আরোরার খোঁজে ল্যাপল্যান্ডে

রাশেদুর রহমান রাশিব

হাজার হ্রদের দেশ নামে ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে যে দেশটির নাম শিখেছিলাম সেই দেশেই কিনা পড়াশোনার সুবাদে দেখার ও থাকার সুযোগ হয়েছিল। অপূর্ব সুন্দর একটা দেশ ফিনল্যান্ডে। মাত্র ৫৫ লাখ মানুষের এই দেশে ভৌগলিক অবস্থান পৃথিবীর উত্তর মেরুর খুব কাছাকাছি। শীতের সময় পড়ে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, আর সামারে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই সূর্যিমামা আকাশে থাকেন। উত্তর মেরুর কাছাকাছি বলে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত আকাশে নীলাভ সবুজ মেরুজ্যোতি বা অরোরা বরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস দেখা যায়। ফিনল্যান্ড যাওয়ার আগে থেকেই এই আরোরা বা মেরুজ্যোতি দেখার এক দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে তারা করে বেড়াতো। উত্তর মেরুর হীম শিতল ঠান্ডায় এস্কিমো বা সামী গোত্রের শিশুরা সবুজাভ আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যেরকম অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হতো, ঠিক তাদের মতো একবার এই দুচোখকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে অন্ধ করে দিতে চাই।   

কিন্তু চাইলেই কি অত সহজে সব পাওয়া যায়, বাংলাদেশের তুলনায় পাঁচ গুণ বড় এই দেশেটির নিচের দিকে আমার আস্তানা করতে হল। ফিনল্যান্ডের যে শহরে আমি মাস্টার্স করতে গিয়েছি, তার নাম তুরকু। বাল্টিক সাগরের তীরে এই শহরটি ছিল ফিনল্যান্ডের আগের রাজধানী। মানচিত্রের একদম নিচের দিকে বলে আমার শহর থেকে অরোরা দেখার সুযোগ খুব কম। তবুও তুরকুতেই প্রথম অরোরার দেখা পাই, নভেম্বরের মাঝামাঝি দিকে। একদিন আমাদের ডর্মের কিচেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশ কিছুটা সবুজাভ হয়ে আছে, দৌড়ে বাইরে এসে বুঝতে পারলাম আজ আকাশে আরোরা দেখা যাবে। শহরের লাইট এর জন্য ভাল দেখা যাচ্ছে না। কিছুদূর হেঁটে এসে আউরা নদীর পাশ থেকে দেখার চেষ্টা করলাম আকাশের সেই অপূর্ব রঙের খেলা, যদিও খুব মৃদু ভাবে দেখা যায়। যাই হোক এই ছিল প্রথম অরোরা দেখার অভিজ্ঞতা। এর পরেও বেশ কয়েকবার আমার শহর থেকে অরোরা দেখার সুযোগ হয়েছে কিন্তু মন ভরেনি। মোবাইলে অরোরা এলার্ট নামে একটা অ্যাপস নামিয়ে নিলাম, কিন্তু মন ভরে অরোরা দেখার শখ যে মনে রয়ে গেল। পরিষ্কার আকাশে আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে দেখার সুযোগ হয়ে ছিল আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেইন্টমার্টিনে গিয়ে। রাতে সৈকতে হাঁটতে বেড়িয়েই দেখি আকাশে লাখ লাখ, কোটি কোটি তারা। এত তারা একসাথে জীবনের প্রথমবার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম মিল্কিওয়েটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের শান্ত পানিতে তারাদের প্রতিবিম্ব আর দ্বীপের নির্জনতা ভেঙ্গে ঢেউয়ের আছড়ে পরার একটানা মায়াবী শব্দ যেন এক অপার্থিব জগতের সৃষ্টি করেছে। 

ছবি: লেখক

পৃথিবীর দুই মেরুর চৌম্বকক্ষেত্র আর সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা কণার আয়নাইজেশন ফলে কণা থেকে বিভিন্ন রঙের বিচ্ছুরণই সহজভাবে বলতে গেলে মেরুজ্যোতি বা অরোরা বরিয়ালিস। আমাদের দেশে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে হাজারো কুসংস্কার বিদ্যমান, জানি না অরোরা নিয়ে এস্কিমো বা সামি গোত্রের মাঝে কী মিথ প্রচলিত আছে। হয়ত গোত্রের সবাই মিলে আগুনের পাশে বসে সবুজাভ আকাশের নিচে বসে তারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে নিজেদের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে বিভিন্ন রূপকথা বা উপকথায় মেতে উঠত। দিনে দিনে অনেক সময় পেড়িয়ে গেলেও আমার আর সময় মিলে না উত্তরের ডাকে সাড়া দেয়ার। এদিকে এমন অবস্থা অল্প কিছু দিনের মাঝে আমার ডিগ্রিও শেষ হয়ে যাবে। একদিন রাতে দেখি রোভানিয়ামি শহরে থাকা জসিম ভাই অরোরার একটা ছবি আপলোড দিয়েছেন। পুরোনা ক্ষতে যেন লবণ মরিচের মিশ্রণ পড়ল। সাথে সাথে মেসেঞ্জারে জসিম ভাইকে নক দিলাম, লাপল্যান্ডে আসার আগ্রহ প্রকাশ করলাম এবং কাছেপিঠে কোথাও সস্তায় যদি মাথা গোজার ঠাই খুঁজে দেন, সে আর্জি জানালাম। তিনি সানন্দে তার নিবাসে আশ্রয় দেয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। যদিও কেউ সঙ্গী হবে না আগেই জানতাম, তবুও সবাইকে অরোরার আলোয় স্নান করার লোভ দেখালাম। এক বন্ধুর কাছ থেকে ভারী জ্যাকেট নিয়ে নিলাম, যদিও শেষতক জ্যাকেটটি আর নিয়ে যাইনি। বিশাল লম্বা এক ভ্রমণ তুরকু থেকে লাপল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর রোভানিয়ামিতে। জানুয়ারি মাস অরোরা দেখার সময় না, তাই ভাগ্যদেবীর উপর ভরসা করে যাত্রা শুরু করলাম।

ফিনল্যান্ডে কম খরচে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াত করতে অন্নি বাস বেশ জনপ্রিয়, তাই আমার পছন্দের তালিকাতেও অন্নি বাস। তুষার ঝরা রাতে আমি প্রায় খালি বাসের দোতালায় বসে সোডিয়াম বাতির রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ফেলে আসা দিনগুলির কথা। মানুষ আসলে কোথায় বাস করে, হয় তার স্মৃতিতে কিংবা তার ভবিষ্যত স্বপ্নের মাঝে।  যার স্বপ্ন নাই সে কত দুর্ভাগা, নতুনের আনন্দ যার মাঝে  হিল্লোল দেয় না, সে কি নিঃসঙ্গ। 

ছবি: লেখক

খুব ভোরে চোখ খুলে দেখি চারিদিকে ধবধবে সাদা বরফের দুনিয়ায় চলে এসেছি। দুপাশের গাছ গুলো বরফে ঢেকে আছে। বাস পরিবর্তন করে লোকাল একটা বাসে করে যখন রোভানিয়ামি শহরে নামলাম, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মাঝে একটু আলোর ঝলক দেখা দিল। জসিম ভাই তার গাড়ি নিয়ে চলে আসলেন দেখা করতে, ভাইয়ার সাথে প্রথম দেখা অথচ মনে হচ্ছে কত দিন ধরে আমাদের পরিচয়। অপরিচিত এই শহরে তিনিই আমার আত্নার আত্নীয়। আমাকে সান্তাক্লসের গ্রামে যাবার পথ বলে দিয়ে কাজে চলে গেলেন এবং বিকেলে সেখান থেকে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন বললেন। সেই সান্তাক্লসের গ্রামের সেই গল্প বলব আরেক দিন। বিকেলে ভাইয়ার বাসায় গেলাম, রাতে রান্না হবে রেইন ডিয়ারের মাংস। এখানে ফার্মে যেসব রেইন ডিয়ার পালন করা হয়, সুপার শপে তার মাংস পাওয়া যায়। রাতে আমার হাতেই ভাইয়া রেইন ডিয়ারের মাংস রান্না করার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। অনেক সময় নিয়ে রান্না করলাম। রাতে খেতে গিয়ে ভাইয়ার প্রশংসায় বুঝতে পারলাম গত দু বছরে বেশ ভালই রান্না শিখেছি। রান্নার পুরো বিষয়টাই আসলে যত্নের। কেউ যত্ন করে রান্না করলে কখনোই তার রান্না খারাপ হতে পারে না। ছোটবেলায় আমার খালার হাতের গরুর মাংস রান্নার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। খাবার সময় ভাইয়ার সাথে অনেক গল্প হলো। এই ছোট শহরে বাঙালিদের উদযাপনের গল্প, হাসি আনন্দের অনেক গল্প বললেন জসিম ভাই। রাত প্রায় ১১টা বাজে ভাইয়াকে বললাম আজ রাতে আকাশের কী অবস্থা, সন্ধ্যা থেকেই আমি অ্যাপস চেক করছি। আজ কেপির মান বেশ কম, আকাশে অরোরা দেখা পাওয়ার সম্ভবনা কম। ভাইয়া বললেন, চলো বের হই। আহ মনে থেকে যেন পাথর নেমে গেল। মোবাইলে দেখলাম বাইরে মাইনাস ষোল ডিগ্রি তাপমাত্রা। আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ভাইয়ার গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসলেন মোটামুটি বেশ দূরের একটা লেকের পাশে। শহর থেকে অনেক দূরে এই লেক, আর চারপাশে লাইট নেই বলে বেশ দারুণ লাগছিল। আমরা যেখানে এসে থামলাম সেখানে আগে থেকেই একটা গাড়ি পার্ক করা ছিল। বাইরে এসে দেখলাম বেশ একটা  সবুজাভ হয়ে আছে আকাশের একটা দিক। কিন্তু আকাশে কোটি কোটি তারা। এ যেন তারার সমুদ্র। যে আশা নিয়ে এত দূরে এলাম তা বোধহয় আর পূরণ হল না। জসিম ভাইকে বললাম আমার হতাশার কথা । উনি বললেন অপেক্ষা কর, কেবল তো শুরু, দেখবে আকাশ কীভাবে চেঞ্জ হয়ে যায়। আমরা ক্যামেরা ট্রাইপড সেট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, এদিকে জমাট বাঁধা বরফের লেকের হু হু করা ঠান্ডা বাতাস আমার হাঁড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। গ্লাভসের ভেতরে আঙ্গুল গুলো জমে যাচ্ছিল। এমন তীব্র বাতাস আমার জ্যাকেটে আর কুলোচ্ছিলো না। আমি ভাইয়াকে বললাম আমি জমে যাচ্ছি দয়াকরে গাড়ির ভেতরে খানিকক্ষণ গরম হওয়ার সুযোগ দেন। উনি আমার অবস্থা দেখে ক্যামেরা ট্রাইপডে রেখেই গাড়ির কাছে চলে আসলেন। ফটোগ্রাফির প্রতি জসিম ভাইয়ের আকর্ষণ তো আগেই জানা, আমাকে গাড়িতে রেখেই তিনি চলে গেলেন তার ক্যামেরার কাছে। এদিকে ঠান্ডায় আমার মোবাইল গেছে বন্ধ হয়ে। খানিক বাদে মোবাইল অন করে দেখি আরোরা অ্যাপসে নোটিফিকেশন দেখাচ্ছে । গাড়ি থেকে অবশ্য আকাশ দেখার উপায় নেই। জসিম ভাইও ফিরে আসছেন না, দেখে আমি বেড়িয়ে লেকের ধারে গিয়ে যা দেখলাম তা আজও চোখে ভাসে। পুরো আকাশ সবুজাভ হয়ে গিয়েছে, কী দারুণ প্রকৃতির সৃষ্টি। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম আকাশের দিকে। কত দিনের স্বপ্ন এই সবুজাভ আরোরার আকাশ। দৌড়ে গিয়ে গাড়ী থেকে আমার ক্যামেরাটা নিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম এক্সপোজার ঠিক করে এই ঠান্ডার মাঝে ছবি তুলে ফেলা সহজ কর্ম হবে না। জসিম ভাই বললেন আরে মিয়া সামনে গিয়ে দাড়াও । ঝটপট কয়েকটা লং এক্সপোজার নিয়ে নিলেন। আকাশে তখনো রঙের খেলা চলছে, ভেসে যাচ্ছে পালতোলা রঙের নৌকা। শরতের আকাশে যেমন সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যায়, আজকের আকাশ ঠিক তেমন মনে হচ্ছে ।কিন্তু অন্ধকার আকাশের বুকে এই স্বপ্নীল রঙ্গের মেলায় অনেক দিনের দেখা স্বপ্ন যেন পূরণ হল। ঠান্ডার মাত্রা যেন আরো বেড়ে চলছে। ল্যাপল্যান্ডের নাম না জানা বরফ জমাট লেকের সামনে দাঁড়িয়ে আরোরা দেখার স্বপ্ন পূরণ যেন অপূর্ব এই পৃথিবীর বুকে আরো কিছুদিন হেঁটে বেড়াবার ইচ্ছাটাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। গাড়ি নিয়ে ফিরে চললাম শহরের দিকে, কিন্তু আবারো কোন এক দিন অবারিত আকাশের বুকে বিস্ময়ে বাড়িয়ে দেব এই অবাক দুটি চোখ।

লেখক: লেকচারার, ফার্মেসি বিভাগ
প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি

ছবি: রাশেদুর রহমান রাশিব ও জসিম সরকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন