কভিড ভয়ের নয়! কভিড জয় হয়

ডা. এ এম শামীম

আন্তর্জাতিক দেশী গণমাধ্যমগুলোতে ডিসেম্বর ২০১৯ থেকেই চায়নার উহান শহরে এক ধরনের জ্বরে আক্রান্তের খবর আসছিল। দেখা গেল জ্বরটি অতি সংক্রামক। দ্রুত একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। যারা বয়স্ক এবং যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম তাদের ঝুঁকি বাড়ল।

২০২০ সাল শুরু হলো একের পর এক দুঃসংবাদ নিয়ে। জানুয়ারিতেই উহান শহরকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলা হলো। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। সংক্রমণ ছড়িয়ে গেল পৃথিবীব্যাপী। গণমাধ্যমগুলোতে ভাইরাসটি নিয়ে নিত্যনতুন খবর আসতে থাকল। সংক্রমিত হতে থাকল ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জামানিসহ অসংখ্য দেশ। মুহূর্তে পৃথিবীতে আক্রান্ত দেশ অঞ্চলের সংখ্যা ২১৫টি।

বাংলাদেশে মার্চ শনাক্ত হলো প্রথম রোগী। ইতালি এবং অন্যান্য দেশ থেকে ফেরা মানুষজন ভাইরাসটি বহন করে এনেছিল দেশে। সংক্রমণের প্রকোপ বাড়তে থাকলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। একে একে বন্ধ হতে থাকল স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সবকিছু। পাশাপাশি বাড়তে থাকল সংক্রমণের হার। মার্চ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে এরই মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে ,৬৩,৫০৩ জন। সারা বিশ্বে এখন রোগীর সংখ্যা কোটি এবং সংখ্যাটা থেমে নেই।

মানুষের জীবন জীবিকা একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। কোনোটিই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। জীবিকা বন্ধ করে কঠোর লকডাউনে সংক্রমণ এড়ানো যেত বলে আমি মনে করি না। অনেকে ভিয়েতনামের কথা বলছেন। তবে কঠোর লকডাউন হওয়ার পরও অনেক দেশ সংক্রমণ মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কিংবা যেকোনো কারণেই হোক বাংলাদেশ যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটি ভয়াবহ বলব না।

প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। তবে এই সংকটে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে সেটি হলো প্রায় ১০০ জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের মৃত্যু। এখনো প্রতিদিন এক-দুজন করে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক মারা যাচ্ছেন। এটি কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। যেটা দুর্ভাগ্যজনক। চিকিৎসকদের সুরক্ষায় আরো যত্নবান হতে হবে।

সম্প্রতি অফিস আদালত রেস্টুরেন্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা শুরু হয়েছে। রাস্তাঘাটে বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে মানুষ। প্রয়োজনের তাদিগে মানুষ বের হচ্ছে। অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে।

এবারের কোরবানির ঈদেও মানুষজন শহর ছেড়ে বাড়িতে গেছে। আবার ফিরে এসেছে কর্মক্ষেত্রে। আগের তুলনায় সংখ্যাটা কম হলেও সামগ্রিক সংখ্যাটা বেশ বড়। গণসংক্রমণের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল সেটি কিন্তু হয়নি।

সামগ্রিক চিত্রে আমরা দেখছি টেস্ট যত হওয়ার কথা সে পরিমাণে হচ্ছে না। টেস্ট কোয়ালিটি নিয়ে বেশ কয়েকটি সেন্টার প্রশ্নবিদ্ধ। রিপোর্ট ঠিক সময়ে মানুষ পাচ্ছে না। যেখানে প্রতিদিন লাখ টেস্ট হওয়ার কথা সেখানে ১০-১২ হাজারের মতো টেস্ট হচ্ছে। এই সংখ্যা আমাদের বাড়াতে হবে এবং টেস্টের মানের ব্যাপারে আরো মনোযোগ দিতে হবে। কভিড সহসা যাবে না। সেজন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। সবাই মিলে মান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে।

করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে সারা পৃথিবী কাজ করছে। ২৪ জুনের খসড়া তালিকায় দেখা গেছে, এখন বিশ্বে টিকা বানাতে ১৪৩টি উদ্যোগ চালু আছে। ১৪৩টি উদ্যোগের মধ্যে ১৬টির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানবদেহে পরীক্ষা চলছে। বাকি ১২৫টি টিকা প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপে আছে। তবে ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাটি। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, অক্সফোর্ডের তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের কার্যকারিতার বিষয়টি আগস্ট মাসের শেষে জানা যাবে। বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষ যে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে, ভ্যাকসিনটি তা থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে কিনা সেটি তখন স্পষ্ট হবে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার দেশই প্রথম করোনার টিকা তৈরি করেছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, টিকাটি স্থায়ী বা টেকসই প্রতিরোধী সক্ষমতা দেখাতে সক্ষম। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় স্পুটনিক- নামের এই টিকা উদ্ভাবন করে দেশটির গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি রাশিয়ার টিকা কতটা নিরাপদ কার্যকর হতে পারে, তা নিয়ে গণমাধ্যমে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কী হবে, সেটি সময় বলে দেবে। যতদিন না কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হচ্ছে নিউ নরমাল জীবনেই আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে।

কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা এখন একটি প্রটোকলে পড়ে গেছে। মৃদু মধ্যম আক্রান্ত রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করছে। তীব্র আক্রান্তদের অক্সিজেনসহ লাগছে বেশকিছু সেট মেডিসিন। সঠিক নার্সিংয়ের মাধ্যমে তাদেরও সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯৯ শতাংশ। তীব্র আক্রান্ত হয়ে যারা বাসায় থাকছে তাদের বেলায় কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার ব্যাপারে এবং পরীক্ষার ব্যাপারে উদাসীনতা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

আমরা দেখেছি, সরকারি হাসপাতালে ৮০ শতাংশ বেড খালি। শুধু কভিডের জন্য তৈরি করা বসুন্ধরা বা অন্য হাসপাতালগুলো প্রায় রোগীশূন্য। অনেকে তীব্রভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরও হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। এটি একটি শঙ্কার কারণ।

উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতাল কভিড চিকিৎসায় একটি মানে পৌঁছেছে। তারা দক্ষতার সঙ্গে হাসপাতাল পরিচালনা করছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনস্বল্পতা, ওষুধ সংকট, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব নেই বললেই চলে। মার্চ-এপ্রিলে কভিড নিয়ে যে হাহাকার উঠেছিল সেটি কমে এসেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের অবদান এখানে অনস্বীকার্য।

পরিশেষে আমি বলব কভিড-১৯ সংক্রমণ আছে, থাকবে এবং একসময় কমেও যাবে। তবে একেবারে চলে যাবে এমনটা বলার সময় এখনো আসেনি। আমাদের সাবধানতা, চিকিৎসার সহজলভ্যতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। আক্রমণের তীব্রতা কমায় আমাদের নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। অদৃশ্য এই জীবাণুকে মানুষের অদম্য শক্তি দিয়ে পরাজিত করতে হবে। এই অশুভ সময়ে হঠাৎ হয়তো কাছের মানুষের মৃত্যুর খবর আসবে, তার পরও জীবন আর জীবিকা থেমে থাকবে না, সবকিছুর ভেতর দিয়ে আমাদের জয়ী হতেই হবে।

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড গ্রুপ

রেডিওলজিস্ট স্বাস্থ্যসেবায় সফল বিনিয়োগকারী

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন