বাংলাদেশের শিল্পকলার উজ্জ্বল এক নক্ষত্র মুর্তজা বশীর। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গতকাল পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন কিংবদন্তি এ শিল্পী। গতকাল সকাল ৯টা ১০ মিনিটে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। শিল্পীদের মতে, তার চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন অগ্রভাগে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ওপর ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামে ১৯৫২ সালে তিনি লিনোকোটে চিত্রটি আঁকেন। এশিয়াটিক সোসাইটির মতে, ‘রক্তাক্ত ২১শে’-কে ভাষা আন্দোলনের ওপর আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাংলাদেশে চারু ও কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে ‘স্বাধীনতা’ মিছিলে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
‘দেয়াল’,
‘শহীদ শিরোনাম’,
‘কালেমা তাইয়্যেবা’,
‘পাখা’
শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’
নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এছাড়া ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। চিত্রকলায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক ও ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন মুর্তজা বশীর। তিনি ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়াঁ’র কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ূন কবীর রচিত ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কহু’র শিল্প নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুর্তজা বশীর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘কাঁচের পাখির গান’, ‘গল্প সমগ্র’। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ‘সাদায় এলিজি’। উপন্যাস ‘আল্ট্রামেরিন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’, ‘অমিত্রাক্ষর’। নির্বাচিত রচনার মধ্যে রয়েছে ‘মূর্ত ও বিমূর্ত’, ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’। ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তত্কালীন সমাজ’ শিল্পীর গবেষণাগ্রন্থ। এছাড়া ভারতের বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্নাল অব দ্য নিউম্যাসটেকি সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’য় প্রাক-মোগল যুগের মুদ্রার ওপর তার বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কিংবদন্তি শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রয়াণে তাকে নিয়ে স্মতিচারণ করেছেন তার ঘনিষ্ঠ ও প্রিয়ভাজনরা।
তার মৃত্যু আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি
অলক রায়, অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), চারুকলা
বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমি মুর্তজা বশীরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার সঙ্গে মিশলে বোঝা যেত তার ছিল শিশুর মতো মন। অসম্ভব অভিমানী মানুষ ছিলেন। খুব ভালো গল্প করতেন। তার ছিল বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ। তিনি ইতালিতে ছিলেন। প্রথম দিকে কিউবিক ধারায় কাজ করতেন। রেখাভিত্তিক ছিল তার ফিগারগুলো। পরের দিকে তিনি বিমূর্ত কাজ করা শুরু করেন। তবে ঠিক বিমূর্তও বলা যায় না। মানুষ নেই এমন কাজ করেছেন। যেসব দেয়ালের পলেস্তারা খসে গিয়েছে সেসব দেখে তিনি কিছু কাজ করেছেন। দেয়াল সিরিজ করেছেন। এটা খুব ব্যতিক্রম কাজ। তিনি বলতেন, ‘আমি মন থেকে ছবি আঁকতে পারি না, আমার কিছু দেখার দরকার হয়।’ তিনি পাথর দেখে কিছু ছবি আঁকেন এপিটাফ নামে। এগুলো তার খুব গুরত্বপূর্ণ কাজ। তিনি পরিণত বয়সে মারা গেলেন। তবু তার এ মৃত্যু আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।
তার চলে যাওয়ায় একটা অধ্যায় শেষ হলো
গৌতম চক্রবর্তী, শিল্পী ও গ্যালারি কায়ার পরিচালক
আমি তাকে খুব কাছ থেকে পেয়েছি। ২০০৪ সালে কায়া গ্যালারির শুরুর সময় তিনি ছিলেন। আমার প্রথম প্রদর্শনী ১৯৯২ সালে করি। তখনো তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি এর উদ্বোধন করেছেন। ২০০৪ সালের পর থেকে তার সঙ্গে প্রাত্যহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০০৭ সালে গ্যালারি কায়ায় তার প্রথম প্রদর্শনী করার সুযোগ পাই। তার পর থেকে তার সব প্রদর্শনী গ্যালারি কায়ায় করেছেন। প্রায় চারটা প্রদর্শনী। কাইয়ুম চৌধুরী, জাহাঙ্গীরসহ এ প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে মুর্তজা বশীরই ছিলেন শেষ। তার চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। আগামীকাল মুর্তজা বশীরের ৮৮ বছর বয়স হবে। তার আগেই তিনি চলে গেলেন। আমাকে সবসময় বলতেন, ‘আমি আমার মত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চাই।’ সেটা কাজের মধ্য দিয়ে। কাজের এক বিশাল ভাণ্ডার রেখে গেলেন তিনি।
জীবনের শুরুর দিকে তার খুব বিখ্যাত একটি কাজ ‘রক্তাক্ত ২১শে’। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে তিনিও ছিলেন। প্রতিবাদ শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক নয়। এর একটা সাংস্কৃতিক পটভূমি রয়েছে। তিনি মিছিলে ছিলেন, বুলেট তার শরীরেও লাগতে পারত। আমি বলব এই বোধ, এই চেতনা এটাই ছিল তার ড্রাইভিং ফোর্স। একটা একাত্তর সাল হওয়ার পেছনে অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের যে ওতপ্রোত সংযুক্তি এবং এ সংযুক্তির ভেতর দিয়ে তাদের যে মানসিক চারণভূমি—এ মনোজাগতটাও একটা বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে ছিল। আর এ বিষয়গুলোই তাদের ছবি, লেখা ইত্যাদিতে চলে এসেছে।
মুর্তজা বশীর শিল্পীদের জন্য উদাহরণ
ওয়াকিলুর রহমান, শিল্পী ও কলাকেন্দ্রের কিউরেটর
শিল্প ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মুর্তজা বশীর অন্যতম। তার ছবি আঁকার মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে অনেকগুলো সিরিজ আমরা দেখেছি। তিনি অত্যন্ত সামাজিক ছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি নিজেও সাহিত্যচর্চা করতেন। তার ভাবনা-চিন্তাগুলোর বহিঃপ্রকাশ লেখার মধ্যে পাওয়া যেত। প্রথম দিকে তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি উপন্যাস লিখেছেন। তিনি একজন আদর্শ শিল্পী, যাকে অনুসরণ করা যায়। তার অনেক শখ ছিল। যেমন তিনি বিভিন্ন দেশের কয়েন সংগ্রহ করতেন, ডাকটিকিট ছিল তার কাছে প্রচুর।
সব মিলিয়ে খুব বর্ণাঢ্য একটা জীবন ছিল তার, আর খুব গোছানো ছিলেন। তার সমস্ত চর্চা তিনি খুব সুনির্দিষ্ট করে গুছিয়ে রেখে গেছেন। তাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এগুলো নিয়ে কাজ করা, তাকে নিয়ে ভাবা অনেকখানি সহজ হবে। প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে মর্তুজা বশীর অন্যতম, যার কাছ থেকে বিভিন্নমুখী ও মানসম্পন্ন সব কাজ আমরা পেয়েছি। আমাদের শিল্পীদের জন্য তিনি একটা উদাহরণ।
মুর্তজা বশীরের কাজ যুগে যুগে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে
মলয় বালা, সহযোগী অধ্যাপক, প্রাচ্যকলা বিভাগ, ঢাবি
আমরা স্যারকে পেয়েছি তার অধ্যাপনা থেকে অবসরের পরে। স্যারের খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকা চারুকলার শিক্ষক হওয়ার। তিনি তা হননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। মুর্তজা বশীর ও রাশেদ চৌধুরী তাদের দুজনের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। মুর্তজা বশীর একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। একজন শিল্প ব্যক্তিত্ব। তিনি কখনই বাবার পরিচয়ে বড় হতে চাননি। তার ছিল বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, আধুনিক মনন। তার কাজের একটি বড় ক্ষেত্র ছিল বিমূর্ত ও আধা বিমূর্ত ধারায়। আঙ্গিকে ছিল পিকাসোর কিউবিজমের প্রভাব। মুর্তজা বশীরের চিত্রশিল্পে বাংলার সংস্কৃতি, প্রকৃতি, রমণীর প্রাধান্যের বিস্তার লক্ষণীয়। তার চিত্রকর্মে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ তথা রাজনৈতিক সচেতনতার ব্যাপারটিও উল্লেখযোগ্য। মুর্তজা বশীরের শিল্পকর্ম অসম্ভব আধুনিক। এ আধুনিকতা দেশের শিল্পকলায় যুগে যুগে শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। শিল্পবোদ্ধা বা দর্শক শুধু নয়, আমরা যারা শিল্পকর্ম করি তাদের শিক্ষক তিনি। তিনি সত্যিকারের শিল্পীদের শিল্পী। অনেকে মৃত্যুর পর হারিয়ে যান, কিন্তু মুর্তজা বশীরের কাজ যুগে যুগে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।