ্গে যে একটা সহাবস্থান করতে হবে, সেটি বুঝতে পারছে। কাজ শুরু করার জন্য মানুষের মধ্যে আস্থা এসেছে। সাবধানতা অবলম্বন করে কাজে যাচ্ছে, যদিও সব জায়গায় একই ধরনের সচেতনতা নেই।

এখন এ সময়টা খুব জরুরি গত ছয় মাসে যা হয়েছে তা ভুলে না গিয়ে সেখান থেকে কিছু শিক্ষা নেয়ার জন্য। কোন কোন বিষয় ভালো কাজ দিয়েছে, কোন কোন বিষয়ে আমাদের পদ্ধতিগত-ব্যবস্থাগত দুর্বলতা (সিস্টেমিক উইকনেস) ধরা পড়েছে, সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সেটি না পারলে আরেকটি দুর্যোগ এলে আগামীতে আমরা আবারো সংকটে পড়ব।

কয়েকটি ভালো দিক উল্লেখ করা যাক। প্রথমত, গত দশ বছরে ডিজিটালাইজেশনের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল, গত ছয় মাসে তার একটা সুফল আমরা দেখতে পেয়েছি। একটি ছোট উদাহরণ দিই। যেমন চালু করা ৩৩৩ লাইনটি মানুষের কাছে টেলিমেডিসিন সেবা পৌঁছে দেয়ার একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দিনে লাখ বা ততোধিক ফোন এসেছে বা আসছে ওই নাম্বারে। আবার সরকারের সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা ওই লাইনে আসা নাম্বারগুলো বিশ্লেষণ করে জানতে পারলাম কোন এলাকাগুলো থেকে হাই রিস্ক পসিবল কেইসগুলো আসছে। এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই করা হচ্ছে। জানা যাচ্ছে সেসব বাসায় এলে কভিড-১৯ রোগী আছে কিনা। কমিউনিটি সাপোর্ট টিমের মাধ্যমে এভাবে সরকার, বেসরকারি সংগঠন ও প্রাইভেট সেক্টরের সংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কভিড-১৯-এর রোগীরা যেন অন্তত ১০ দিন বাসায় থাকে, সাবধানতা অবলম্বন করে, মাস্ক পরিধান করে সেসব বিষয় বোঝানোর জন্য তাদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন ব্র্যাক ও অন্যান্য এনজিওর স্বাস্থ্যসেবিকারা। পাশাপাশি যেহেতু প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে, যারা হোয়াইট কলার জব করেন, তাদের জন্য অনেক সহজ হয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোমে আসার। এসব জায়গায় বড় উন্নতি দেখতে পাচ্ছি।

আবার কিছু দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে। একটি বিষয় বলব, প্রণোদনা সঠিক সময়ে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সঠিক সময়ে তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্বলতার জায়গাটা হলো ঘোষিত প্রণোদনা সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াটা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। তার মানে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আমাদের প্রচুর কাজ করতে হবে। এখানে বড় রকমের গলদ আছে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় গলদ ব্যাপকভাবে ধরা পড়েছে। গত বছর ডেঙ্গুর সময়ে হয়েছিল। অল্প চাপেই একেবারে ভেঙে পড়েছিল। বিশেষ করে শহরের স্বাস্থ্য অবকাঠামো। চলমান মহামারীতেও তা আমরা দেখেছি। তারপর এখানে পাবলিক সেক্টরের সঙ্গে প্রাইভেট সেক্টরের ব্যাপক সমন্বয়হীনতা বিদ্যমান। কোথাও কারো কোনো নেতৃত্ব নেই; মান উন্নয়নেও প্রচুর কাজ করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটাকে শক্তিশালী করে আরো অনেকদূর নিয়ে যাওয়া যায়। গত কয়েক মাসের শিক্ষা মনে রাখলে তাহলে আমার মনে হয় কমিউনিটি লেভেলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। আমরা শুধু হাসপাতালকেন্দ্রিক চিন্তা করি। সেখান থেকে বের হয়ে কিউরেটিভের পরিবর্তে প্রিভেনটিভ কীভাবে করা যায়, সেটি চিন্তা করতে হবে; যেটি এনজিওরা করছে। এখন আমরা দেখছি যে এনজিওগুলোর পক্ষে এত বড় স্কেলে কাজ করা অসম্ভব হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যে বিপুল তহবিল দরকার হয়, সেটি সহজলভ্য নয়। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অর্থায়ন করলে সমস্যা অনেকটা নিরসন হবে। বেশকিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করে আমরা যদি সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করি, মনে হয় সামনে এগোতে পারব, দৃঢ়ভাবে আগামী দুর্যোগগুলো সামলাতে পারব।

কভিডসৃষ্ট দারিদ্র্যের ডাইমেনশন কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে? এটা নিয়ে আপনাদের কোনো চিন্তা আছে কি?
আমরা এখন এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। এটা ডিজাইন টেবিলে রয়েছে। যে নতুন ধরনের প্রয়োজনগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো বোঝার চেষ্টা করছি। একটি উদাহরণ দিই। লাখ লাখ প্রবাসী কর্মী ফিরে আসছেন, তাদের নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমাদের পোশাককর্মীদের অনেকেই ছাঁটাই হচ্ছেন। আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। আগামী দিনগুলোয় আরো হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মানুষ বেকারত্বের সম্মুখীন হচ্ছে। এ সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের সমাধানভিত্তিক মডেল নিয়ে কাজ করতে হবে।

অবশ্য আমাদের শক্তিশালী দিকটি হলো কৃষি। কৃষিকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হবে, যারা গ্রামে ফিরে গেছে তারা যেন এ ধরনের নতুন কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অনেক শিক্ষিত তরুণ বাড়ি ফিরে গেছেন। তারা আবার কৃষিকে নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। তাদের কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা জোগানো যায়, তার পরিকল্পনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে মহামারীটা একটি দুর্যোগ যেমন, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে এটি একটি সুযোগও।

আমি দেখছি যে নতুন ধরনের কাজের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আইটি সেক্টরের কথা বলি। আগামী দিনগুলোয় এ খাতে আমরা বেশ কাজ দেখব। এখানে দক্ষ লোকের প্রয়োজন হবে। আগামী দু-এক বছর স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ হবে। রাষ্ট্র ও এনজিও খাত থেকেও একটি বড় রকমের কাজ হবে। সেখানে ল্যাব টেকনিশিয়ানের মতো স্কিলের দরকার হবে। নার্সিংয়ের মতো স্কিলের দরকার হবে। একটা গ্রুপকে আবার রি-স্কিলিং করে আমরা যদি নতুন কাজের সুযোগের দিকে নিতে পারি তাহলে তাদেরও কর্মসংস্থান হতে পরে। আমার কাছে মনে হচ্ছে কিছু চাকরি হয়তো চলে যাবে, কিছু সুযোগও তৈরি হবে।

আমরা জানি না, পুরো অর্থনীতি কবে নাগাদ ঘুরে দাঁড়াবে। করোনার ধাক্কায় মানুষের আর্থিক ক্ষমতা কমেছে। ডিসপোজেবল ইনকাম কমে যাওয়ায় খরচও কমবে। একই সঙ্গে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি সেক্টরেও চাহিদা কমবে। অনেক কাজ বেশ কিছুদিনের জন্য চলে যাবে, নতুন কাজ তৈরি হবে। এগুলো চিহ্নিত করে স্কিলিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি। যারা দেশে ফেরত আসছেন, তারা কিছু সেভিংস নিয়ে আসছেন, অনেকেই আসছেন কপর্দকহীন হয়ে। যারা টাকা নিয়ে আসছেন, তাদের আরো কিছু প্রণোদনা দিয়ে যদি ব্যবসা দিতে সাহায্য করতে পারি তাহলে তারা আরো কিছু মানুষকে কাজের সুযোগ দিতে পারবে।

একটি ভালো দিক যে বিভিন্ন সংগঠন একসঙ্গে কাজ করায় উদ্যোগী, যুক্ত হচ্ছেন। আমরা গ্রামীণফোনের সঙ্গে বড়ভাবে কাজ করেছি। এখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি কীভাবে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা যায়। বিভিন্ন ধরনের সংগঠন একসঙ্গে বুদ্ধি খাটালে, কৌশল তৈরি করলে আমার মনে হয় একটা ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করতে পারব। আগামী দুই বছরে রিকভারি ফেইজে আমাদের সেভাবেই চিন্তা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা করতে হবে কোন জায়গায়টায় আসলে কাজ করা দরকার। ব্র্যাকও কিছু গবেষণার উদ্যোগ নিচ্ছে। আমরা সাধারণত কিছু সমাধানভিত্তিক মডেল তৈরি করি। সেটি আমরা এবারো করার চেষ্টা করছি।

কৃষিতে এরই মধ্যে উদ্বৃত্ত শ্রমিক আছেন, সেখানে যান্ত্রিকীকরণ ঘটছে। সেক্ষেত্রে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব বেশি আছে কি?
গতানুগতিকভাবে দেখলে হয়তো কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে নেই। আপনি বলছেন, ম্যাকানাইজেশন ঘটছে। নতুন ধরনের ম্যাকানাইজেশনে এলে কারা কাজ করবে, সেখানেও কিছু ট্রেনিংয়ের ব্যাপার আছে। এখানেও নতুন উদ্যোক্তার দরকার আছে। সে ধরনের কাজ প্রয়োজন। আমার মনে হয় সমবায়-খামার ভিত্তিতে আরো বড় মাত্রায় কৃষিতে কাজ করার সুযোগ আছে।

করোনা-পরবর্তী সময়ে সমাজে যে অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাবে, সেটা কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, তা নিয়ে কি কোনো গবেষণা করছেন?
এটা আমাদের মাথায় আছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা একটা নতুন কাজেও হাত দিয়েছি। আগেই বলেছি প্রবাসী শ্রমিকদের কথা। তাদের নিয়ে একটা কাজ হচ্ছে। পাশাপাশি ছয় হাজার পরিবারকে ট্র্যাক করা হচ্ছে পর্যায়ক্রমিকভাবে। তারা কী ধরনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আছেন, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন, সেই রকম একটা দিকে কাজ করা হচ্ছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা মূলত এসএমইকে সাপোর্ট করি। ব্র্যাক ব্যাংক গবেষণা করে দেখছে যে নিয়মিত ভিত্তিতে কী ধরনের সাপোর্ট এই ছোট ব্যবসাগুলোর জন্য দরকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা করে সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করছি, এভিডেন্সগুলো বোঝার চেষ্টা করছি এবং কোন জায়গায় প্রাধিকার দেয়া দরকার, সেটি একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করছি। তবে সমাধান কী, তার মডেল এখনো তৈরি হয়নি। মাঠকর্মীরা এটা নিয়ে কাজ করছেন।

আগামী দিনগুলোয় আমাদের সম্পদ কমে যাচ্ছে কিন্তু প্রয়োজন অনেক বাড়ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক বেশি যৌথভাবে কাজ করতে হবে। একজন যদি কোনো মডেল তৈরি করে, অন্যরা যাতে সেটি স্কেলআপের কাজ করে, সেভাবে কাজ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ঠিক জায়গায় যাচ্ছে কিনা এবং এর টার্গেটিং ঠিক হচ্ছে কিনা, সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। মনে হয় এক্ষেত্রে সরকার এনজিও খাতকে আরো বেশি কাজে লাগাতে পারবে।

তবে সেই বিষয়টি এখনো তেমনভাবে হচ্ছে না। একটি প্রবণতা তো আছে যে আমরা একাই পারব। তাছাড়া কিছুটা অবমূল্যায়ন করারও প্রবণতা আছে। আমার মনে হয়, সেই চিন্তা থেকে বেরোনোর সময় এসেছে। আমাদের সরকার ও এনজিওগুলো একসঙ্গে কাজ করেছে বলেই এমডিজিতে একটা বড় সাফল্য এসেছে। সেক্ষেত্রে এনজিও খাতের অবদান খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গত চার-পাঁচ মাসেও যৌথভাবে কাজ করেছি। কমিউনিটি সাপোর্ট টিম করেছি, স্বাস্থ্যসেবিকারা কাজ করেছেন, সরকারের টেস্টিং মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ব্র্যাক স্যাম্পল কালেকশন বুথ তৈরি করেছে, লকডাউনের সময়ে আর্থিক সাহায্য নিয়ে ১৪ লাখ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এ রকম নানা উদ্যোগ আমরা নিজে থেকেই নিয়েছি। পারস্পরিক সহযোগিতা আরো বাড়ালে এই রিকভারি ফেইজটা সফল হবে।

সরকার গবেষণা করে দেখেছে যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। এজন্য এগুলো ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে এ সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তো আপনারাও একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন?
আমরা সব রকমভাবে সম্পৃক্ততার চেষ্টা করছি। সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের কথা বলতে পারি। এটি দুটি বছরের একটি কর্মসূচি। এর মাধ্যমে সম্পদ ট্রান্সফার হয়। মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য সর্বাত্মক সাপোর্ট দেয়া হয়। এ সাপোর্ট কাজে লাগিয়ে ৯০ শতাংশ মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। এটি শুধু সোস্যাল সেফটি নেট সাপোর্ট নয়, এর চেয়েও বেশি কিছু। দুই বছর পর আর সাপোর্ট দেয়া লাগে না। দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে এর মাধ্যমে সরকারের অনেক খরচ কমে যায়। এটি খুব সফল প্রোগ্রাম। প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মানুষকে আমরা এর আওতায় নিয়ে আসি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৬টি দেশে বিভিন্ন কনসেপ্টে এটি চালু করা হয়েছে। আরো যাতে বিভিন্ন দেশের সরকার এ মডেল নেয়, তার জন্য আমরা দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছি। এটা নিয়ে আরো নতুন ছয় দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথাবার্তা চলছে। এটি একটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড মডেল। বাংলাদেশ থেকেই তৈরি হয়েছে এটি। বাংলাদেশেরই সৃষ্টি এটি এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এটার ওপরে গবেষণা করে নোবেলপ্রাপ্তি ঘটেছে। একে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। এখনো চেষ্টা করে যাব যে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনায় এর শিক্ষাগুলো কীভাবে যুক্ত করা যায়। আমাদের দেশেরই একটি মডেল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে আর আমাদের দেশের সরকার এটিকে এখনো সেভাবে ব্যবহার করতে পারছে না, এটি আমাদের কাছে খুব খারাপ লাগে। আশা করছি আমরা এটিকে সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারব। 

আপনারা কি কখনো যাচাই করেছেন আপনাদের সাহায্য পেয়ে যারা দারিদ্র্য জয় করেছে, তাদের কত শতাংশ আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে?
সবসময়ই এভাবে লঙ্গিচুয়েশনাল স্টাডি হয়নি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস এ বিষয়ে র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল পদ্ধতিতে একটি পর্যালোচনামূলক কাজ করেছিল। এতে দেখা গেছে, কর্মসূচি শেষ হওয়ার সাত বছর পর দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাসকারী দুই দলের মধ্যে সঞ্চয়ের ব্যবধান ৯০ শতাংশ কমে এসেছে, একই সঙ্গে দরিদ্রদের উপার্জন ৩৭ শতাংশ, খরচের সামর্থ্য ১০ শতাংশ এবং জমির মালিকানা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। তাছাড়া ব্র্যাকের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দরিদ্র পরিবারগুলোর পুষ্টি, উৎপাদনশীল সম্পদ ও মনোসামাজিক অবস্থারও উন্নতি ঘটেছে। ব্র্যাকের গবেষণা ও নিরীক্ষণ বিভাগের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের ৯৫ শতাংশ সফলভাবে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন এবং কর্মসূচি শেষ হওয়ার চার বছর পরও তাদের উন্নয়ন অব্যাহত থেকেছে। কিছু মানুষ আবার আর্থিক সমস্যায় পড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে, নানা সংকটের কারণে। কোপিং ম্যাকানিজম তারা মনে হয় অবলম্বন করতে পারেননি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে আমরা যে একটা সহায়তা দিই, তাতে একটি সেভিংস কম্পোনেন্ট আছে। সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত একটা অংশ সঞ্চয় করতে হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো যে যখন নিদানকাল আসবে, বিপদ আসবে, তখন যেন তারা এটিকে ব্যবহার করতে পারে। যখন লকডাউন হলো, তখন আমরা এর উপকারিতা দেখলাম। তখন আমাদের কাছে সদস্যরা সবাই এলেন সেভিংস তোলার জন্য। একদিকে আমরা তো গ্রান্ট দিয়েছি, অন্যদিকে মে-জুন মাসের সময়টায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা সেভিংসগুলো তুলেছে। এটা তাদের বড় ধরনের সাশ্রয় দিয়েছে। এ ধরনের কোপিং ম্যাকানিজমগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বেকারত্ব হ্রাসে কোনো পরিকল্পনা করছেন?
আমরা মনে করেছিলাম সার্ভিস সেক্টরে অনেক কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, সেক্ষেত্রে স্কিলিং করে মানুষকে এ খাতে কাজ দিতে পারব কিংবা বা আমরা বিদেশে পাঠাতে পারব। বিষয়টি আপাতত হচ্ছে না। সার্ভিস সেক্টরে কাজ কমে গেছে, বিদেশ যাওয়া একেবারে কমে গেছে। আগামী এক-দেড় বছর এটি বন্ধই থাকবে। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরিতে আমরা আরো বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে গ্রান্টের মতো একটা সাপোর্টের পাশাপাশি কিছু ট্রেনিং দেয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছি।

এখনো সলিউশনগুলো আমরা পাইনি, গবেষণাগুলো দেখছি, চিন্তা করছি যে আসলে বেকারত্বের দিকটি কীভাবে ম্যানেজ করা যায়। তবে আপাতত চিন্তা করছি কিছু এমপ্লয়মেন্ট সেন্টারের মতো করব। এখন দেখছি যে মানুষের কাছে ভালো ও সঠিক তথ্যের খুব অভাব। যোগ্যতা অনুযায়ী একজন তরুণের জন্য কী রাস্তা খোলা আছে, সেই তথ্যটি পাওয়াটা দুষ্কর। কোথায় যাবে, কোন জায়গায় অ্যাপ্লাই করবে, কোন ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে যাবে, কোথায় গেলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে—এ ধরনের তথ্যের খুব অভাব রয়েছে। পাশাপাশি একটি দক্ষতা অনুযায়ী ডাটাবেজও নেই। এক্ষেত্রে কাজ করার চেষ্টা করছি।

দক্ষিণ এশিয়ার একটি সংগঠনকে দেখে আমরা একটি মডেল তৈরিতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। সেটি হলো এমপ্লয়মেন্ট সেন্টার। এর একটি ফিজিকাল সেন্টার থাকবে, আবার একটি ভার্চুয়াল পোর্টালও থাকবে। যেখানে গিয়ে মানুষ সঠিক তথ্যগুলো পাবে। প্রথমে তিনটি জায়গায় করছি। ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে। উদ্দেশ্য, একদিকে মানুষকে সঠিক তথ্য দেয়া, অন্যদিকে এমপ্লয়ারদের সঙ্গে ম্যাচমেকিংয়ে সম্পৃক্ত করা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন দক্ষতা বাড়াতে ট্রেনিং দেয়া, যেটি একজন মানুষকে আরো কর্মযোগ্য করে তোলে। পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে দেখব যে এর সম্প্রসারণ করা যায় কিনা। সরকারের সঙ্গে একত্রে করতে পারলে আমার মনে হয় এটি আরো তাড়াতাড়ি স্কেলআপ হবে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আপনাদের এখন কী অবস্থা?
আমরা যেসব দেশে কাজ করছি, সেখানে কভিডের সংক্রমণ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে আংশিক লকডাউনের মধ্যে ছিল। ফলে মাইক্রোফিন্যান্সসহ আমাদের সব কর্মসূচিই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে একটি কাজ আগামীতে আরো বেশি সম্প্রসারিত হবে। সেটি হলো আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম। একটি বড় আউটকাম পেয়েছি সরকারের মাধ্যমে এটিকে স্কেলআপ করায়। এ কর্মসূচি নিয়ে আরো নতুন ছয়টি দেশে আমরা যাচ্ছি। এর মাধ্যমে আমাদের প্রভাবের একটি বড় সম্প্রসারণ দেখতে পাব। অনেক দেশে ব্র্যাক কিন্তু ছোট এনজিও। কভিডের কারণে সেখানেও সংকট চলছে। আমাদের অর্থায়ন কমে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমরা নতুন ধরনের দাতা, বিলিয়নেয়ারদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। তারা এখন অনেক বেশি জনকল্যাণে (ফিলানথ্রফি) যুক্ত হচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে পারলে আমরা আরো বেশি সম্প্রসারিত হতে পারব।

ব্যক্তি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক সিএসআরের অর্থ খরচ করে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাকানিজমের অভাবে বিপুল অর্থ অপচয় হয়। সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কাজ করার কোনো ইচ্ছা আছে কিনা।
আমরা বিকল্প সম্পদগুলো অন্বেষণের চেষ্টা করছি। কভিডের সময় আমরা যে কাজটি করেছি, তাতে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার পেয়েছি ব্যক্তি খাত এবং ছোট ছোট প্রাইভেট ডোনেশনের মাধ্যমে। এটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তার মানে এটি অর্থায়নের ক্ষেত্রে একটি ভালো জায়গা হতে পারে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন। তারা বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে আগ্রহী। কাজেই তাদের নিয়ে একটি পোর্টালের মতো করার চিন্তা করছি। কোনো প্রবাসী যদি সুনির্দিষ্ট কোনো এলাকার ( গ্রামে) কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে চান, সেই সংযুক্তি আমরা পোর্টালের মাধ্যমে করে দিতে পারব। তখন তারা নিজেরাও কাজটা মনিটর করতে পারবে। কতদূর এগিয়েছে, সেই বিষয়ে একটি রিপোর্ট পাবেন। সুতরাং এ ধরনের যোগসূত্রের একটি বন্ধন ওই পোর্টালের মাধ্যমে করার চেষ্টা করছি। পোর্টালটি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আাাছে। মাস দুয়েকের মধ্যে সেটি চালু করার আশা করছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিন। তবে আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনাকে আমরা দুইভাগে ভাগ করেছি। প্রথম দুই বছর (২১-২২) পুরোপুরি ফোকাস থাকবে রিকভারিতে। এর পরে মহামারী নিয়ন্ত্রণে থাকলে চলতি বছরের শুরুতে যে অবস্থায় ছিলাম, সে অবস্থায় পৌঁছতে পারব। তখন পূর্ণোদ্যমে আবার কাজ এগোবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে আগের মতো কাজ পুরোপুরি হবে না। নিউ নরমালের অনেক কিছু নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। নিউ নরমালের অনেক ভালো দিকও আছে। সেক্ষেত্রে ওল্ড নরমালে পুরোপুরি ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। সবার সব দিন অফিস যাওয়ার দরকার নেই, টাইমিং ফ্লেক্সিবেল হবে। সেটি হলে ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম কমবে, পরিবেশ দূষণ কমবে। মা-বাবা, পরিবারের সঙ্গে আমাদের নিবিষ্টতা বাড়বে। ব্র্যাকে আমরা কভিডের সময়ে মাঠকর্মীদের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত হতে পারছি। কর্মসম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি। তাদের কথা শুনছি। তাদের আইডিয়াগুলো পাচ্ছি। তাতে সমস্যাগুলোর চটজলদি সমাধান দিতে পারছি। এই ভালো বিষয়গুলো আমরা ধরে রাখতে চাই। আমরা চাই না যে গত চার-পাঁচ মাসে সামাজিকভাবে ধরা পড়া সিস্টেমিক বৈষম্যগুলোয় আবার ফিরে যাই। আবার একটি ফলস সেন্স অব কমফোর্টে ফিরে যাওয়াটা একটা ট্রাজেডি হবে। কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে, কোনগুলো কাজ করেনি, সেটি নিয়ে আমরা যদি সবাই চিন্তা করি এবং নির্দেশনাগুলো পাই তাহলে প্রাধিকার ঠিক করা সহজ হবে এবং এগিয়ে যাওয়ার পথটিও সুগম হবে।

শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন