স্মৃতি সতত: সুখের

ঘাতকরা আমাদের শিক্ষকদের জাতির সবচেয়ে বড় ‘শত্রু’ মনে করেছে

শামীম আজাদ ও সেলিম জাহান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে স্মৃতিচারণা (পর্ব তিন)

শামীম আজাদ: বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা, যে জ্ঞানতাপসরা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন, যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা আমাদের দেশ পেয়েছি, সেই শহীদ শিক্ষকদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণার এ পর্বে আজ আমরা কথা বলব। তাদের স্মৃতি তর্পণ করব।

সেলিম জাহান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে আমরা আমাদের ২০ জন শিক্ষককে হারিয়েছি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), অধ্যাপক রাশিদুল হাসান (ইংরেজি বিভাগ), অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা বিভাগ), ড. জি সি দেব (দর্শন বিভাগ), ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি বিভাগ), অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস বিভাগ), ডক্টর আবুল খায়ের (ইতিহাস বিভাগ), অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস বিভাগ), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (জগন্নাথ হলের গৃহশিক্ষক),  অধ্যাপক আবদুল মুক্তাদির (ভূতত্ত্ব বিভাগ), ড. ফজলুর রহমান (ভূতত্ত্ব বিভাগ) ড. সিরাজুল ইসলাম খান (শিক্ষা ও গবেষণা), ড. ফয়জুল  মোহী (শিক্ষা ও গবেষণা), ড. এএনএম মনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান বিভাগ), ড. এ আর খাদিম (গণিত বিভাগ), অধ্যাপক শরাফত আলী (গণিত বিভাগ), অধ্যাপক সাদত আলী (শিক্ষা ও গবেষণা), মোহাম্মদ সাদেক (ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক) এবং ডাক্তার মোহাম্মদ  মর্তুজা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সক)।

শামীম আজাদ: সেলিম যখন আমাদের শিক্ষকদের নামগুলো উচ্চারণ করছে, তখন আমার মনে হচ্ছে আমাদের জন্মদাতা একজন পিতা আছেন কিন্তু পিতার সঙ্গে সমতুল্য কেবল শিক্ষকদের মনে হয়, মাতার সঙ্গে সমতুল্য কেবল শিক্ষয়িত্রীদের মনে হয়—৫০ বছরেও আমরা আমাদের সেই শিক্ষকদের কথা ভুলতে পারিনি। সেলিম, তুমি তো প্রায়ই বলো যে আজকে আমরা যারা যে যেখানে যা হয়েছি, অনেক সময় নানান অভিভাবক পেয়েছি, বন্ধু পেয়েছি, তাঁরা আমাদেরকে এই ‘আমি’ করেছে।  

সেলিম জাহান: আমরা আমাদের যে শিক্ষকদের নামগুলো বললাম, এদের কাউকে কাউকে আমরা হারিয়েছি ২৫ মার্চ কালরাতে। কোনো কোনো শিক্ষককে আবার পাকিস্তানি সেনারা তুলে নিয়ে গেছে তাদের বাড়ি থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ঠিক স্বাধীনতার প্রাক্কালে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এই যে দীর্ঘ তালিকা, সেই তালিকায় অনেকেই আমার সরাসরি শিক্ষক। অনেকেই শামীমের সরাসরি শিক্ষক। সুতরাং সেই শিক্ষকদের স্মৃতি তর্পণে যাঁরা আমাদের সরাসরি শিক্ষক, তাঁদের কথাই আমরা বেশি বলব।  যাঁরা আমাদের সরাসরি শিক্ষক নন, তাঁদের কথাও আসবে কিন্তু ঠিক নিবিড়ভাবে হয়তো আমরা তাঁদের দেখিনি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন যেমন শিক্ষক লাউঞ্জে সিরাজুল হক এবং আলী আহসান বলে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে, টিএসসিতে লাড্ডু মিয়া, আমরা সবাই তাঁকে চিনতাম, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে চুন্নু মিয়াকে সপরিবারে, মধুদাকে আমরা হারিয়েছি—যাঁরা আমাদের অভিভাবক ছিলেন, একদিন আমরা তাঁদের কথা বলব। আমরা আমাদের বন্ধুদের কথা বলব। আমরা আমাদের যে সতীর্থদের হারিয়েছি, তাদের নিয়ে কথা বলব। একটা কথা আমার সবসময় মনে হয়, ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তুমি দেখবে শহীদদের মধ্যে বরকত, সালাম, রফিকের পর শফিউরের নাম সেভাবে আসে না কিংবা যে রিকশাচালক মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁর কথা আসে না। আবার আমরা যখনই শহীদ শিক্ষকদের কথা বলি তখন মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী—এই নামগুলো অনেক বেশি আসে। কিন্তু আবুল খায়ের কিংবা ফয়জুল মহী স্যারদের নাম তেমন আসে না। এ নিয়ে আমার একটা ব্যাখ্যা আছে। তা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মন ও হূদয় শত শহীদকে একসঙ্গে ধারণ করতে পারে না। এটা আমাদের অক্ষমতা। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা কয়েকজন শহীদকে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করি।

শামীম আজাদ: বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে অনেকেই গণমাধ্যমে অনেক বেশি সুপরিচিত ছিলেন।

সেলিম জাহান: তা তো নিশ্চয়ই। তবে তাঁদের আমরা যখন স্মরণ করি তখন কিন্তু অন্য শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র কমতি থাকে না। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তালিকা আমি এজন্য তুলে ধরলাম, কারণ তাঁরা যেন আমাদের স্মৃতি থেকে  বিস্মৃত না হন।

শামীম আজাদ: মুনীর চৌধুরী স্যার বলতেন, কোনো নাটকের কয়েকটি চরিত্রের নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে বলে তোমরা দেখো এদের কথা বারবার বলা হচ্ছে, মনে হচ্ছে নাটকের মুখ্য চরিত্র তারা, তাদের দেখে তোমরা নাটকটিকে চিহ্নিত করো। কিন্তু প্রধান চরিত্রগুলোর আশেপাশে যারা আছে, তারা কিন্তু এদেরকে মূর্ত করে তুলেছে।  

সেলিম জাহান: আমি কিন্তু খুব শিশুকালে মুনীর চৌধুরীর কোলে চড়েছিলাম আমার বাবার সূত্রে। মুনীর চৌধুরী ও আমার বাবা সহপাঠী ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করে তাঁরা একই স্টিমারে করে তাঁদের নতুন কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিলেন। আমার বাবা যাচ্ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজে আর মুনীর চৌধুরী যাচ্ছিলেন খুলনা ব্রজলাল কলেজে। খুব সম্ভবত ১৯৫৮ কিংবা ১৯৫৯ সালের কথা হবে। আমার বাবা আমাকে প্রথমবারের মতো ঢাকায় নিয়ে এলেন। আমার বয়স তখন আট-নয় বছর। তখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস ছিল জগন্নাথ হলে পুরনো যে ভবনটি, যেটা ভেঙে পড়েছে, ওটা। এটা একসময় প্রাদেশিক পরিষদের অফিস ছিল। পরীক্ষকদের ওখানে এসে খাতা নিতে হতো। বাবা ভেতরে ঢুকবেন কিন্তু শিশুপুত্রকে কোথায় রেখে যাবেন এ সময়! এমন সময় সেখানে এলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। পাঞ্জাবি পরিহিত। দুই বন্ধুর মধ্যে কথাবার্তা হলো। বাবা আমাকে মুনীর চৌধুরীর জিম্মায় রেখে ভেতরে গেছেন। আমার মনে আছে মুনীর চৌধুরী তাঁর বাঁ পায়ের ওপর আমাকে বসিয়ে আস্তে আস্তে দোলা দিচ্ছিলেন কিন্তু ডান হাতে তাঁর একটি বই। অন্য কিছু মনে নেই কিন্তু ওইটুকু বয়সে আমি অবাক হয়েছিলাম যে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না, একমনে বই পড়ছেন। আবার আমার প্রতি তাঁর মনোযোগও আছে। শামীম তুমি তো তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছ।

শামীম আজাদ: মুনীর স্যারকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া ভীষণ মধুর স্মৃতি এবং এগুলো কিন্তু অনেক অর্থে কখনো কখনো উপমাময়। শিক্ষকরা পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নীতি শিখিয়েছেন। আমরা যাতে দেশের প্রতি একনিষ্ঠ থাকি। মানবকল্যাণে কাজ করি। আমাদের মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হতে শিখিয়েছেন। আমরা বিখ্যাত শিক্ষকদের হারিয়েছি। যাঁরা বেঁচেছিলেন, তাঁরাও কিন্তু ওভাবে আমাদের জীবনকে আন্দোলিত করেছেন। বলতে গেলে তাঁরা আমাদের ধারণ করেছিলেন। মুনীর স্যারের পড়ানো, স্যারের কণ্ঠস্বর! যারা আমাদের বন্ধু, আমাদের সতীর্থ, তারা জানে স্যারের কণ্ঠস্বর ছিল কিছুটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে। ওই কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় এটি তো আবৃত্তি করার যোগ্য নয়, এটা তো নাটক করার মতো নয়। কিন্তু কী অসম্ভব আবেগ ধারণ করত তাঁর সেই কণ্ঠস্বর। তিনি পড়িয়ে যাচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনে হতো তিনি যখন টলস্টয় পড়াচ্ছেন, তখন যেন পিটার হয়ে যাচ্ছেন। যখন শরত্চন্দ্র পড়াচ্ছেন, তখন শ্রীকান্ত হয়ে যাচ্ছেন। অসাধারণ ছিল তাঁর পড়ানোর ভঙ্গি। কী ঋজু ভঙ্গি ছিল স্যারের। পাঞ্জাবি পরতেন সবসময়। খাদি কাপড়ের।

সেলিম জাহান: শেষের দিকে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটতেন, পিঠে একটা ব্যথা ছিল খুব। বাংলা বিভাগের বারান্দায় তাঁকে দেখা যেত। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছ থেকে গল্প শুনেছি। ১৯৫৪ সালে আনিসুজ্জামান স্যার তখন কলেজের ছাত্র। তাঁরা তখন একটা সাহিত্য সম্মেলনে গেছেন। তখন মুনীর চৌধুরী সবে জেলখানা থেকে বেরিয়েছেন। তিনি কবিতা আবৃত্তি করতে মঞ্চে উঠলেন। তিনি আবৃত্তি করছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটি। আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘সাধারণ মেয়ে কবিতার যে অসাধারণ আবৃত্তি হতে পারে তা মুনীর চৌধুরীর আবৃত্তি শুনে আমার মনে হয়েছে।’

শামীম আজাদ: তুমি তো আমার সঙ্গে গল্প করেছ যে স্যারের বক্তৃতা, আবৃত্তি শোনার পর কত চমত্কার চমত্কার মন্তব্য করেছে মানুষ। এবার আমরা তোমার অর্থনীতি বিভাগে যাই।

সেলিম জাহান: আমরা সবসময় রাশেদুল হাসান ও আনোয়ার পাশা নাম দুটো একসঙ্গে উচ্চারণ করি। দুজন দুই বিভাগের কিন্তু দুজনই পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন। ২৫ মার্চ তারা যে ভবনে থাকতেন, সেখানে হামলা হয়েছিল এবং রাশেদুল হাসান, আনোয়ার পাশা তাঁরা দুজনই পরিবারসহ খাটের নিচে লুকিয়ে সেদিন বেঁচেছিলেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, ২৫ মার্চের কালরাতে তাঁরা বেঁচে গেলেও চূড়ান্তভাবে ১৪ ডিসেম্বর কিন্তু তাঁরা বাঁচতে পারেননি এবং আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ লেখাটি সম্ভবত ওই সময়কালের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, ওই সময়ে লেখা।  

শামীম আজাদ: আমার ধারণা এটি সেই সময়কার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রথম উপন্যাস এবং তারপর তো স্যার শহীদ হলেন।  রাশেদুল হাসান স্যারের কথা যেটা বললে, স্যার সৌম্যকান্তি ছিলেন,  চুলগুলো পেছনের দিকে ব্যাকব্রাশ করতেন। খুব স্মার্ট ছিলেন স্যার। অনেক মিষ্টি করে পড়াতেন। ইংরেজি সাবসিডিয়ারি ছিল আমাদের। তখন দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পেছনে কতগুলো কক্ষ আছে না, সেখানে স্যার আমাদের ক্লাস নিতেন। রাশেদুল হাসান স্যারের জন্য খুব কষ্ট লাগে। একবার খাটের নিচে পালিয়ে তিনি বাঁচলেন। আবার এসে বাড়ি থেকে স্যার বলে ডেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই অবরুদ্ধকালে আমি আর বাবলি লিফলেট বিলি করতাম। লিফলেটগুলো ছিল জেরক্স করা। সবুজ রঙের কালি দিয়ে করা। নাম ছিল সোনার বাংলা। ওপরে একটা শাপলা আঁকা। আমরা লিফলেট বিতরণ করতাম ছাত্রছাত্রীরা যাতে ক্লাসে না আসে। কারণ স্যারদের ক্লাস করার জন্য মুচলেকা দিতে হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা ফেরদৌস, বাবু ওরা লিফলেটগুলো আমার কাছে দিয়ে যেত। আমি আর বাবলি একত্র হয়ে ওই সময়ে ওগুলো বিলি করতে যেতাম। আরো একটা জিনিস করতাম। যেমন বুলবুল একদিন আমাকে বলল, ‘আপা, অমুক স্যার লিস্টে আছেন। আপনি তাকে প্লিজ চলে যেতে বলেন।’ সব স্যারকেই বলেছি কিন্তু রাশেদুল হাসান স্যারকে যখন বললাম, স্যার হেসে আমাকে বললেন, ‘ওরে মেয়েরা তোমরা তো জানো না ওরা আমাদের খুব সম্মান করেছে, আমাদের স্যার বলে ডেকেছে, ওরা তো আমাদের ছাত্র, কোনো রকম কোনো অত্যাচার করেনি। ফেরত দিয়ে গেছে।’  

সেলিম জাহান: আমি এই প্রসঙ্গে বলি যে এই যে শেষ কথাটি শামীম বললে যে স্যার বলে ডেকে নিয়ে গেছে। মুনীর চৌধুরীকে তাঁর পিতৃনিবাস হাতিরপুলে এসে নিয়ে যায়। তিনি তখন স্নান করে বেরিয়েছেন। চুল ভেজা। খাবার খেতে বসবেন। তাঁর ছোট ভাই দরজা খুলেছেন এবং মুনীর চৌধুরীকেও স্যার বলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কথাটি আমি এই কারণে বলছি, যাঁরা সেদিন এসব শিক্ষককে স্যার বলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই আজ লন্ডন শহরে বসবাস করছে এবং তাদের অনেকে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এমন হয়েছে অবস্থা যে ঘাতকরা শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, ঘাতকরা অন্যদিক থেকে আঘাত করার জন্য বর্তমানে আবার যখন প্রস্তুত, তখন আমার মনে হয় আমাদের শহীদ শিক্ষকদের কথা, সে সময়কার কথা এবং তখন যা ঘটেছিল, সেগুলো আবার আমাদের মন-মানস চিন্তায় এবং কাজে আনতে হবে।

শামীম আজাদ: আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, আমরাই হচ্ছি তাঁদের জ্ঞাতি। আমরাই হচ্ছি তাঁদের চিহ্ন। মানুষ চলে গেলে পালক ফেলে যায়। তার জ্ঞাতিচিহ্ন দেখে দেখে পরশ বুলায়। আমাদের শিক্ষকরা আর নেই। আমরা তাঁদের সন্তান। তাঁরা আমাদের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তাঁদের হারিয়েছি, সে ঘটনা এভাবে চাপা পড়ে উল্টো স্রোতে বইতে শুরু করে কী করে?

সেলিম জাহান: একটা কথা আমার বিশেষ করে মনে হয়, আমার শিক্ষাগত জীবনে একটা বর্ষে আমি প্রায় পাঁচজন শহীদ বুদ্ধিজীবী শিক্ষকের সন্তানদের আমার শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়েছি। যেমন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর দুই পুত্র শোভন ও সুমনকে পেয়েছি। আমি ডাক্তার মর্তুজার কন্যা মিতিকে আমার শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়েছি। শহীদ সিরাজ উদ্দিন হোসেনের (সাংবাদিক) পুত্র তৌহিদ রেজা নূরকে পেয়েছি। শ্রেণীকক্ষে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না, কারণ তারা সব আমাদের শহীদ শিক্ষক, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান। কী ভীষণ কষ্টের!

শামীম আজাদ: সবচেয়ে বড় কথা হলো, দায় কি শুধু তাঁদের? আমরাও কি তাঁদের সন্তান নই। এতদিন পরে আমরা তাঁদের কথা বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পদার্পণ উপলক্ষে। স্বাধীনতার কতদিন হলো! আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে কেন সুরক্ষা করতে পারলাম না? কেন আমাদের নৈতিকতা এভাবে ঘুণে ধরল? কেন আমরা আমাদের বিকিয়ে দিলাম? আমি তো মনে করি, যেকোনো সময় নিষ্ঠাবান হয়ে আবার তা পুনরুদ্ধার করা যায়।

সেলিম জাহান: নিশ্চয়ই, এটা তো আমাদের দায়িত্ব যখন সিরাজুল ইসলাম খানের কন্যা মাহমুদা আমাকে লেখে এবং বলে যে আপনাকে দেখলে আমার সবসময় বাবার কথা মনে হয়, তখন তাঁর সেকথা অত্যন্ত মর্মে গিয়ে লাগে। আমাদের বন্ধু শ্রাবণী কিন্তু জি সি দেবকে কাছে থেকে দেখেছে। জি সি দেবের পুরো নাম গোবিন্দ চন্দ্র দেব। অনেকে মজা করে তাঁর নাম সংক্ষিপ্তভাবে গবা বলত। স্যারের সামনে কেউ গিয়ে  দাঁড়ালে তিনি একটু টেনে বলতেন, তুমি  কে....এএ.? তখন রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন আখতার ইমাম। জি সি দেব শামসুন্নাহার হলের মধ্য দিয়ে সোজা রোকেয়া হলে ঢুকে যেতেন। কেউ তাঁকে থামাত না। শ্রাবণী গল্প করেছে যে প্রায়ই তিনি মিসেস ইমামের কাছে খুব অনুযোগ করতেন, ‘মিসেস ইমাম, দেখুন তো সবাই কেন আমাকে গবা গবা বলে। আমি কি গবার মতো?’ একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে একদিন দর্শন বিভাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুব গল্প করছে। তিনি একবার দেখেছেন। পরে আবার বেরিয়ে দেখছেন তারা গল্প করছে। তখন তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছ, তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমরা আমার রুমে গিয়ে বসে গল্প করো।

শামীম আজাদ: কেমন শিক্ষকদের আমরা পেয়েছিলাম। স্যারদের মনটা কী রকম নরম ছিল। স্যারদের হারানোর পর আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত। স্যারদের চেহারা মনে হতো। এত বছর পরেও এসব কথা বলতে গেলে কষ্ট হয়। যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সে হত্যার প্রক্রিয়া কতটা বিভীষিকাময়। এই যে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী স্যার। তিনি এত নরম করে কথা বলতেন। মনে হয় না পেন্সিল শার্প করার জন্য যে ছুরি, ওটা ছাড়া জীবনে আর কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। সব মানুষ শিল্প ও সাহিত্যের নরম মানুষ। তাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছে অত্যন্ত নৃশংসভাবে। স্যার অত্যন্ত নরম করে আমাদের বানান শেখাতেন। উচ্চারণ ধরিয়ে দিতেন। তিনি শান্তিনিকেতন থেকে ফার্স্ট হয়েছিলেন। আমরা তাঁকে বলতাম মুখোজ্জ্বল চৌধুরী। বিদ্যাশিক্ষার পর্ব তো আছে, ব্যক্তিগতভাবে একেকজনের স্বভাবগুলো খুব মনে পড়ছে আজ।

সেলিম জাহান: আমি যে কথাটা বলছিলাম, তাঁরা সবাই হয়তো  আমাদের প্রত্যক্ষ শিক্ষক নন, তবু তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন। গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। আমার মনে আছে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি, সেখানে আমি ‘দরজা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। বিতর্ক শেষ হয়েছে। তারপর তিনি আমাকে ডেকে বললেন শব্দটা আসলে ‘দরজা’ না, শব্দটা হচ্ছে ‘দারওয়াজা’। কতদিন আগের ছোট্ট একটা কথা কিন্তু আজও আমার মনে আছে।

শামীম আজাদ: গিয়াস উদ্দিন স্যার কিন্তু অসম্ভব রূপবান ছিলেন। স্যারের মৃত্যুসংবাদ যখন পাই তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা ছোটাছুটি শুরু করছে কার কাছে গিয়ে কোথায় কাকে বলবে। তখন স্যারের বোনকে পাওয়া গেল। বোনের কাছ থেকে যাচাই করা হলো যে পাকিস্তানি সেনারা স্যারকেও হত্যা করেছে।

সেলিম জাহান: আমার পুরো ঘটনাটা মনে নেই। তবে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং আমার সরাসরি শিক্ষক ডক্টর এএনএম মনীরুজ্জামানকে একত্রে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছিল। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা বেঁচে ছিলেন। বাসন্তী গুহঠাকুরতা ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে রক্ষা করা যায়নি। সেখানে চিত্ত ও রাজকুমারী দেবী নামে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের ভাষ্যমতে, ওই মেডিকেল কলেজের পাশের প্রাঙ্গণে একটি গাছের নিচে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

শামীম আজাদ: কষ্টের ব্যাপার হলো, আমি মেঘনা গুহঠাকুরতার স্মৃতিচারণে পড়েছি এটা। স্যার সঙ্গে সঙ্গে মারা যাননি। কিন্তু তাঁকে দেখতে কেউ আসতে পারছিল না। তাঁদের কাজের সাহায্যকারী লোক লুকিয়ে-চুরিয়ে আসছে তাঁকে দেখতে। তাঁদের যখন গুলি করা হয়, সেই বীভত্স দৃশ্য! ফুলার রোডের কয়েকটি বাড়ির সিঁড়ি রক্তে রক্তাক্ত হয়ে আছে।

সেলিম জাহান: রফিকুল ইসলাম স্যারের ভাষ্যমতে, তাঁকে খুঁজতেও লোক এসেছিল। তখন ফুলার রোডে যাঁরা থাকতেন তাঁদের অনেকেই জানেন যে যারা গৃহহীন, তারা অনেকেই তাদের ছেলেপুলে নিয়ে ফুলার রোডের বাড়িগুলোর নিচতলায় রাতে থাকত। সেদিন ওই ভবনের নিচে থাকা মা ও তার দুই শিশুকে হত্যা করা হয়। আরেক দল যখন রফিকুল ইসলাম স্যারের খোঁজ করতে এল, তারা এসে রক্তের দাগ, মা এবং সন্তানদের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে মনে করে যে এই বাড়ির কাজ শেষ। তারা চলে যায়।

শামীম আজাদ: স্যারের ঘটনাটা অনেকটা আমাদের মনীরুজ্জামান স্যারের ঘটনার মতো। খুব নরম মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের ষষ্ঠ পত্র পড়াতেন। ছন্দ অলংকার পড়াতেন। তার স্ত্রী রাশিদা জামান আমাদের খুব প্রিয়। তিনি টেলিভিশনে ছোটদের অনুষ্ঠান করতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম, তখন দেখলাম আমাদের যে অবশিষ্ট স্যাররা বেঁচে আছেন, তাদের মুখ-চেহারা মলিন হয়ে গেছে। ক্লাস করতে আসছেন কিন্তু হারানোর বেদনায় তাঁরাও আহত। আমরাও শোকাহত। প্রথম ক্লাসে মুনিরুজ্জামান স্যার এলেন। স্যারকে দেখে আমরা অবাক। আমরা আঁতকে উঠলাম, কারণ আমরা কয়েকজন তখনো জানি না যে স্যার বেঁচে আছেন। স্যার বেঁচেছিলেন, কারণ তাঁকে খুঁজতে গিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের মুনিরুজ্জামান স্যারকে হত্যা করে এসেছে পাকিস্তানি সেনারা।

সেলিম জাহান: বাংলার মোহাম্মদ মুনীরুজ্জামানকে খুঁজতে গেছে কিন্তু বের হয়ে এলেন ডক্টর এএনএম মুনীরুজ্জামান। শ্মশ্রুমণ্ডিত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। তাঁর কপালে নামাজের দাগ। স্যার আমাদের সংখ্যাতত্ত্ব পড়াতেন। অত্যন্ত নরম মনের মানুষ ছিলেন। এখনো মনে আছে রিমলেস চশমা পরতেন। তিনি আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক। আরো দুজন আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক ছিলেন, যাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছিল শহীদুল্লাহ হলে; শরাফত আলী ও আতাউর রহমান খাদেম। তাঁরা গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা আমাদের পড়িয়েছেন। অধ্যাপক আতাউর রহমান খাদেম, অধ্যাপক শরাফত আলী, অধ্যাপক এএনএম মুনিরুজ্জামানের নামগুলো হয়তো অত উচ্চারিত হয় না। কিন্তু আমার মতো যাদের সংখ্যাতত্ত্ব ও গণিত ঐচ্ছিক বিষয় ছিল, তারা প্রত্যেকেই কিন্তু এদের ছাত্র ছিলাম।

শামীম আজাদ: আমার এখনো মনে আছে মুনীরুজ্জামান স্যার ক্লাসে ঢুকে বললেন, আমরা যাঁরা দৈবাত্ বেঁচে গেছি, তাঁদের মধ্যে আমি একজন। তখন তাকালাম তাঁর মুখের দিকে, মনে হলো এ কোন যুদ্ধে আমরা সব হারিয়েছি। এ তো একটা অন্যায় যুদ্ধ। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ। ধর্মের জন্য যুদ্ধ নয়, অধর্মের যুদ্ধ ধর্মের নাম করে।

সেলিম জাহান: অধর্মের যুদ্ধ এবং আমি সবসময় বলি, আমরা আমাদের শিক্ষকদের ঠিক চিনতে পারিনি। চিনতে পারিনি বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে আমরা তাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের দোসররা কিন্তু এসব শিক্ষককে চিনতে পেরেছিল। তাঁদের মেধাকে চিনতে পেরেছিল।

শামীম আজাদ: তারা ঠিকই চিনতে পেরেছিল, তাই একেবারে রত্নগুলোকে উঠিয়ে নিয়ে গেল।

সেলিম জাহান: ভেবেছে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিতে হলে বাঙালি সংস্কৃতি, চেতনাকে শেষ করে দিতে হলে আমাদের যাঁরা স্বর্ণসন্তান তাঁদেরকে শেষ করে দিতে হবে এবং এই উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু ২৫ মার্চ,  ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে।

শামীম আজাদ: সেলিম, তুমি কিন্তু আমাকে ওই জায়গায় নিয়ে গেলে।  যে দ্বিজাতিতত্ত্বে পাকিস্তান হয়েছিল, শুধু ধর্মের কারণে যে বিভাজনটা হয়েছিল, সে বিভাজনের কারণে অনেক মানুষ তাদের মূল উপড়ে ফেলে এসেছে পূর্ব পাকিস্তানে। অনেক মানুষ চলে গেছে ভারতে। কিন্তু যারা যায়নি তারা তো এটা তাদের দেশ বলেই জানে। আর যারা ওখান থেকে এসেছিল, তারা ভেবেছিল এখানে আসলে হয়তো তারা নিরাপদ হবে। তাদের একজন আমাদের স্যার আনোয়ার পাশা। সাতচল্লিশে তিনি তাঁর পরিবারসহ বাংলাদেশে আসেন, সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল। মনে করেছিলেন মুসলমানদের জন্য এটা একটা অভয়াশ্রম হবে। কিন্তু মুসলমান হয়েও স্যার আপনার নিষ্কৃতি হলো না। আপনাকে খুন হতে হলো।

সেলিম জাহান: সম্ভবত আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখায় পড়ছি যে  রাশেদুল ইসলাম স্যার আর আনোয়ার পাশা এক অর্থে হরিহর আত্মা ছিলেন। জীবনের বহু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একসঙ্গে। এসেছেন যখন একই সঙ্গে এসেছেন। যে জীবন বাঁচানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে তাঁরা এলেন, শামীম তুমি যেটাকে অভয়াশ্রম বলছ, সেখানেই কিন্তু তাঁদের হত্যা করা হয়।

শামীম আজাদ: কূটো ভেবে সাপকে ধরেছিলেন। কী সাপ? ধর্ম সাপ। যে সাপ সত্যিকারের ধর্ম নয়, যে সাপ ধর্মের নাম করে আমাদের জীবনে অভিশাপ নিয়ে এসেছে। 

সেলিম জাহান: এটা একেবারে সত্যি কথা। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে বিষবৃক্ষ বপন করা হয়েছিল, তার ফলাফল শুভ হয়নি। শরাফত আলী স্যার, যাঁর কথা একটু আগে বলছিলাম, খুব স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন এবং তিনিও ছিলেন শ্মশ্রুমণ্ডিত। সময়মতো নামাজ পড়তেন। সময়মতো ধর্মকর্ম করেছেন। একদিন আমরা স্যারকে বললাম, স্যার আপনি এত কম কথা বলেন কেন? তখন স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘আমি তো গণিতের শিক্ষক, আমার আসলে দুটো শব্দই শুধু লাগে। Let এবং be। এ দুটো শব্দ দিয়ে আমি আমার গণিতের ক্লাস নিতে পারি। আর বেশি কিছু লাগে না।

শামীম আজাদ: তাঁরা তো শিক্ষক ছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রের সৈন্য নন।

সেলিম জাহান: কিন্তু যারা ঘাতক, তারা তো এসব শিক্ষককে জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করেছে। কারণ এসব শিক্ষকই চেতনা জাগিয়ে তুলবেন, মনন জাগিয়ে তুলবেন। মুনীর চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের পর কবর নাটক লিখেছিলেন। তখন তিনি জেলে। কবর নাটকের সংলাপ মুখে মুখে ফিরেছে মানুষের। নাট্যকারের জীবনে সেই সংলাপ কিন্তু নানাভাবে ফলে গেছে। একজন শিক্ষকের জীবনে একজন নাট্যকারের জীবনে যখন তাঁর লেখা নাটকের পরিণতি হয়, তখন তা খুব কষ্টদায়ক বিষয়।

শামীম আজাদ:  দীর্ঘশ্বাসে বুকটা ভারী হয়ে গেছে। সেলিম ধর্ম নিয়ে তোমার সুন্দর একটা ব্যাখ্যা আছে।  

সেলিম জাহান: ধর্মকে আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করি, সেটা হচ্ছে যে আমরা তো বহু জিনিস ধারণ করে থাকি, তার মধ্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস একটা বিষয় আছে, যেটা আমরা ধারণ করি। তাছাড়া আমরা সংস্কৃতি ধারণ করে থাকি, আমাদের পরিবেশ ধারণ করে থাকি, পিতা-মাতার কাছ থেকে আমরা যেসব মূল্যবোধ শিখেছি, সেগুলো ধারণ করে থাকি। আমি যেগুলো ধারণ করি, সেগুলো আমার অংশ। তেমনিভাবে বহু জিনিস আমাকে ধারণ করে আছে। আমার ভাষা আমাকে ধারণ করে আছে। আমার সমাজ আমাকে ধারণ করে আছে। আমার পরিবেশ আমাকে ধারণ করে আছে। আমার আত্মপরিচয় আমাকে ধারণ করে আছে। আমি মনে করি যে আমি যা ধারণ করে আছি এবং যেসব জিনিস আমাকে ধারণ করে আছে, তাদের সম্মিলিত ব্যাপারটি আমার ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করে।

শামীম আজাদ: এ অংশটা ভুলে গিয়ে কীভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ করছি এখন?

সেলিম জাহান: এ অংশটা ভুলে গিয়ে আমরা ধর্মের নামে, আনুষ্ঠানিকতার নামে বিশ্বাস থেকে সরে এসে নানা রকমভাবে কাজ করছি।

শামীম আজাদ: আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছ—৫০ বছর আগে আমাদের মধ্যে যে নীতিবোধ ছিল, এগুলো নিয়ে কেউ এখন প্রশ্ন তোলে না! অনেকে আমাকে বলে, শামীম আপা, আপনারা তো পিওর সময়ের মানুষ। আমাদের সময়ে কোনো বিদেশী পোশাক ছিল না। আমরা আমাদের মাথা এমন করে আরবি সংস্কৃতিতে মুড়ে ফেলেনি? কিন্তু আমাদের নীতি কোথায় কম ছিল বলো? পোশাক দিয়ে কি নীতি আনতে পারবে তুমি, যদি হূদয়ে নীতি না আনো?

সেলিম জাহান: যে শিক্ষকদের কথা আমরা বললাম, আমি তাঁদের ধর্ম বিশ্বাসের জায়গায় যাচ্ছি না, তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু তথাকথিত ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। ড. এএনএম মুনীরুজ্জামান, শরাফত আলী ও এ আর খাদিম—তাঁরা প্রত্যেকে শ্মশ্রুমণ্ডিত। আজকের দিনে তাঁদের দেখে আপনারা হয়তো মনে করতেন তাঁরা বোধহয় কোনো উপাসনালয় থেকে এসেছেন। অথবা এঁরা বোধহয় ধর্মান্ধ হবেন। তা কিন্তু নয়। তাঁরা একেবারেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন।

শামীম আজাদ: আমার বাবার কথা মনে পড়ছে। যখন কুমুদিনী কলেজে ভর্তি হলাম, রণদা প্রসাদ সাহাকে আমরা জ্যাঠামণি বলতাম। সেখানে সরস্বতী পূজা হতো। যখন মিলাদ হতো, আমি মিলাদ পড়াতাম। তখন ধর্মের লেবাসে ধর্মের নাম করে আমরা অন্যকে ঘৃণা করিনি।

সেলিম জাহান: এ প্রসঙ্গে আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটা কথা বলি। আপনি যদি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর চেহারা দেখেন, তাহলে বোঝা যাবে যে তিনি অত্যন্ত ধার্মিক পুরুষ। তিনি রীতিমতো ধর্মচর্চা করতেন অথচ যখন আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব এল তখন এই মানুষটিই কিন্তু তার প্রতিবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর যখন আঘাত এল, তিনি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তখন উদারপন্থী আন্দোলন এবং অনেক বামপন্থী প্রতিষ্ঠান তাঁকে সামনে রেখে আন্দোলন চালিয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি কথা আছে। তিনি বলেছেন, আমরা মুসলমান। আমরা কেউ কেউ হিন্দু কিন্তু তার চেয়েও বেশি সত্য আমরা বাঙালি।  

শামীম আজাদ: আমি প্রথমে বাঙালি, তার পরে মুসলমান।

সেলিম জাহান:  আমরা তখন যারা পড়াশোনা করেছি, আমরা মুক্ত মন নিয়ে গড়ে উঠেছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ করেছি এবং সে বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু বিশ্বের বিদ্যালয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যা আমাদের একটি বিশ্ববীক্ষণ ও একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তবুদ্ধির, মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র। কাজী আবদুল ওদুদ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৩০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুক্তবুদ্ধি চিন্তার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে যে আমরা এসেছি, আমাদের পড়াশোনা, আমাদের জ্ঞান—এগুলো আমরা পেয়েছি আমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে।

শামীম আজাদ: আমাদের পরের প্রজন্মের যারা তারা শুধু বারবার প্রশ্ন করে, আপা আপনারা তো ভালো ভালো শিক্ষক পেয়েছিলেন। ঘটনাটা তোমরা তলিয়ে দেখো। যদি তাই মনে করো তাহলে সে সময়, সে মানুষদের অনুসরণ করো। যদি তাই মনে করে থাকো তাহলে আমরা যে পরিবেশের মধ্য দিয়ে এসেছি, সে পরিবেশ ফিরিয়ে আনো।

সেলিম জাহান: বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কিন্তু ফিরিয়ে আনতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের, আমাদের সবার প্রতি একটা দাবি আছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের সন্তানরা আমাদের গর্ব। আজ আমরা আমাদের শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ করলাম। এটা কিন্তু শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং এটা বোঝানো যে কী মূল্যবোধ, কী চেতনা তাঁরা ধারণ করতেন এবং সেগুলো কীভাবে আমাদের শিখিয়েছেন। আমি মনে করি যে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বিশেষ দিন পালন কিংবা তাঁদের জন্মদিনে কিছু বলা কিংবা তাঁদের স্মৃতিচারণ যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে নীতি, যে মূল্যবোধ তাঁরা ধারণ করেছেন এবং যার জন্য তাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, সেগুলোকে আমাদের হূদয়ে ধারণ করা। আমাদের সমাজে আমাদের দেশে সেগুলো প্রতিষ্ঠা করা। এটা যদি করা যায়, আমার মনে হয় সেটাই হবে তাঁদের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা প্রদর্শন।  

শামীম আজাদ: কত সুন্দর করে তুমি বললে অর্থাত্ যে বাংলাদেশ তাঁরা চেয়েছিলেন, আমাদের সন্তানদের প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা—তোমরা তা-ই করো।

সেলিম জাহান: শামীমের নিজের একটি কবিতা আছে ‘আশ্চর্য মেঘদল’ নামে। তার বই ‘দেহখাঁজ খঞ্জরে’ এটা প্রকাশিত  হয়েছিল। আমাদের শিক্ষক, আমাদের বন্ধুবান্ধব, এসব বিষয়ের ওপর কবিতাটি লেখা। দীর্ঘ কবিতা। এখানে কিছু অংশ তুলে ধরছি—

আগুনের গন্ধে উঠে দেখি আমার গাঁ পুড়ে যাচ্ছে
একাত্তর ২৬ মার্চ!
হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেছে শহীদ মিনার,
শরীফের চা বিষ হয়ে গেছে,
পাঠাগার পীঠস্থান নির্বাক,
আর নির্মলেন্দু গুণ, শ্রাবণীদের জানালা ও শেলীর জোয়াল
সবই পড়বার অপেক্ষায়।
দিকদর্শন জি সি দেব ও গুহঠাকুরতা দাঁড়ানো সেখানে।

তারপর খই রঙা হাঁসগুলো বধ করে নিয়ে গেলো তারা
শবদেহ শহরে, গ্রামে, ধানমন্ডি ও রাজারবাগে।
উড়ন্ত ইস্পাত ব্লেডে ফালি ফালি আমি আর তুই
বকুলরা আগরতলায় 
আমাদের যে গুটিকয়েক লটকে ছিলাম ছাদে, রোকেয়া হলে
তাদের আত্মাহুতি হলো।
তিনদিন তিনরকম
বারুদে বারুদে
বর্জ্যের ভেতরে।

অতঃপর আমাদেরই দেহ পলি আর নূরে
পারদে পারদে
সহপাঠী শাহরিয়ার ও নজরুলের সহযাত্রী হয়ে
ক্ষত্রীয় মৃত্যুতে
ইঞ্চি ইঞ্চি করে ইচ্ছেভূমি গজালো।
ব্যাপক বদ্ধভূমির বালি ভেঙ্গে
উঠে এলো সেই প্রবল পূর্ণিমা।

বাবলি,
এভাবেই কি প্রাচীন গর্তে পড়ে
পৃথিবীর প্রথম অঙ্গার মেখেছিল?
মেঘ দেখে ডাহুকের গ্রাম ডুকরে
কেঁদে উঠেছিল?
জানিস, কি তুই
কতটা ক্ষত খুললে পড়ে সুতো ছিঁড়ে পাল উঠে দাঁড়ায়?
কত বছর দুঃস্বপ্নের গুঁড়ো গেড়ে দিলে মেট্রোর মিলানে পৌঁছানো যায়?
রক্ত কুয়ো আরো কতটা গভীর হলে
তবে আমারে শহীদ শিক্ষক পিতাদের লাশ দেখা যায়?
সই, আর কতো সহস্র শাহাবাগ হলে জননী জাহানারা জরায়ুর দাগ মোছা যায়?

কবে আবার বাংলা একাডেমি বটমূলে বইবেলার অক্ষর নদে
জাহাঙ্গীর আর আলী ইমাম সকাশে
নড়েচড়ে উঠবো সে আগুনের মনে
স্রোতস্বতী স্মৃতি ধরে পুনরায় সেই উঁচুুতে
রহস্যময় মানুষ ও চলিষ্ণু মেঘের সাথে
মানবতা হরণকারীদের চির বিনাশের পরে
দুর্বহ বেদনা ভারে সই
ওই ফেটে যাওয়া ঢাকার ফাগুনে। 

সেলিম জাহান: সেই আরেক ফাগুনের কথা জহির রায়হান বলেছিলেন। সেই ফাগুনের কথা শামীমও বলল। আবার আমরা ফিরে যাব। শুধু ঢাকায় নয়, বইমেলায় নয়। আমরা ফিরে যাব সেই বোধের কাছে। আমরা ফিরে যাব সেই চেতনার কাছে। আমরা ফিরে যাব আমাদের শিক্ষকদের স্মৃতির কাছে। সেখান থেকেই আমাদের শক্তি নিতে হবে। সেখান থেকেই আবার নতুন করে আমাদের পথযাত্রা শুরু হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন