বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি

ড. মসিউর রহমান

১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর এত কাছে আসা যেকোনো বাঙালির জন্য বিশেষ সৌভাগ্যের। আমার চাকরির বয়স তখন প্রায় সাত বছর, যার অর্ধেক বা তার বেশি সময় কেটেছে শিক্ষানবিশ এবং আন্তঃপ্রদেশ বদলি কর্মসূচিতে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কোনো সুনাম অর্জন করিনি; সুনাম অর্জনের জন্য এটা ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়। আর আমি চাকরি করেছি এমন সব জায়গায়, যেখানে কেউ যেতে চায় না। সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই, যারা আমার হয়ে কথা বলবেন।

আমাকে একান্ত সচিব হিসেবে বাছাই করার পেছনে কোনো স্কষ্ট রাজনৈতিক বিবেচনা খুঁজে পাই না। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্কর্ক থাকলেও তা ছিল নীরব সমর্থন। সলিমুল্লাহ হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়নের সময় আপত্তি করি সরে দাঁড়াই। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দু-একজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। আমি স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে বাগেরহাটের শেখ আব্দুল আজিজ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় ছিল। শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে পরিচয় ছিলঘনিষ্ঠতাও ছিল। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, শেখ মণি আমাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দেয়, আমি নিষ্ক্রিয় থাকি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিচয় সবারই জানা, তার ব্যক্তিগত আচরণ এবং পরিবারের আচরণ সম্কর্কে আমার জানার যতটা সুযোগ হয়েছিল, খুব কম সরকারি কর্মচারীর সে সুযোগ হয়। মূলত ব্যক্তি মুজিব তার পরিবার সম্কর্কে আমি কিছু বলব। অবশ্য বঙ্গবন্ধু সম্কর্কে কিছু বলতে গেলে আবশ্যিকভাবে রাজনীতির কথা চলে আসে।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর আমার সহকর্মী মাহে আলম আমাকে জানায় যে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অন্যদের সঙ্গে আমাকেও বিবেচনা করা হচ্ছে। তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয় এবং তার পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর সচিব আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী রফিকুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তার সঙ্গে কাজ করার সময় দেখেছি, তিনি সব সময় বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করতেন অথবা জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পরামর্শ দিতেন; কখনো নির্দেশ-আদেশের সুর তার কণ্ঠে ছিল না। তার সঙ্গে যখন দেখা করি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়দায়িত্ব, কার্যপ্রণালি এবং একান্ত সচিবের দায়িত্ব কর্তব্য সম্কর্কে তিনি আমাকে সাধারণভাবে অবহিত করেন। সে যাত্রা এখানেই শেষ।

একদিন জানলাম আমাকে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলির সিদ্ধান্ত হয়েছে, দুই-একদিনের মধ্যে সরকারি আদেশও পেলাম। পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতারা আমার নাম সুপারিশ করেছেন। মুজিবুর রহমান তালুকদার তখন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা। আমার যোগ্যতার জন্য আমাকে সুপারিশ করেছেন মনে হয় না, একমাত্র আমার নামই হয়তো তারা জানতেন। সবেধন নীলমণি!

বাবার চাকরির সুবাদে পটুয়াখালীতে আমার শৈশব কেটেছে। সেখানে আমার আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব অসংখ্য। সংস্থাপন বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ হোসেনকে আমি আমার অসুবিধার কথা জানাই (একসময় আমরা খাদ্য বিভাগে সহকর্মী ছিলাম) জনাব হোসেন প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির করবেন, কিন্তু আমার কথা আমাকেই বলতে হবে। কিছুটা সংশয় ভীতি নিয়ে সৈয়দ হোসেনের সঙ্গে পুরনো গণভবনে (এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ একাডেমি) হাজির হই। বঙ্গবন্ধুকে আমি আমারবিব্রতকর অবস্থাজানালাম। বঙ্গবন্ধুর উত্তর সহজ-সরল: ‘তুমি আইন মেনে কাজ করবে, আত্মীয়-অনাত্মীয়তে কিছু আসে যায় না।সেখানেই কথা শেষ।

পরে আমার বদলি আদেশটি বাতিল হয়। খুব সম্ভব বাণিজ্যমন্ত্রী কামরুজ্জামানের এতে হাত ছিল। তখন আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে নিযুক্ত। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্কর্ক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্কর্ক আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ডব্লিউটিও তখন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গ্যাট-এর নিয়মকানুন মেনে বিশ্ব বাণিজ্য চলছিল। কেনেডি রাউন্ডের কথা চলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের (তখন রাজশাহী জেলার মহকুমা) মহকুমা প্রশাসক থাকার সময় হেনা সাহেব (এই নামেই তিনি অধিক পরিচিত) আমাকে ছিটেফোঁটা জানতেন। তার নিরপেক্ষ বিবেচনার কারণেই হয়তো আমার পক্ষে কিছু বলে থাকবেন।

বেশ কয়েক মাস পর দ্বিতীয় দফায় আবার প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ডাক পড়ল। প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে কথা বলবেন। সচিবালয়ে দিনে সময় হয়নি, তিনি সন্ধ্যায় আবার গণভবনে যেতে বললেন। বর্তমান ফরেন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তখন গণভবনে। সন্ধ্যায় বেশি সময় দেরি করতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সামনে আমাকে হাজির করে দিয়ে অন্যরা চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর কথা স্কষ্ট: ‘তোমাকে আমি আমার সাথে কাজ করবার জন্য নিতে চাই, তোমার তাতে মত আছে? এখানে কাজের চাপ বেশি, আর সহ্যক্ষমতা লাগবেগণ্ডারের চামড়া হতে হবে।আঞ্চলিক বা সাধারণ মানুষের ভাষা ব্যবহারে বঙ্গবন্ধুর দ্বিধা ছিল না।

তোমার দ্বিমত আছে’—তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। বাংলাদেশে এমন কেউ ছিল না যে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসার এবং তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করত না। আমি কোনো রকম থতমতভাবে বললাম: ‘আপনার সঙ্গে কাজ করা আমার সৌভাগ্য, আমার ওপর আপনার আস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আপনার সঙ্গে থাকব।বঙ্গবন্ধুর উত্তর স্নেহসিক্ত: ‘না জেনেশুনে কি আমি তোমাকে পছন্দ করেছি?’ এই হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার কাজের শুরু।

তার সঙ্গে যে দীর্ঘ সময় কাজ করেছি, কখনো মনে হয়নি আমি একজন কনিষ্ঠ কর্মচারী এবং তিনি সরকারপ্রধান দেশের অবিসংবাদী নেতা। সম্কর্ক অনেকটা পিতা-পুত্রের মতো শ্রদ্ধা স্নেহভরা।

সকাল থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত, কখনো আরো বেশি সময় বঙ্গবন্ধু অফিসে ব্যস্ত থাকতেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব এবং অনেক সময় করপোরেশন প্রধানগণ তার কাছে আসতেন। রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। বিকালবেলা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আমাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল নথি থাকলে তাত্ক্ষণিকভাবে দেখানোর সুযোগ পেতাম না। খুব বেশি জরুরি গুরুত্বপূর্ণ হলে দুপুরে খাবার বা বিশ্রামের সময় তার কাছে আবার যেতাম।

খাবার সময় গেলে মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্ন: ‘তুমি খেয়েছ?’ আমরা সরাসরিহ্যাঁবানাবলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সফলতার ভাগ কম। তিনি কিছু সময় মুখের দিক তাকিয়ে বলতেন, ‘তোমার মুখ শুকনো দেখা যাচ্ছে, খাও, পরে কাজ।নিজ হাতে প্লেট এগিয়ে দিয়ে ভাত-মাছ উঠিয়ে দিতেন। কই মাছ মাছের মাথা নিত্যদিনের মেনু। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সামনে কই মাছ খাওয়া দুষ্কর। পরিবেশ সহজ করার জন্য তিনি হয়তো বলতেন: ‘তোমরা মাছ খাওয়া শেখোনি, দেখো এভাবে খেতে হয়।কই মাছের কাঁটা সরিয়ে বা মাছের মাথা হাত দিয়ে ভেঙে কীভাবে মুখে পুরতে হয় দেখিয়ে দিতেন। খাওয়া শেষ হলে নথির বিষয়বস্তু পড়ে শোনাতাম, তিনি সিদ্ধান্ত দিয়ে লিখে নিয়ে যেতে বলতেন। জটিল বিষয় হলে প্রাসঙ্গিক অংশ পড়ে দেখতেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্রুত তার নজরে আসত। প্রয়োজন হলে মন্ত্রী বা সচিবের সঙ্গে তখনই আলাপ করে নিতেন বা পরে তাদের আসতে অনুরোধ জানানো হতো।

যারা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বয়সে বড় এবং যাদের সঙ্গে তার আগে পরিচয় বা ব্যক্তিগত সম্কর্ক ছিল, তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা সৌজন্যবোধ ছিল স্বভাবজাত। জহুরুল হকের কথা মনে পড়ে। তিনি পাকিস্তানে তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন, যুদ্ধের সময় হাজতবাসে ছিলেন। কিছু জার্মান কবিতা বা ছোটগল্প অনুবাদ করেছিলেন। জহুরুল হক স্বাধীন বাংলাদেশে তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করলে (খুব সম্ভব সচিব পদে) পত্রপত্রিকায় সমালোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে কাছে নিয়ে আসেন। জহুরুল হক সবার কাছে পরিচিত ছিলেন না, পারিবারিক সম্কর্কের জন্য আমি তাকে জানতাম। কিছুটা উদাসীন বৈষয়িক বিষয়ে আকর্ষণহীন বলে মনে হতো।

বঙ্গবন্ধু তাকেজহুর ভাইবলে সম্বোধন করতেন। আমার যতদূর মনে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কামরায় জহুরুল হক সাহেব গেলে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা করতেন বসতে বলতেন। জনাব হকের প্রতি তার এই সশ্রদ্ধ আচরণ আমাদের মনে কিছু বিস্ময় সৃষ্টি করে। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু আমার সহকর্মী সামাদ আমার কৌতূহল বুঝতে পারেন। (. এসএ সামাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব এবং পরে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান ছিলেন) একদিন তিনি বললেন, ‘তোমরা জানো জহুর ভাই কে?’ বয়স্ক সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া তার অন্য পরিচয় আমাদের জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘জহুর ভাই বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (১৯৪৭ সালের আগে) ইংরেজি বক্তৃতা লিখতেন। শহীদ সাহেব খুব কম লোকের ইংরেজি লেখা কাটাছেঁড়া না করে গ্রহণ করতেন না। জহুর ভাইয়ের লেখায় তিনি হাত ছোঁয়াতেন না।

প্রবীণ সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সম্কর্ক ছিল অন্তরঙ্গ। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহকে মণিদা বলে সম্বোধন করতেন। পরিহাসের সুরে বলতেন, ‘মণিদা আর কতদিন অন্ধকারে থাকবেন, এবার আলোতে আসেন।গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণের আহ্বান। মুজাফফর ন্যাপের নেতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বসুলভ আচরণ। মওলানা ভাসানীর প্রতি সব রাজনীতিবিদের শ্রদ্ধা ছিল অবিমিশ্র।

সাংবাদিকদের মধ্যে কে জি মুস্তফা, গাফ্ফার চৌধুরী (গাফ্ফার ভাই), এমআর আখতার মুকুল (মুকুল ভাই), এবিএম মূসা (মূসা ভাই) নির্মল সেন (নির্মল দা) প্রায়ই আসতেন। জনাব মুস্তফা পরে রাষ্ট্রদূত হয়ে বাইরে চলে যান। গাফ্ফার ভাই বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে বই লেখার দায়িত্ব নেন। জামিল ভাই (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিহত) এবং আমি দুপুরে তাদের কথা বলার সময় নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। গাফ্ফার ভাই যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর প্রামাণ্য জীবনী লেখা হতে পারে, যা হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য অমূল্য সম্কদ।

সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ছেলেমেয়েদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর স্নেহ। রাজনীতিতে তাদের বাবা কোন পক্ষে ছিলেন তা বঙ্গবন্ধুর বিবেচনায় আসত না। তাদের পরিবার ছেলেমেয়েরা কোনো অসুবিধায় পড়েছে জানলে তিনি তাদের উপকার বা সাহায্য করতে কার্পণ্য করতেন না। উদারস্নেহ হূদয় তার স্বভাবজাত মানবিক চেতনা।

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেগম মুজিবের সঙ্গে টেলিফোনে অনেক সময় আলাপ হতো, বাসায় তার সঙ্গে দেখা হতো, তার সঙ্গে কয়েকবার টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছি। রেহানা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক সময় বাইরে যেত, বদরুন্নেসা কলেজে আমার স্ত্রীর ছাত্রী ছিল। উভয় সুবাদে রেহানা পরিচিত ছিল। কামালের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কম হলেও সম্কর্ক স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠ ছিল। গণভবনে সবচেয়ে বেশি আসত রাসেল। বঙ্গবন্ধুও তাকে অনেক সময় দিতেন। স্বাধীনতার আগে অন্য সন্তানদের যে সময় দিতে পারেননি, রাসেলের প্রতি স্নেহ দিয়ে হয়তো তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন।

বেগম মুজিবের কণ্ঠে ছিল বড় বোন বা মায়ের স্নেহ। টুঙ্গিপাড়া থেকে নারকেল, ইলিশ মাছ, যেকোনো বড় মাছ বা খাবার জিনিস আনলে তিনি আমাদের পাঠাতেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তা, তার আচরণে তা কখনো প্রকাশ পায়নি।

সরকারি নিয়মকানুন সম্কর্কে তিনি অতিমাত্রায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলে মনে হয়। নিয়মকানুনের জটিলতা সম্কর্কে তার অবশ্য জানার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু তখন চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় ছিলেন। তিনি একদিন লাল টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বললেন। আত্মীয়স্বজন কেউ বলেছিলেন, তিনি যেন হেলিকপ্টার নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যান, হয়তো তাদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। একান্ত আবশ্যক না হলে সরকারি হেলিকপ্টার ব্যবহারে তার আপত্তি। অন্যদিকে আত্মীয়স্বজনের পরামর্শ বা চাপ উপেক্ষা করা হয়তো বিব্রতকর ছিল। টেলিফোনে তার অনুরোধ ছিল সাধারণ আচরণের ব্যতিক্রম: ‘ওরা আমাকে হেলিকপ্টার নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যেতে বলছে, আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমি ওদের আপনার সাথে কথা বলতে বলেছি। আপনি ওদের সরকারের নিয়মকানুন বলে বুঝিয়ে দেবেন।

সরকারি বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী-পরিবার প্রয়োজন হলে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারে। তার আপত্তির কারণ আমার মনে হয় বিশেষ দরকার ছাড়া সরকারি সুবিধা আদৌ ব্যবহার না করা। তার আত্মীয়রা আমাকে বললে জানাই যে এজন্য কারণ উল্লেখ করেরিকুইজিশনদেয়া দরকার; কারণটা খুব স্কষ্ট নয়। আলোচনা এখানেই থেমে যায়।

বেগম মুজিবের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় গেলে বিশিষ্ট অতিথির আপ্যায়ন পাওয়া ছিল সাধারণ নিয়ম। সময়মতো খাওয়া হয়েছে কিনা, খাওয়া ঠিক ছিল কিনা তিনি তার খবর নিতেন। আমি আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু তখন বাইরে, বঙ্গবন্ধুর বাবার শরীর খারাপ। বেগম মুজিব বাড়িতে গেলেন। খাবার সময় বেগম মুজিব নিজে এলেন, হাতে পাখা। বিদ্যুতের তখন এত ছড়াছড়ি ছিল না। খাবার অন্য কী ছিল মনে নেই, তবে মাছের মাথা ছিল। আমি কয়েকবার জানাই আমার খেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, অন্যরা দেখাশোনা করছে, তার থাকার দরকার নেই। খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বসে থাকলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কর্মকর্তা নই, তার বাড়ির অতিথি। রকম দৃষ্টান্ত আমি কারো কাছে শুনিনি।

বঙ্গবন্ধু পরিবারে জ্যেষ্ঠ সন্তানের সঙ্গে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) দেখাশোনা ছিল সবচেয়ে কম। যতদূর মনে পড়ে, তাকে জানার সুযোগ একবারই এসেছিল। আমেরিকায় যাওয়ার আগে আমি সপরিবারে কক্সবাজারে বেড়াতে যাই। কক্সবাজারের মহকুমা প্রশাসক আমার কনিষ্ঠ সহকর্মী, তার বোনের স্বামী আমার বন্ধু এবং আমরা একসঙ্গে চাকরিতে যোগ দিই (ইরশাদুল হক) মহকুমার নাজির সার্কিট হাউজে না যেয়ে আমাকে বারবার মহকুমা প্রশাসকের বাসায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিল। মহকুমা প্রশাসক নিজে আমন্ত্রণ করেনি বলে আমি অনিচ্ছুক ছিলাম। একরকম জোর করেই কক্সবাজার সার্কিট হাউজে (তখন ওয়াপদা রেস্ট হাউজ) চলে যাই। সেখানে পৌঁছে মহকুমা প্রশাসকের বিব্রত অবস্থা বিকল্প ব্যবস্থার কারণ বুঝতে পারি।

. ওয়াজেদ সেখানে সপরিবারে ছিলেন, সঙ্গে রেহানা এবং হয়তো আরো দু-এক ছিলেন। আমরা পৌঁছলে সার্কিট হাউজের কর্মচারীরা এবং মহকুমা প্রশাসক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। সমাধান নিয়ে এল রেহানা, ‘আপা বলেছেন আমার ঘরটা আপনাদের ছেড়ে দিতে, আমি অন্য কামরায় চলে যাব। রাত্রে আপনারা আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে খাবেন।রেহানা আমাদের জন্য দ্বিতীয় ভিআইপি কামরা ছেড়ে দিল।

রেহানা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাপানে যায়। বঙ্গবন্ধুর সহগামী দলের সবাই কিছু বাজারসওদা করে। রেহানার কাছে আমি জানতে চাই ওর যাওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা। রেহানার উত্তর, ‘না, আব্বা বলেছে তুমি কিছু কিনবে না।ওর কণ্ঠ দৃঢ়, মুখে হাসি, আব্বার নিষেধ মানাতেই ওর আনন্দ।

কামালের সঙ্গে আমার আলাপের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। তখন সরকারের টাকাপয়সার টানাটানি, বৈদেশিক মুদ্রার অভাব তীব্র। বাইরে যাওয়ার জন্য এক ডলার দরকার হলেও সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমতি দরকার।

আবাহনী ফুটবল টিম কলকাতায় খেলতে যাবে। শিক্ষা ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তখন একসঙ্গে ছিল। শিক্ষামন্ত্রী ইউছুফ আলী অল্প পরিমাণ ডলার দেয়ার সুপারিশ করে নথি পাঠিয়েছেন, নথিটি আমার কাছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে তদবির করতে এল তার ছেলে, তদবির করল আমার কাছে, ‘আব্বাকে বুঝিয়ে বলবেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ যেন অনুমোদন করেন।টাকার পরিমাণ এত কম যে এজন্য সুপারিশ আমার অস্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু কামাল হয়তো তার বাবার মনোভাব আঁচ করতে পেরেছিল।

বঙ্গবন্ধুর সামনে নথি রেখে সুপারিশ গ্রহণ করার অনুরোধ করলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন, মনে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও নোটটি পড়লেন এবং আমাকে ফেরত দিলেন।আমার কাছে এসব প্রস্তাব আন কেন?’ সুপারিশটি তিনি গ্রহণ করলেন না। প্রত্যাখ্যান করার একটা কারণ বোধ হয় প্রস্তাবটি ছিল তার ছেলের জন্য, মন্ত্রণালয় প্রভাবিত হয়ে সুপারিশ করেছে।

আমার সহকর্মী সৈয়দ আবদুস সামাদ, মহীউদ্দিন খান আলমগীর, মো. ফরাস উদ্দিন, মনোয়ারুল ইসলাম এরা সবাই তখন বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়ার চেষ্টা করছে, অনুমতি পেয়েছে এবং যাওয়ার আয়োজন করছে। এরা সবাই অর্থনীতির কৃতী ছাত্র, তাদের উচ্চতর শিক্ষা দেশের কাজে লাগতে পারে। শিক্ষা যোগ্যতার মাপকাঠিতে আমি তাদের কাছাকাছি নই। তাদের উদাহরণ আমার মনে কিছুটা লোভ সৃষ্টি করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত মেসন প্রোগ্রামের জন্য ইন্টারভিউ দিই এবং (অবিশ্বাস্যভাবে!) নির্বাচিত হই। কিন্তু অনুমতি তখনো মেলেনি, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় আছে।

একদিন সকালবেলা সংস্থাপন বিভাগের সৈয়দ হোসেন সাহেব (তখন যুগ্ম সচিব অথবা অতিরিক্ত সচিব) আমার কামরায় এসে নথিটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আপনারটা করাতে পারলাম না। নথি আপনি রাখেন। যদি সম্ভব হয় বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নেয়ার চেষ্টা করবেন।

পরের দিন সকালে বঙ্গবন্ধু অফিসে এসে আমাকে তার কামরায় ডাকলেন। অন্য কেউ ছিল না। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি লেখাপড়া শেখার জন্য যেতে চাও। পিএইচডি করবা?’ আমি কিছুটা ভয়ের সঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘আপনি অনুমতি দিলে চেষ্টা করব।নথি আমাদের অফিসে আছে কিনা জানতে চেয়ে তার কাছে নিয়ে যেতে বললেন।

আমি ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর সচিব জনাব রহিমের কাছে নথিটি দিলাম। নিজে নিয়ে যেতে চাইনি। শেষ মুহূর্তে তিনি অন্য চিন্তা করতে পারেন। আর নীতির দিক থেকে নিজের স্বার্থ সম্কৃক্ত বিষয় কোনো কর্মকর্তার নিজের বিবেচনায় রাখা উচিত নয়। কয়েক মিনিট পর জনাব রহিম হাসিমুখে ফিরে এসে অভিনন্দন জানালেন। নথিটি ফেরত দিয়ে বললেন যে বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন।

১৯৭৫ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের দায়িত্ব ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাই। যাওয়ার আগে সপরিবারে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বর রোডে যাই। বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিব অনেক স্নেহ দোয়া জানালেন। রেহানাও অল্প সময়ের জন্য দেখা করল।

বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে নিচে নেমে এলেন। আমাদের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। আমার স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘মসিয়ূরকে ছাড়তাম না। ওর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তোমাদের তাতে কষ্ট হয়। বিদেশে টাকাপয়সার অভাবে কষ্ট কোরো না, দরকার হলে আমাকে জানাবে। বড়লোকের দেশে যাচ্ছ, সেই মোহে নিজের দেশকে ভুলে যেয়ো না।তার শেষ উক্তিটি আমার উদ্দেশে: ‘লেখাপাড়া শেষ হলে ফিরে এসো।আমরা সালাম করে তার দোয়া নিয়ে চলে আসি। অনেকের মতো বিদেশে বেশি বেতনের চাকরির লোভ অনুভব করেছি, কিন্তু সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর উপদেশ মনে ভেসে উঠেছে।

১৯৭৫ সালের আগস্টে আমি আমেরিকায়। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে আমার পিএইচডি শেষ হয় এবং আমি আমেরিকা ত্যাগ করি। জানুয়ারি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারে যোগদান করি। সরকারি চাকরিচ্যুত হওয়ার পর (অক্টোবর, ২০০১) আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি; আবার শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

যে আদর্শ উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই আদর্শ উদ্দেশ্য অর্জন প্রচেষ্টায় অংশ নেয়ার সৌভাগ্য অতি বিরল। আমার সেই সৌভাগ্য হয়েছে।

 

. মসিউর রহমান: প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন