করোনা মহামারীর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে। পুঁজি ও টিকে থাকার সক্ষমতা কম থাকায় সংগত কারণেই এর সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএসএমই) খাতের ব্যবসায়। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গৃহীত লকডাউনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা। কাজ হারিয়ে আয়হীন হয়ে পড়েছেন এ খাতের বিপুলসংখ্যক কর্মী। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পথে, কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে। তবে ক্ষতি পুষিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকার সিএসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য গত এপ্রিলেই ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু চার মাসে প্রণোদনা তহবিল থেকে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তিতে কাঙ্ক্ষিত গতি নেই। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হলেও এ সময়ের মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যেখানে বড় উদ্যোক্তারা ৭৬ শতাংশ অর্থ পেয়েছেন, সেখানে সিএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা পেয়েছেন বরাদ্দকৃত প্যাকেজের মাত্র ১৭ শতাংশ অর্থ। এটা হতাশাজনক। সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রণোদনার সময়সীমা ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে প্যাকেজ বাস্তবায়ন, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ নিশ্চিতে ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো সচেষ্টতা জরুরি।
আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন হলো সিএসএমই খাত। তথ্যমতে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। শিল্প খাতে যত কর্মসংস্থান হয়, তার ৮৬ শতাংশই সিএসএমই খাতের। এ খাতের শিল্পগুলো থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়, কর্মীদের মজুরি বাবদ ব্যয় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। দেশের কর্মসংস্থানের বড় উৎসও এ খাত। কাজেই সিএসএমই খাত যত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে ততই এর গুণক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বেশ সময় পেরোলেও ছোট উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার অর্থ পোহাতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। ঘোষিত প্রণোদনা তহবিল থেকে তাদের ঋণবঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অনীহাকে বড় করে দেখছেন তারা। অন্যদিকে ব্যাংকারদের ভাষ্য হলো, কঠিন শর্ত ও ছোট ঋণ বিতরণের নীতিমালায় বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার কারণেই ছোট উদ্যোক্তাদের অর্থ পেতে ভোগান্তি হচ্ছে। এ অবস্থার দ্রুত অবসান জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী, মোট ঋণের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ দিতে হবে উৎপাদনশীল খাতে, ৩০ শতাংশ সেবা খাত এবং বাকি ২০ শতাংশ দিতে হবে ট্রেডিং ব্যবসায়। অথচ ট্রেডিং ব্যবসায়ীদের ঋণের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। বিদ্যমান শিল্পনীতিতে সুপারশপগুলোকে সেবা খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও একই সেবা দেয়া মুদি দোকান ও খুচরা বিক্রেতাদের ট্রেডিং ব্যবসায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের একটি বড় অংশই ব্যাংকের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে ঋণ বিতরণে আগ্রহী হচ্ছে না। ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তিতে এটা বড় ধরনের বাধা। এটি দূর করতে হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তে আরো বলা হয়েছে, প্রণোদনা প্যাকেজভুক্ত ঋণ দেয়া যাবে কেবল চলতি মূলধন হিসেবে। অথচ বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মেয়াদি ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী বলে জানা গেছে। কেননা সিএসএমই খাতের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শুধু মেয়াদি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। সাধারণভাবে তাদের চলতি মূলধন ঋণের প্রয়োজন পড়ে না। তদুপরি প্রণোদনা তহবিলের মেয়াদ হবে তিন বছর। অথচ সরকার ৯ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশ হারে সুদ ভর্তুকি দেবে এক বছরের জন্য। ফলে পরবর্তী দুই বছরে গ্রাহক পর্যায়ে সুদ বৃদ্ধির ফলে ঋণ আদায়ে ব্যাংকের সঙ্গে ঝামেলা হতে পারে। এজন্যও ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ বিতরণে খুব একটা আগ্রহী নয়। কাজেই ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের স্বার্থেই শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা জরুরি এবং এক্ষেত্রে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন আবশ্যক।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের সিএসএমই খাতে প্রায় ১৩ লাখ ইউনিট থাকলেও মাত্র ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং লেনদেনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেদিক থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রণোদনার অর্থছাড়ের নিয়ম করায় অনানুষ্ঠানিক খাতে গড়ে ওঠা বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার জন্য ঘোষিত প্যাকেজের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় ব্যাংকিং চ্যানেলের পাশাপাশি মাইক্রো ফিন্যান্সিং ইনস্টিটিউটসহ (এমএফআই) নন-ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের অপ্রাতিষ্ঠানিক, কুটির, ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসার জন্য ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে এমএফআইকে প্রণোদনার অর্থ বিতরণে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটা সময়োপযোগী উদ্যোগ। দ্রুততম সময়ে আরো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তার উপায় সন্ধান করতে হবে।
ছোট উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করতে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও খেলাপি করার সময় বাড়ানো, প্রভিশন কমানো, ২ হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম গঠনসহ বেশকিছু পরিপূরক পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে এ খাতে ঋণ বিতরণ কিছুটা বাড়লেও এখনো কাঙ্ক্ষিত গতি ফেরেনি। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও আরো আন্তরিক হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও বাড়াতে হবে। ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয়তায় ছোট উদ্যোক্তারা স্বল্পতম সময়ে প্রণোদনার অর্থ পাবে এবং অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এটিই প্রত্যাশা।
