নারীর নিরাপত্তায় কী ভাবছেন নারীরা

বণিক বার্তা ডেস্ক

বাংলাদেশে নারীরা ঠিক কতটুকু নিরাপদ? এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই গত ২৭ আগস্ট  ‘ইয়ুথ পলিসি ফোরাম’ আয়োজন করে ‘ওয়াইপিএফ ইয়ুথ ইনসাইটস’ শীর্ষক অনলাইন ওয়েবিনার সিরিজের তৃতীয় পর্ব। 

এই পর্বে ‘ইয়ুথ পলিসি ফোরাম’- এর সহ প্রতিষ্ঠাতা সেগুফতা আরমিন আহসানের সঞ্চালনায় অংশগ্রহণ করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কতিপয় নারী শিক্ষার্থী ও নারী উদ্যোক্তারা। সেশনটির শুরুতেই সঞ্চালক আরমিন উপস্থিত অতিথিদের কাছে আলোচনার মূল বিষয়টি অর্থাৎ, কিভাবে বাংলাদেশে নারী নিরাপত্তা  নিশ্চিত করা যায় এবং এই সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো তুলে ধরতে আহ্বান করেন। 

নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে রাজনীতির ভূমিকাকে অগ্রগণ্য আখ্যায়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মাকসুদা আক্তার তমা বলেন, “বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ কম।” এবং এই অবস্থার জন্য তিনি ‘মেয়েদের ছাত্র রাজনীতি’ অনুশীলনে সমাজের বক্র দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রাপ্ত অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধাকে দায়ী করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার বিভাগের শিক্ষার্থী নাভিয়া নোভেলি বলেন, “দেশের অধিকাংশ পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টের জন্য কোন কমপ্লেইন বক্স নেই।” নারীরা প্রতিনয়ত কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নোভেলি এইদেশে নারী নিরাপত্তায় মেয়েদের  কোন বড় আন্দোলনের অনুপস্থিতিকেও ক্রমবর্ধমান যৌন হয়রানির একটি কারণ বলে মনে করেন। 

অভয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন গৃহ ও কর্মক্ষেত্র উভয় জায়গায় নারীদের নিরাপত্তা ইস্যুতে উপেক্ষিত হবার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়েই মেয়েরা  পারিবারিক ভাবে নিরাপত্তার আশ্বস্ততা পেয়ে থাকেন না। গার্মেন্টসে কর্মরত মেয়েরা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হলেও অভিযোগ করার কোন সুযোগ পায় না। বরং, ভিকটিমকে দোষারোপ করার একটি সংস্কৃতি আমাদের সমাজে খুব শক্তভাবে বিদ্যমান। 

আদিবাসী নারীদের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে যেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অরিন বলেন, আদিবাসীদের আমরা নিজেদের অংশই মনে করি না। শহর তো বটেই এমনকি গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের থেকেও আদিবাসী নারীরা অনেক অনগ্রসর। এদেশে নারী নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনা করলে অবশ্যই আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলতে হবে।  স্পার্ক নামক একটি সংগঠনে আদিবাসীদের নিয়ে কর্মরত ফাইরুজ আরো বলেন, আদিবাসী নারীদের নিয়ে সরকারের আরো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লাবনী শর্মা মনে করেন শিক্ষা কারিকুলামে নারীদের অধিকার তুলে ধরা উচিত। তিনি আমাদের দেশীয় সমাজে নারী ও পুরুষের অবস্থানকে তুলে ধরে বলেন, পুরুষ নারীকে নিজের থেকে অধস্তন মনে করে। এইদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে নারীকে তুলে ধরা হয় তার চরিত্রের প্রশস্তি বর্ণনা করে। কিন্তু লাবনীর মতে, চরিত্রের প্রশস্তি বিচার নারী ও পুরুষ দুইদিক থেকেই হতে হবে। তিনি ধর্ষণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে আমরা ধর্ষিতা মেয়েদের পরিচয় উন্মোচন করে দোষারোপ করি। একটি ধর্ষণ সকল নারীর অনিরাপত্তাবোধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং শঙ্কিত করে। এসময় নারী নিরাপত্তায় আইন পরিবর্তনের প্রশ্নে তিনি বলেন, আইন পরিবর্তন করতে হলে সমাজের মূল্যবোধ গুলোকে ধাপে ধাপে পরিবর্তন করতে হবে। 

চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা তানিয়া তিন্নি বলেন, বাংলাদেশের একজন নাগরিক সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বিকেলে  বাসায় ফিরে আসতে পারবে কিনা এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। যেখানে সাধারণ নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নাই সেখানে বিশেষভাবে নারী নিরাপত্তা আশা করা তো দূরের কথা। বাংলাদেশের সকল স্তরেই নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এমনকি নিরাপত্তা প্রদানকারী আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর নিকটও নারীরা নিরাপদ নয়। তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরো জোরদার উদ্যোগ গ্রহনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। একই রকম প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন সদ্য ইউএন উইমেন এর অধীনে ইন্টার্নশিপ শেষ করা, এলিজাবেথ টাউন কলেজ, পেনসিলভানিয়ার সাবেক শিক্ষার্থী আফসারা মির্জা। তার মতে মহিলাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরো যত্নশীল ভাবে আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ করতে হবে। 

নারী নিরাপত্তায় সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেন, উইজকিট সংগঠনেরসহ প্রতিষ্ঠাতা বুশর-ই-আনজুম। বুশরার মতে, নারীদের বিভিন্ন রকম জোট গড়ে তুলে সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। এবং নারী নিরাপত্তায় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সাইবার বুলিং বা অনলাইন হুমকির মতো ব্যাপারগুলোও সরকারের দৃষ্টিতে আনা উচিৎ। 

প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলমান সেশনটিতে উপস্থিত অতিথিরা নিজ নিজ অবস্থান ও অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশে নারী নিরাপত্তার পরিস্থিতি ও বিভিন্ন সমাধানের উপায়  তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে এই সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণে একটি গাইডলাইন হতে পারে। সেশনটিতে পারস্পরিক আলোচনার পাশাপাশি অতিথিরা দর্শকদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসা ও মতামত নিয়েও কথা বলেন। 

'ইয়ুথ ইনসাইট' ধারাবাহিকটি 'ইয়ুথ পলিসি ফোরাম'- এর নতুন একটি আয়োজন। প্রতি বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য ও প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারনীমূলক পরিবর্তন নিয়ে তরুণ প্রজন্ম কি ভাবছে সেটাই এই সিরিজে আলোচনা করা হয়। এই সিরিজের সকল পর্ব 'ইয়ুথ পলিসি ফোরাম'- এর ফেসবুক পেজ থেকে দেখা যাবে। 

মোহাম্মদ সিফাত, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন