বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা ও ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই ছিল ম্রিয়মাণ

মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দুপুরে গণভবনেই খাবার খেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খাবার খাওয়ার আগে গণভবনের কর্মচারীদের চাওয়া পূরণ করেছিলেন। নিজের স্বাক্ষরিত ছবি দিয়েছিলেন তাদের। দেখাই যে শেষ দেখা হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। গণভবনের রান্নাঘরের স্টোরকিপারের দায়িত্বে ছিলাম আমি।

গণভবনের রান্নাঘরের স্টোরকিপারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। আমি জানি বঙ্গবন্ধু কী খেতে পছন্দ করতেন, আর কী অপছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর খাবারে সব সময়ই দেশীয় মাছ থাকত। পাতলা ডাল ছিল তার পছন্দের। আর নাশতায় সমুচা একটু বেশিই পছন্দ ছিল বঙ্গবন্ধুর।

প্রতিদিনের মতো জীবনের শেষ দিনটিতেও গণভবনে সাধারণ/স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত থেকেছেন বঙ্গবন্ধু। তাকে দেখেছি পাইপ টানছেন, লেকের পাড়ে হাঁটছেন। ১৪ আগস্টও ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাঠানো দুপুরের খাবার গণভবনে বসেই খেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ওইদিনও অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে দুপুরের খাবার খাইয়েছি। শুধু তাই নয়, ওইদিন বিকালে বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য নিজের স্বাক্ষর করা ছবিও পাঠান। কেন বঙ্গবন্ধু আমাদের এই ছবি দিয়েছেন সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজি আমি। এটিই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ সান্নিধ্য, শেষ স্মৃতি।

ওইদিন বিকালে জাতির পিতা নিজের স্বাক্ষর দেয়া কয়েকটি ছবি কন্ট্রোলারের হাতে আমাদের কাছে পাঠান। কারণ তার আগে আমার সহকর্মী হারুন বঙ্গবন্ধুর কাছে ছবি চেয়েছিলেন। এখনো বুঝতে পারছি না ওই দিন কেন বঙ্গবন্ধু আমাদের ছবিগুলো দিয়েছিলেন। শেষ ওই স্মৃতিটুকু এখনো সযত্নে রেখে দিয়েছি আমার হাতে।

বিষয়টি আসলেই কাকতালীয়। আমরা ভাবিওনি বঙ্গবন্ধু আমাদের ছবি দেবেন। কন্ট্রোলার এসে কয়েকটি ছবি দিয়ে বলল, এই ছবিগুলো তোদের জন্য বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন, রাখ।

দুর্লভ সেই ছবি আজও আছে আমার কাছে। দায়িত্ব স্টোরকিপারের থাকলেও গণভবনে আগত অতিথিদের আতিথেয়তা-আপ্যায়নের দেখভালের দায়িত্বও ছিল আমার। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে বসবাস করলেও অফিস করতেন গণভবনে। সেই সুযোগে প্রায় তিন বছর খুব কাছ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছে।

আমার ঘরে কোনো ছবি টানানো নেই। দুটি ছবি টানানো আছে, একটি বঙ্গবন্ধুর। ১৯৭৫ সাল থেকে আজও সেই ছবি নামানো হয়নি। শুধু যত্নই করে রেখেছি। আরেকটি আমার মায়ের ছবি টানানো আছে। 

আমরা গণভবন কম্পাউন্ডেই থাকতাম। প্রতিদিনের মতো ১৪ তারিখ রাতে খাওয়ার পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি গণভবনের বাউন্ডারি ঘেঁষা ট্র্যাঙ্ক দাঁড়ানো। কিছু বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ বাদে রেডিওতে প্রথম খবর পাই। বেলা ১০-১১টা নাগাদ খুনি মেজর ডালিম মোসলেমউদ্দিন গণভবনে প্রবেশ করে দলবল নিয়ে। বিভিন্ন রুমে তল্লাশি করে আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। গণভবনের কর্মকর্তারা সবাই সবার পরিচয় দিলে খুনির দল আমাদের ছেড়ে দেয়। প্রায় দুই মাস গণভবনে নজরবন্দি ছিলাম। পরে ওখান থেকে বঙ্গভবনে আমাকে বদলি করা হয়। ওখানে বেশ কয়েক বছর ছিলাম। পরে এরশাদ সরকার আসার পরে ফরিদপুরে বদলি হয়ে যাই। চাকরির শেষ সময় পর্যন্ত ফরিদপুরে ছিলাম।

দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কথাভালো আছিস? তোরা খাইসিস? তোদের কোনো সমস্যা নাই তো? ওই খায়ের ওদের ঠিকঠাকভাবে দেখাশোনা করিস? বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে তুই শব্দটি সবচেয়ে আপন মনে হতো। বঙ্গবন্ধু সবাইকে তুই বলে সম্বোধন করতেন। দু-একজনের ক্ষেত্রে তুমি বলতে শুনেছি। সে হোক বয়স্ক হোক তরুণ। তিনি প্রথম দেখায় সম্মোধনের মাধ্যমে সবাইকে আপন করে নিতেন, মনে হয় কতদিনের চেনা।

একদিন গণভবনের লেকের পাশে হাঁটতে গিয়ে সুঠাম দেহের হারুন নামে গণভবনের এক কর্মচারীকে দেখেন বঙ্গবন্ধু। কাছে ডেকে তাকে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর নাম কী? হারুন জবাবে তার নাম বলেন। বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোর বাড়ি কোথায়? হারুন বলেন ফরিদপুর। ওখানে কোথায়, মধুপুর। তুই এখানে চাকরি করিস কেন? তোর যে শরীর-চেহারা তুই তো আর্মিতে চাকরি করার কথা।

আরেক দিন বিকালে গণভবনের কর্মচারী রেজাউল নামে একজন বঙ্গবন্ধুকে চা দিচ্ছিলেন। সময় রেজাউলকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর চেহারা মলিন কেন? উত্তরে রেজাউল বলেন, স্যার বেতন হয় না তিন মাস। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোলার আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠান এবং জানতে চান ওদের বেতন হয় না কেন? খায়ের বলেন, জটিলতা আছে। বঙ্গবন্ধু তত্ক্ষণাৎ বলেন, আমি কিচ্ছু বুঝি না, একদিনের মধ্যে বেতন হওয়া চাই। একদিন বাদেই বেতন হয়েছে। ঘটনাগুলো বলার কারণ হলো বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা ছিলেন যার দৃষ্টিভঙ্গি ধনী-গরিব, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তাঁর চোখে সমান ছিল।

১৯৭৪ সালের মার্চ আমি বিয়ে করি। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের কোনো একদিন, তারিখ ঠিক মনে নেই। দুপুর বেলায় বঙ্গবন্ধু যখন খেতে বসলেন তখন বিয়ের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিই। অবশ্য আমার সহকারী কন্ট্রোলার হাসানুজ্জামানের কথামতো বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দেয়া হয়। সহকারী কন্ট্রোলার যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন আমি তখন ওই রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ের কথা শুনেই আমাকে ডাক দিলেন। জানতে চাইলেন কোথায় বিয়ে করছি? বউ কী করে, কতটুকু পড়াশোনা করেছে, শ্বশুর কী করে এমন অনেক প্রশ্ন? উত্তর দেয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদকে ডেকে বললেন, ওকে এক হাজার টাকা দিয়ে দে। আর আমাকে বললেন তোর বউকে একটা বেনারসি শাড়ি একটা ঘড়ি কিনে দিস টাকায়। বঙ্গবন্ধুর দেয়া টাকা দিয়ে স্ত্রীকে লাল পাড়ের একটি হলুদ বেনারসি শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম। এই হলো বঙ্গবন্ধু। তার মহানুভবতা ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই ছিল ম্রিয়মাণ। সবার জন্য তার ভালোবাসা ছিল এক। বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসায় রকমফের দেখিনি।

 

মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন: গণভবনের সাবেক স্টোরকিপার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন