বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু মিথষ্ক্রিয়া

সালমান এফ রহমান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সে ঢাকা কলেজে পড়ত। আর আমি নটর ডেম কলেজে পড়তাম। তখন স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু ধানমন্ডিতে থাকতাম, আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। সেখানে কামালও ছিল। আমরা একসঙ্গে অনেক কিছুতে সম্পৃক্ত ছিলাম। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে কামালের সঙ্গে আমিও তাতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কামালের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুসহ পুরো পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।

আমার মনে পড়ে সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো কিন্তু তা পায়নি। তার দল আনুমানিক ৬০ শতাংশ আসন পেয়েছিল, অন্য দলগুলো ৪০ শতাংশ আসন পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভাবছিলেন ৪০ শতাংশ আসন পাওয়া দলগুলোর সঙ্গে কিছু একটা করা যায় কিনা। নির্বাচনের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল আলোচনা করতে। নিরঙ্কুশ বিজয়ী দলের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা, সেক্ষেত্রে ভুট্টোর দল হবে প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। গায়ের জোরে ক্ষমতা ধরে রাখবে।

লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি তখন ছাত্র। আমার আম্মা কাউন্সিল মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন তিনি জেল থেকে মুক্তি পান, তখন তার সঙ্গে আমিও লাহোরে গিয়েছিলাম।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময়ই আমার আব্বা মারা যান। জেল থেকে ছাড়া পেলে বঙ্গবন্ধু আমার আম্মার সঙ্গে দেখা করতে আমাদের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। এই ঘটনাও এখন খুব মনে পড়ছে।

নয় মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলো। তখন একটি বড় সমস্যা ছিল আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা নেই। অথচ আমাদের ওষুধ, সার, কীটনাশকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিস আমদানি করা দরকার।  তখন বার্টার ট্রেডের প্রচলন ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বার্টার ট্রেড হতো। বার্টারে আমাদের পাট, চামড়া, চা চিংড়ি প্রভৃতি রফতানি হতো। আর আমরা ওষুধসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতাম।

প্রকৃতপক্ষে, বেক্সিমকো বা বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানি করার পেছনেও এটি ছিল একটি কারণ। তখন নতুন দেশ। সবকিছু জাতীয়করণ হয়েছে। আমার মনে আছে, আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব করেছিলাম যে আমরা প্রাইভেট বার্টার করব। সাধারণত সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে বার্টার হয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বললাম, আমরা ব্যক্তি খাত থেকে ব্যক্তি খাত পর্যায়ে বার্টার করব। তিনি বললেন, খুব ভালো আইডিয়া। কার সঙ্গে করবে? আমরা বললাম, অন্দ্রে নামে একটি সুইস কোম্পানি আছে, তাদের সঙ্গে বার্টার করব। টিসিবি আমাদের অন্যতম পার্টনার হলো।

তিনি বললেন, ৬০ শতাংশ নন-ট্রেডিশনাল আইটেম আর ৪০ শতাংশ ট্রেডিশনাল আইটেমের ট্রেডিং করতে হবে। আমরা অনুরোধ করে বললাম, ৬০ শতাংশ নন-ট্রেডিশনাল আইটেম আমরা কোথায় পাব। তিনি বললেন, আমি তোমাদের দেব। তখন চা নন-ট্রেডিশনাল আইটেম। একটি বড় আইটেম পেলাম। আর ট্রেডিশনাল আইটেম হিসেবে পাট চামড়া রফতানির সুযোগ পেলাম। চিংড়ি মাছও তখন নন-ট্রেডিশনাল আইটেম ছিল। তখন এটি রফতানি হতো না। তিনি বললেন, তোমরা সুন্দরবনের মধু রফতানি কর। তখন স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের দুটো ফ্যাক্টরি ছিল। একটি ছিল ইস্টার্ন কেবলস। এখনো আছে। এটি তখন সদ্য স্থাপন করা হলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমরা কেবল রফতানি কর। আরেকটি ফ্যাক্টরি ছিল, যেটি সেফটি ম্যাচ উৎপাদন করত। তিনি বললেন, সেফটি ম্যাচ রফতানি কর। মধু, সেফটি ম্যাচ, ইলেকট্রিক কেবল প্রভৃতি রফতানির আইডিয়া তিনি আমাদের দিলেন। বেসরকারি অংশীদারের মাধ্যমে আমরা এগুলো রফতানি করেছিলাম। আর ট্রেডিশনাল আইটেম তো ছিলই।

অন্যদিকে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা বেশির ভাগ আমদানি করেছি ওষুধ। তখন ওষুধের খুব ঘাটতি ছিল। আর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা নেই। ওষুধ কিনতে হবে। ওষুধ কিছু সার এনেছিলাম আমরা। কিছু কীটনাশক এনেছিলাম। বঙ্গবন্ধু খুব দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তিনি তখনই শুধু ট্রেডিশনাল আইটেমে না থেকে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের বিষয়টি চিন্তা করেছিলেন। তার সঙ্গে এটি আমার একটি সুখকর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা একটি অভিযোগ করেন যে তিনি সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছিলেন। আসলে এটি ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। কারণ বাঙালি উদ্যোক্তা ছিল গুটি কয়েক। আমাদেরও পাটকল ছিল। তাও জাতীয়করণ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর একটা গ্রুপ ন্যাশনালাইজড থাকবে, আরেকটি গ্রুপ ন্যাশনালাইজড থাকবে না তা নিয়ে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারত। কাজেই ওই সময় সবকিছু জাতীয়করণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এর বলি হয়েছিলেন বাঙালি উদ্যোক্তারা। জাতীয়করণ করা হলেও পেছন থেকেই উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠানগুলো চালিয়েছিলেন। তিনি তার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন।

আমি বলব, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাঙালিদের কারখানাগুলো ফেরত দিয়ে দেবেন। তিনি এটি দেখে যেতে পারেননি। দুর্ভাগ্য যে ১৫ আগস্টের কালরাতে কুচক্রীদের হাতে নৃশংসভাবে তিনি শহীদ হলেন।

আরেকটি কথা বলা দরকার, তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প খাতের ৯৫ ভাগ উদ্যোক্তা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। কেবল শতাংশ ছিলেন বাঙালি উদ্যোক্তা। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যই ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন সূচনার অন্যতম প্রধান কারণ। লক্ষণীয় বিষয়, আমরা তখন মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। তারা ছিল ৪৪ শতাংশ। অথচ সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র সবখানে তাদের প্রাধান্য ছিল। আমাদের এখানকার টাকা দিয়ে তারা উন্নয়ন করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের। আমাদের এখানে তারা কোনো উন্নয়ন করেনি। ছয় দফায় এসব বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধু এসব বিষয় পাকিস্তানি শাসকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু খুব বিচক্ষণ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রতি খাতে কীভাবে দেশটি এগোবে, সবক্ষেত্রে তিনি পরিকল্পনা করে গেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন দেশকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছেন, তার অনেক আগেই বাংলাদেশ জায়গায় চলে আসত। সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী টার্গেট করা হয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা হবে। প্রকৃতপক্ষে আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, তার নেতৃত্ব পেলে সে জায়গায় আমরা আজকে চলে আসতে পারতাম।

বঙ্গবন্ধুর একটি ব্যক্তিগত ঔদার্য নৈতিক শিক্ষার দিক উল্লেখ করা যাক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর কী অবস্থান ছিল সেটি বোঝানো খুব কঠিন। কেউ বলবেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কেউ বলবেন, তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কেউ বলবেন, জাতির পিতা। সব মিলিয়ে পুরো জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু কী ছিলেন, সেটি ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। মূল কথা হলো তার ওপর আমাদের একটা অন্ধ বিশ্বাস ছিল। তিনি যা বলতেন আমরা তা করতে প্রস্তুত ছিলাম। সেটি ছিল তার স্থান।

সেই জায়গায় শেখ কামাল ছিল তার ছেলে। কল্পনা করুন, শেখ কামালের অবস্থান তখন কোথায়। সে বঙ্গবন্ধুর ছেলে। শেখ কামাল এসে বলে, আমাদের আবাহনী করতে হবে। কেন করতে হবে? আমাদের ক্রীড়ার মানে উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটাতে হবে। তখন শুধু মোহামেডান ছিল। আমাদের মোহামেডান পর্যায়ের একটা টিম তৈরি করতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে, ক্রীড়ার মান বৃদ্ধি পায়। সেজন্যই আবাহনী গঠন। শেখ কামাল শুধু দল গঠন করেনি, সে নিজেই চৌকস খেলোয়াড় ছিল। ক্রিকেটে সে ফাস্ট বোলার ছিল। বাস্কেটবলে ভালো ছিল।

কামাল খুব সাদাসিধে ছিল। তখন নতুন দেশ। অনেক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অনেক সুযোগও তৈরি হয়েছে। অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী আসছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে চায়। আমি দেখেছি, কামালকে বিভিন্নজন অফার করছে একটি ফোন করার জন্য। তোমাকে এত কমিশন দেব বা পার্টনারশিপ দেব। কেউ বলতে পারবে না যে কোনোদিন কারো সঙ্গে সে কোনো ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। অন্যায্য কোনো কাজে জড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছেলে হিসেবে সে অনেক কিছু করতে পারত। কিন্তু সে তা কখনো করেনি।

আমরা বিদেশে গেলে জিজ্ঞাসা করতাম তোমার জন্য কী আনব। সে বলত, আমার জন্য কিছু আনতে হবে না। আবাহনীর খেলোয়াড়দের জন্য কেডস নিয়ে এসো। সে গিটার বাজাতে পারত, সেতারও বাজাতে পারত। সে স্পন্দন শুরু করেছিল। আমাদের যে পপ মিউজিক আমি মনে করি তার প্রতিষ্ঠাতাও শেখ কামাল। তার কারণে আমাদের পপ মিউজিক আজকের অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।

রাজনীতিতেও সে অভিজ্ঞ ছিল। নিজে কোনো পদ নেয়নি। কিন্তু পেছন থেকে সবকিছু সংগঠিত করত। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসার হয়ে জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিল। কিন্তু তার মধ্যে ন্যূনতম গরিমা-অহমিকা ছিল না। কারণ বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা তার ছেলেমেয়েদের সাধারণভাবে মানুষ করেছেন। বলা চলে, বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষার এই দিকটিও উপেক্ষিত নয়।

বঙ্গবন্ধুর বাসায় অনেকবার গিয়েছি। অনেকবার একসঙ্গে খেয়েছি। তার পরিবারের জীবনযাপন একেবারে সাদাসিধে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও এই বিষয়টি আছে। এখনো তিনি খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এটি তিনি পারিবারিক শিক্ষা থেকে পেয়েছেন। রাষ্ট্রনায়ক হয়েও সহজ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হয়, তিনি এই শিক্ষাটা পরিবারের সব সদস্যের দিয়েছিলেন। এটিও বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমাদের শেখার বিষয়। এই মহান নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

 

সালমান এফ রহমান: প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগ উপদেষ্টা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন