আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে এই দিনে আমাদের জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যে নৃশংসতার কোনো তুলনা নেই। বাঙালি জাতির জন্য ১৫ আগস্ট তাই একটি শোকাবহ দিন। সেই শোক আমাদের হূদয়কে উদ্বেলিত করে, জনক হারানোর সে আর্তি আমাদের মথিত করে এবং সে শোক প্রকাশের কোনো ভাষা নেই।
তবু এই শোকাবহ দিনে আমার আরেকটি দিনের কথা মনে পড়ে যায়, একটি বিশেষ দিনের কথা। আমাদের প্রজন্মের বহুজন বঙ্গবন্ধুকে বহুবার দূর থেকে দেখেছে—জনসভায় তিনি অনলবর্ষী ভাষণ দিচ্ছেন, সভায় অংশ নিচ্ছেন ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিভায়, জনতার মাঝে উপস্থিত মায়াময় আচরণে। বড় নমিত চিত্তে বলি, আমি তাঁকে একবার কাছে থেকে দেখেছি—একবারই কিন্তু খুব কাছে থেকে এবং তিনি আমার সঙ্গে কথাও বলেছেন। স্বল্প কয়েকটি কথা, তবু বঙ্গবন্ধুর বাক্য তো।
বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল ছিল আমার সতীর্থ সহপাঠী এবং পরম ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। বিভাগ এক ছিল না আমাদের—কামাল সমাজবিদ্যার, আমি অর্থনীতির। কলা ভবনের একতলায় সামনের দিকে ওরা, আমরা তিনতলায় পেছন দিকে। তবু নানান কারণে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, জন্মেছিল ঘনিষ্ঠতাও। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে বহু সময় আমাদের একত্রে কেটেছে গল্পে আর আড্ডায়। আমরা আড্ডা বসাতাম গ্রন্থাগারের চাতালে, সমাজবিদ্যা বিভাগের সামনের বারান্দায়, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সবুজ মাঠে। নানান বিভাগের বন্ধুবান্ধবরা আসত সেসব আড্ডায়। কথা, চা-পানে, তর্কে-বিতর্কে কখন যে সময় পেরিয়ে যেত, তা টেরও পেতাম না।
সেদিনও গ্রন্থাগারের চাতালে তুঙ্গ আড্ডা দিতে দিতে কখন যে দুপুর পেরিয়ে গেছে, টেরও পাইনি। মাটিতে এলিয়ে পড়া বিড়ালের মতো নরম রোদের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আড্ডাধারীরা সব লাফিয়ে উঠলাম। উঠতে হবে এবং যেতে হবে—ছাত্রাবাসে ও বাড়িতে। প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কামাল জিজ্ঞেস করল, ‘হলে গিয়ে তো খাওয়া পাবি না এখন। খাবি কোথায়?’ ‘পপুলারে চলে যাব’—মৃদুস্বরে বলি আমি। পপুলার রেস্তোরাঁ সময়ে-অসময়ে আমাদের খাবারের অন্যতম শেষ ভরসা। ‘না, এ অবেলায় পপুলারে যেতে হবে না। আমাদের ওখানে চল, যা আছে দুজনে ভাগাভাগি করে খাব।’
এইটাই ভয় করছিলাম। এত বন্ধুত্ব সত্ত্বেও ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটিতে আমি যেতে চাইতাম না। অন্য কিছু নয়, শুধু মনে হতো, ওই বাড়ীতে গেলে যদি বঙ্গবন্ধুর সামনাসামনি পড়ে যাই এবং তখন যদি আমি ঠিকমতো আচার-আচরণ না করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা এমন পর্যায়ের ছিল যে শুধু সমীহতার কারণে আমি এটা এড়াতে চাইতাম। কামাল সেটা জানত। সে এটাও জানত যে আমি তার পিতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ভিন্ন কখনই অন্য কোনোভাবে সম্বোধন করিনি। বন্ধুর পিতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আমি কোনো সাধারণ সম্পর্কের মধ্যে কখনই বাঁধতে পারিনি।
কিন্তু কামাল সেদিন জেদ ধরেছিল যে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবেই। কামাল জেদ ধরলে তার থেকে ছাড়া পাওয়া সুকঠিন। সুতরাং তার সাদা ডাটসান গাড়িতে উঠে বসতেই হলো। ‘আমার ঘরেই খাবার আনিয়ে নেব’—গাড়ি চালাতে চালাতে আশ্বস্ত করতে চাইল সে আমাকে। আমি মুখ গোঁজ করে থাকলাম। ‘তাছাড়া’, কামাল বলে চলে, ‘এ সময়ে আব্বা বাসায় থাকলেও বিশ্রাম নেন। তুই সামনাসামনি পড়বি না। ভয় নেই তোর’, আমাকে স্বচ্ছন্দ করার চেষ্টা তার। কী করে বন্ধুটিকে বোঝাই যে এর সঙ্গে ভয়ের কোনো সম্পর্ক নেই, এটা অন্য ব্যাপার।
৩২ নম্বরে কামালের ঘরে পৌঁছার পরে বোঝা গেল ‘তার ঘরে খাবার আনা’র কোনো সম্ভাবনা নেই। তার সে আশ্বাস সুদূরপরাহত। খাবার ঘরেই যেতে হবে। আমার মন বলছিল বিভ্রাট একটা ঘটবেই। হলোও তাই। খাবার ঘরে যাওয়ার জন্য দোতলার চাতালের মতো জায়গায় পা দিতেই বুঝলাম, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ওই বারান্দায় বেতের চেয়ারে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরাচরিত ভঙ্গিতে। তাঁর হাতে জ্বলন্ত পাইপ। সামনের দুটো চেয়ারে বসে আছেন বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও প্রফেসর মুশাররফ হোসেন। সেরনিয়াবাত সাহেব তখন খুব সম্ভবত পানিসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী এবং স্যার সদ্য পরিকল্পনা কমিশন ছেড়েছেন। দুজনের কাছেই আমি পরিচিত—সেরনিয়াবাত সাহেবের কাছে বাবার কারণে এবং প্রফেসর হোসেনের কাছে তাঁর ছাত্র বলে।
সেরনিয়াবাত সাহেব আমাকে দেখেই বললেন, ‘আরে, তুমি এখানে?’ তারপর আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বঙ্গবন্ধুর দিকে ফিরে বললেন, ‘আমাদের প্রফেসর সিরাজুল হক সাহেবের ছেলে।’ বাবার নামটি শুনে বঙ্গবন্ধু আধা মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করলেন। তারপর চোখ খুলে আমার দিকে বললেন, ‘তোমার আব্বার সিভিকস আর ইকোনমিকসের ওপরে দুইটা পাঠ্যবই আছে না?’ আমি হতবাক! আমার মুখে কোনো কথা ফুটল না।
আমার অবস্থা দেখে স্যার বলে উঠলেন, ‘আমার ছাত্র। খুব ভালো ছেলে।’ এবার কামালের পালা। ‘ইকোনমিকসে আমাদের ফার্স্টবয়’, বন্ধুগর্বে কামালের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে যায়। তারপর পাইপের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে স্মিতমুখে আমাকে বললেন, ‘তোমারে একটা কথা জিগাই। ঠিক ঠিক জবাব দেবা কিন্তু।’ ততক্ষণে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। বুঝলাম না কী প্রশ্ন তিনি করবেন। ভাবলাম, যদি ঠিক জবাব না দিতে পারি, তাহলে বাবার বন্ধুকে, আমার বন্ধুকে ও আমার শিক্ষককে কী একটা লজ্জায় ফেলে দেব আমি। আর কী অপদস্থ হব আমি জাতির পিতার সম্মুুখে! নিঃশ্বাস চেপে কোনোক্রমে বললাম, ‘জি।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর কৌতুকভরা চোখ আমার দিকে তুলে রহস্যভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বাবা, তুমি তো ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র। খুব স্বাভাবিক, কামাল তোমার লগে বন্ধুত্ব করতে চাবে। কিন্তু আমারে কও তো ক্যান তুমি কামালের লগে বন্ধুত্ব করতে চাও?’ আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘বন্ধুত্বে অন্য কোনো বিষয়-বিবেচনা গৌণ, বন্ধুতাই মুখ্য।’ এটুকু বলতেই আমার জিভ শুকিয়ে গেল।
আমার জবাব শুনে বঙ্গবন্ধুর মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে গেল। স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুখোড় ছাত্র আপনার।’ তারপর কামাল আর আমাকে সস্নেহ কণ্ঠে বললেন, ‘যা, তোরা খা গিয়া।’ ঘর থেকে বের হতে হতে শুনলাম, তিনি প্রফেসর মুশাররফ হুসেনকে বলছেন, ‘প্রফেসার সাব, পোলাটারে দেইখ্যা রাখবেন।’ তারপর সারা দিন এবং তার পরের দিনগুলো কেমন করে গেল, তা আমার মনে নেই। আমি যেন হাওয়ায় ভাসছিলাম। অপার এক আনন্দে আমার সারা মন ভেসে যাচ্ছিল।
তারপর ৪৫ বছর কেটে গেছে। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, আমার বন্ধু শেখ কামাল নেই, নেই বন্ধু খুকীও। নেই ওদের বহু নিকটজনেরা। বঙ্গবন্ধুকে যেদিন কাছে থেকে দেখেছি, তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তার এক বছরের মধ্যে ঘাতকের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সে যে কত বড় কলঙ্ক আমাদের।
আজ জাতীয় শোক দিবসে সেই হিরন্ময় দিনটির কথা মনে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুকে আমি শুধু একদিনই কাছে থেকে দেখেছি, একদিনই ক্ষণিকের জন্য তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। একদিনই এবং একবারই মাত্র সেটা ঘটেছে। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। ওই একদিনই তো আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি, যার স্মৃতি আমি চিরদিনই হূদয়ে বহন করব।
ড. সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র