ব্যাংকিং খাত ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

দেশের ব্যাংক খাতের কলেবর সংখ্যার বিচারে বেশ বড়সড়ই বলা চলে। এ খাতে মানুষের আমানত ও ঋণের অঙ্কও নেহায়েত কম নয়।  সবসময়ই পুরো খাতটি নিয়ে আলোচনা-অস্থিরতা বিরাজমান লক্ষ্যণীয়ভাবে। করোনাকালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ খাতের গুরুত্ব আরো বিস্তৃত। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থায়ন ব্যাংকগুলোই করছে বিধায়  খাতটি নিয়ে আলোচনা সঙ্গত কারণেই আরো বেশি হচ্ছে। কিন্তু খাতটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা, সক্ষমতা ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিদ্যমান বাস্তবতায় এর বর্তমান ও পূর্বাপর নিয়ে পর্যালোচনা চলছে দেশের সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপকভাবে।

করোনাপূর্ব ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতিকে ভিত্তিমূল ধরেই করোনাকাল ও করোনা পরবর্তী ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা, বিনিয়োগ, ঋণ প্রদান, ঋণ আদায় সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কার্যক্রম নিতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব কার্যাবলী সহজ নয়।কাঙ্খিত সাফল্যের জন্য এ খাতের সকল অংশীজনদের আন্তরিকতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সক্ষমতার প্রশ্ন যেমন জড়িত, তেমনি সকলের স্বচ্ছ, নৈতিক,ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও অত্যাবশ্যকীয় এবং এর জন্য পুরো কর্মপদ্ধতির সুশৃঙ্খল জবাবদিহিতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য।

আমাদের ব্যাংকগুলো  ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মিলিয়ে করোনাপূর্ব হিসাব অনুযায়ী বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ শতাংশ এর মতো। এর বাইরে রয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা ঋণ।সেগুলোও আদায় অনিশ্চিত মন্দঋণ। 

তাছাড়া আইএমএফ বলছে খেলাপি ঋণ ২৫ শতাংশের নিচে নয়। এর সমর্থনে ‘সানেম’সহ স্থানীয় কিছু গবেষণায় সরাসরি খেলাপি ঋণের প্রদত্ত অঙ্কের সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণ, প্রায় অফেরতপ্রত্যাশী পুন পুন তফসিলকৃত ঋণ, কথিত পুনর্গঠনকৃত বৃহৎ  ঋণ, আদালতের আদেশক্রমে আটকে থাকা ঋণ যুক্ত করলে বিপদগ্রস্ত বা মন্দ ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবী করা হচ্ছে।

 বিতরণকৃত ঋণ ১০ লাখ কোটি টাকার মধ্যে ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি দেয়া আছে, ‘সিএমএসএমই’ বা ‘কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প’ ব্যবসা খাতে। এই খাতটি মাসে ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন ও সেবা যুক্ত করে দেশের উন্নয়নে। জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২৫ শতাংশ।  কর্মসংস্থানের বিপরীতে তাদের প্রদত্ত মজুরি মাসে ৬ হাজার কোটি টাকা।যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশ। অথচ ঋণ সুবিধা প্রাপ্তিসহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার থেকে সিএমএসএমই খাত বঞ্চিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণে খেলাপির গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেলে মামলা ও আদায়কারী গ্রুপের চাপে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর জীবন ও ব্যবসা বিপন্ন হয়ে পড়ে।এদের ক্ষেত্রে এমনও ঘটে চেকের মামলা ও অর্থঋণ মামলা মিলিয়ে ঋণের দেনার অতিরিক্ত এমনকি কয়েকগুণ বেশি পরিমান টাকার মামলার জটে আটকে যেতে হয়। কৃষিজ খাতে, মৎস্যচাষে,পশুপালন খাতেও যৎসামান্য ঋণ জুটলেও ভোগান্তির চিত্র প্রায় একই। ঋণ প্রদানের নিয়মের নিগড় ও খড়গ এরূপ সিএমএসএমই শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের বেলায় প্রযোজ্য হয় বেশি। খাতটির অবদান ও গুরুত্ব বিবেচনায় ঋণ প্রাপ্তি ও পরিশোধ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে তদারকি কমিটি বা কমিশন করে দেয়া যেতে পারে।

অপরদিকে ভিন্ন চিত্র কথিত বড় খেলাপি ও চাঞ্চল্যকর অনিয়মের ঋণের ক্ষেত্রে। খেলাপি ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ ই তাদের কাছে। এরা ঋণ পরিশোধ করে না ও পুনতফসিল-পুনর্গঠনের সুবিধা পায় এবং এদের  আদালতে যাওয়ার সক্ষমতাও থাকে। এই সকল কথিত বড়রা সবরকম সুবিধা ভোগ করে প্রভাব বলয়ের মধ্যে বহাল তবিয়তে প্রতাপের সঙ্গে সমাজে থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, ‘সরকার কোনোভাবেই বড় খেলাপিদের ধরতে পারছে না।এই ঋণই অর্থনীতিকে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে’।

ব্যাংক খাতের ঋণের প্রাধিকারভোগী আরেকটি অভিজাত শ্রেণী আছেন ব্যাংকের মালিকগণ।এই নিয়ে ‘সানেম’ এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের দেয়া তথ্যানুযায়ী-‘দেশে ব্যাংক খাতে যত ঋণ আছে তার ১১ দশমিক ২১ শতাংশ বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে।২৫ টি ব্যাংকের পরিচালকেরা তাদের নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা, অন্যান্য ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। আমরা যদি ঋণ খেলাপির তালিকাটি দেখি তাহলে দেখবো যারা বড়, তারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। ব্যাংক কাঠামোর দুর্বলতাও তাদের সুযোগ করে দিয়েছে। 

আর  চাঞ্চল্যকর বড় বড় অনিয়মের ঋণের দরুণ ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত আরো বেশি বিপাকে পড়ে গেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে বিসিসিআই ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, আল-বারাকা ব্যাংক,এই দশকে কয়েকটি সরকারী ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক এবং বিএফআইসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর বড় অনিয়মের ঘটনাগুলো ইতোমধ্যে সকলেরই গোচরীভূত।

 সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘শত শত কোটি টাকার মন্দঋণ অনাদায়ী রেখে বেশ কয়েকজন রাঘববোয়াল ঋণ খেলাপি মারাও গেছেন, অন্যরা বিদেশে ভেগে গেছেন। কেউ কেউ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, ব্যবসা, রাজনীতি, ব্যাংকের পরিচালক হওয়াও বাদ যায়নি। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি কালচার সযতনে লালন হচ্ছে।’

 এছাড়া, আদায় অনিশ্চিত অবলোপনকৃত ঋণ একটা অদ্ভুত অবস্থানের ঋণ । ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে নেই কিন্তু আলাদা একটি লেজারে আছে। খেলাপি ঋণের মূল হিসাবে নেই, কিন্তু মন্দ ঋণ এগুলো। খাতক খেলাপি, মামলা চলে, ব্যাংকের টাকা আদায় হোক বা না হোক, ব্যাংক ও খাতকের বিড়ম্বনা ও ব্যয় চলতে থাকে। এ ঋণ পুনতফসিলকরণ নীতিমালায় নেই। এরূপ ক্ষেত্রের সদিচ্ছাবান খাতকের ব্যবসায়  ফিরে আসার পথ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী ৫৬ হাজার কোটি টাকার অবলোপনকৃত এই ঋণ আদায়ের স্থায়ী অনিশ্চয়তা তৈরি হয়ে আছে। এই বিশাল মন্দ ঋণের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব ঋণ সমঝোতায় নিষ্পত্তির জন্য কমিটি করে সমাধানের পথ খোঁজা যায়।

 ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের খেলাপি ঋণ বা বিপদাপন্ন ঋণের এই চিত্র  ও সার্বিক কর্মতৎপরতা মানুষকে আশান্বিত করে না। বরং দেশের ব্যবসা-অর্থনীতি সচল রাখতে ও করোনার অভিঘাত সামলে নিতে এই খাতের সক্ষমতা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় আছে। 

বিগত ফেব্রুয়ারিতে করোনার প্রাক্কালে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমরা নাগরিকেরা এখন অসহায় আতঙ্ক নিয়ে ভয়ংকর ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি’।

ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, সংস্কার, তদারকি, শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা নিয়ে কথা হয়, উদ্যোগও নেয়া হয়, সদিচ্ছার আন্তরিক অভিপ্রায়ও ব্যক্ত হয় বিশ্বাসযোগ্যভাবেই দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না!  প্রতিফলন দৃশ্যমান হয় না। 

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কারণে ও বড় বড় অনিয়মের সুবিধাভোগীর দরুণ ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি নষ্ট হয়েছে। এরূপ টাকাই সিংহভাগ হলেও এর সঙ্গে  জড়িতরা কিন্তু সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদে ব্যাংক খাতের ঋণ প্রদান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে কারা ইচ্ছাকৃত এবং কারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি সেসব চিহ্নিতকরণ মোটেই জটিল কিছু নয়।

 ভালো, সৎ উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপের দায় থেকে বের করার কার্যকরী উপায়ও ব্যাংকাররা প্রয়োজনে যোগ্য পরামর্শকদের সহযোগিতায় বের করতে পারবেন এবং এটি করা গেলে সিএমএসএমই খাতের বিপদে পড়া ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যবসার খাতে টিকে থাকতে পারবে। এর ফলে পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা অনুযায়ীই দেশের অর্থনীতির  সার্বিক উন্নতির পথই  প্রশস্ত হবে। আর ইচ্ছাকৃত খেলাপি ও অনিয়মের ঋণের বিষয়ে সর্বোচ্চ কঠোরতায় ঋণ আদায় কার্যক্রম প্রভাবমুক্তভাবে ত্বরান্বিত করার জন্য শক্তিশালী কমিশন বা কমিটি করা গেলে খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা অসম্ভব নয়। 

সকল প্রকার মন্দ ঋণ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ, চাঞ্চল্যকর অনিয়মের বড় বড় ঋণ, অবলোপনকৃত ঋণ, অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ আদায়ে বাস্তবানুগ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে  ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানখাতের দুর্বলতা, সংশয় ও অস্থিরতা কমাতে হবে। আনতে হবে বিশ্বাসযোগ্য স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা। সক্ষমতা বাড়াতে হবে দৃশ্যমানভাবে। তবেই ভালো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। একই সঙ্গে সকলের আন্তরিক, দায়িত্বশীল, প্রভাবমুক্ত ভূমিকা ও অবদান নিশ্চিত করা গেলে স্বাভাবিকভাবেই করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভবপর হবে।


মোতাহার হোসেন চৌধুরী

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন