নিউজিল্যান্ডের লকডাউন

সবকিছু স্বাভাবিক, কিন্তু এখন আর নয়

শিলো কিনো

আপনার উদ্বেগ আরো বেড়ে যাবে যখন আপনি ৬০ বছর বয়সী একগুঁয়ে অসুস্থ বাবার সঙ্গে বসবাস করবেন। সেই সঙ্গে এবার একটি ভাইরাস যুক্ত করুন এবং আপনার উদ্বেগ তখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

১৫ বছর বয়স থেকেই কঠোর পরিশ্রম করছি, আমার বাবা লকডাউনে বুধবার সকালে কাজ করতে যাওয়ার সময় বলছিলেন। আমি বললাম, আমি জানি বাবা। তোমার এটা আর প্রমাণ করতে হবে না। কেবল বাসায় থাকো।

কিন্তু কোনো কারণে মনে করেন ওনার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। তাকে ভোর ৪টায় উঠতে হবে কাজে যাওয়ার জন্য এবং সম্মানের চিহ্ন হিসেবে ১২ ঘণ্টা কাজ করবেন এবং পৃথিবীকে ঘোষণা দিয়ে জানাবেন তিনি মোটেই অলস নন।

চতুর্থ স্তরের লকডাউনের সময় এপ্রিলে আমার বাবা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জিনিসপত্র ঠিক করার জন্য খোঁজাখুঁজি করতে। আমি বুঝি আমার বাবার পরিচয় তার কাজ দ্বারা চিহ্নিত হয় এবং এখনো তার হাতে কাজ থাকায় তিনি ব্যাপকভাবে কৃতজ্ঞ। তবে লকডাউন তাকে একধরনের শূন্যতার ভেতর ফেলে দিয়েছে, যা তিনি আগে কখনো অনুভব করেননি।

বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন যখন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ . অ্যাশলে ব্লুমফিল্ড মঙ্গলবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে নতুন ঘোষণা দিতে আসেন। ওই সময় তাদের টিভিতে দেখা কিছুটা অদ্ভুত সুরিয়্যালও ছিল।

কিয়া ওরা কাউটো কাটোয়া যখন আপনি এই তিনটি শব্দ প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনবেন, আপনি জানবেন যে বড় কিছু হতে যাচ্ছে। শেষবার আমি যখন আর্ডার্ন এবং ব্লুমফিল্ডকে টিভিতে লাইভ দেখেছিলাম তখন চার স্তরের লকডাউন চলছিল। নিউজিল্যান্ডের অন্যসব মানুষের মতো প্রতিদিনকার ব্রিফিংয়ের সময় সব কাজ বন্ধ করে রাখা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আজ কেসের সংখ্যা কত? কতদিন আমাদের আর লকডাউনে থাকতে হবে? রেস্টুরেন্ট আবার কখন খুলবে? আমরা তার কথার প্রতিটি শব্দ বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনতাম এবং আমার বাবা প্রায়ই বলেন, সে খুব ভালো।

আমি বলতাম, হ্যাঁ, সে ভালো। এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রশ্ন নিতে পছন্দ করব এবং তখন আমার বাবা যেসব সাংবাদিক প্রশ্ন করত তাদের ওপর চিত্কার করে বলতেন, সত্যিকারের একটি কাজ নাও। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, হ্যাঁ। তার মনে পড়ে যে আমিও সাংবাদিক ছিলাম।

এর আগে একই দিন তৃতীয় স্তরের লকডাউন ঘোষণা করা হয়, সেদিন সকালে আমি গিয়েছিল এফ৪৫ ক্লাসে। যখানে আমি প্রচণ্ডভাবে ঘামছিলাম এবং এরপর এগিয়ে গিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে হাই-ফাইভ করলাম, তারাও বেশ ঘামার্ত ছিল। এর তিন ঘণ্টা পর আমার একটি লাঞ্চ ডেট ছিল, যেখনে আমি আমার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম এবং চুমু খেয়েছিলাম। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল এবং তারপর কিছুই আর স্বাভাবিক থাকল না।

এমন না যে আমি ভাইরাসের ব্যাপারটি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সংখ্যার যে গ্রাফ এবং পরিসংখ্যান বাইরে থেকে আসছিল তা বেশ নৈর্ব্যক্তিক দেখাচ্ছিল। আমেরিকা বেশ দূরের জায়গা, ট্রাম্প অনেকটা কাল্পনিক কার্টুন চরিত্র যাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিইনি। তাই যখন আমি আন্তর্জাতিক খবর দেখতাম এটা অনেকটা ছিল ভয়ংকর সিনেমার মতো। যেখানে আমি ভাবতাম, ওহ এটা খুব দুঃখজনক এবং তারপর তাত্ক্ষণিক ভাবতাম রাতের ডিনারে কী খাব তা নিয়ে।

অকল্যান্ডে তিন স্তরের লকডাউন নতুন ভিন্ন ধরনের ভয় নিয়ে হাজির হলো। কভিড-১৯ কে পরাজিত করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ছিল বাকি বিশ্বের জন্য উদাহরণস্বরূপ। এজন্য আমাদের হূদয় গর্বে ভরে গিয়েছিল।

আর্ডার্ন প্রায়ই তার সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন সদয় হোন এই উপদেশ দিয়ে। কিন্তু এবার যেন তিনি ভাষা হারিয়ে ফেললেন। ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে সোস্যাল মিডিয়া শোরগোলের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেন কে সবচেয়ে বেশি জোরে চিত্কার করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। লোকেরা সুপারমার্কেটের বাইরে দাঁড়ানো ছবি আপলোড করতে লাগল প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য। লোকেরা আনন্দের সঙ্গে এই টোপটি গ্রহণ করল, কেউ একজন পোস্টের নিচে লিখল, আমি নিউজিল্যান্ডার হওয়ার জন্য লজ্জিত। কত দ্রুতই না মানুষ বদলে যেতে পারে।

লকডাউনের প্রাক্কালে আমি আইসক্রিমের বাটি হাতে বসে বসে ভাবছিলাম, অল্প সময়ে জীবন কত দ্রুত বদলে যেতে পারে তা নিয়ে। সে সময় আমার বাবার প্রতি দায়িত্বও বদলে গিয়েছিল। যেখানে তাকে আমার যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হতো। বাজে কিছু এড়াতে তাকে আমার বাইরে যাওয়া থেকে আটকাতে হচ্ছিল। এমনকি আমি প্রধানমন্ত্রীকে মেইল করে বলতে চাইছিলাম, তিনি যেন আমার বাবাকে ফোন করে ঘরে থাকতে বলেন।

উদ্বেগ ভয়ের অনুভূতি সবার আলাদা এবং এটা যা করে তা হলো হতাশা মরিয়া ভাবকে আড়াল করে। নিজেদের প্রিয়জনদের যত্ন নেয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তাদের সামনে রাখা একা না থাকার মরিয়া অনুভূতি। আমার উদ্বেগ হচ্ছে ফ্রিজের কাছে গিয়ে আরেক বাটি আইসক্রিম খাওয়ার মতো। আমার বাবার উদ্বেগ হচ্ছে বারান্দায় একটা চেয়ার ঠিক করার মতো, যার কোনো প্রয়োজন নেই। কারো কারো উদ্বেগ হচ্ছে সুপারমার্কেটে যাওয়া শুকনো বাজার মজুদ করার মতো। সদয় হওয়া আসলে তোমার ইনস্টাগ্রামে বায়ো লেখার চেয়ে বেশি কিছু। এটি মানুষকে সন্দেহ দূূর করতে সাহায্য করে এবং মানুষের ভয়ের পেছনের কারণ ফেসবুকে রাগ করে কিছু পোস্ট করার পেছনের কারণ জানতে সাহায্য করে।

দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন