তুরস্কের ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় আড়াল করছেন এরদোগান

বণিক বার্তা ডেস্ক

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান রাজনৈতিক সংস্কার চটকদার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুপরিচিত। সেই তুলনায় তার অর্থনৈতিক সংস্কার উদ্যোগগুলো বরাবরই আলোচনার বাইরে রয়ে যায়। কয়েক বছরে এরদোগান সরকার তুর্কি অর্থনীতিতে এমন কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, এমন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন, যেগুলো দেশটির সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত তুরস্কের ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের দিকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চ্যালেঞ্জকে এরদোগান সুকৌশলে আলোচনার বাইরে রেখেছেন। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, কতদিন তিনি সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়িয়ে চলতে পারবেন? একদিন না একদিন সেটা প্যান্ডোরার বাক্সের মতো খুলে যাবে। তুর্কি ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়বে।

সাধারণত আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হয়ে গেলে যেকোনো দেশ বাজেট ঘাটতিতে পড়ে। সংকট থেকে উত্তরণে ইস্যু করা হয় বন্ড। বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারে সহজলভ্য বন্ড বিক্রি করে বাজেটে ভারসাম্য ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। একসঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা থাকে। কোনো কারণে ঋণের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে গেলে দেশটি বেলআউটের পথে হাঁটে। এর আগে আর্জেন্টিনা, গ্রিস পাকিস্তান এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে। তুরস্কের সংকট অনেকটা একই রকম। একদিকে জাতীয় বাজেটে ঘাটতি, অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের বোঝা তুরস্কের অর্থনীতিতে ক্রমেই চাপ বাড়াচ্ছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে ক্যারিশম্যাটিক নেতা এরদোগানের হাত ধরে তুরস্কও ধীরে ধীরে আর্জেন্টিনা কিংবা গ্রিসের পথে এগোচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার তুলনামূলক কম রেখেছে। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এটা করতে গিয়ে মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের মূল্যমান অনেকটাই কমেছে। ফলে মূলধন সংগ্রহের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহজেই ডলার কেনা যাচ্ছে। তুরস্কের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুবিধা কাজে লাগিয়ে অপরিকল্পিতভাবে সস্তায় প্রচুর ডলার সংগ্রহ করেছে।

এরপর তুরস্কের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দুটো কৌশল হাতে নিয়েছে। প্রথমত, তারা এসব ডলার সহজ শর্তে তুরস্কের আর্থিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধার দিয়েছে। বিশেষত দেশটির পর্যটন, জ্বালানি, অবকাঠামো নির্মাণ আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প সুদ সহজ শর্তে ঋণ পেয়েছে। তবে তাদের স্থানীয় মুদ্রা লিরার বদলে ডলারে ঋণ দেয়া হয়েছে। সুদের হার কম থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানও ঋণ নিতে কার্পণ্য করেনি। সমস্যা তৈরি হয়েছে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা, রাজস্ব আয়, মুনাফাসব লেনদেন হয় তার্কিশ লিরায়। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে। কয়েক বছর ধরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার অব্যাহত দরপতন তাদের গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বড় ধরনের ঋণখেলাপির। আর এভাবে ক্রমেই ভয়াবহ সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তুরস্কের ব্যাংকিং খাত।

শুরুর দিকে অনেক টার্কিশ প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি ডলারে ঋণ নিতে আগ্রহী ছিল না। বিশেষত যারা বাড়ি কিংবা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ খুঁজছিল, তারা লিরায় ঋণ চেয়েছিল। তাদের জন্য তুরস্কের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সস্তায় সংগ্রহ করা ডলার লিরায় রূপান্তর করে ঋণ সরবরাহ করেছে। এজন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ফি পরিশোধ করতে হয়েছে। এটাও তুরস্কের ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে। এখন কোনো কারণে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ায় তাহলে ডলার থেকে লিরায় রূপান্তরের ফি বেড়ে যাবে, যা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বহন করতে হবে। এতে তুরস্কের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফায় পতন ঘটতে পারে।

করোনা মহামারী বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দার ঝুঁকিতে ফেলেছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ তুরস্কও মহামারীতে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। গত মার্চ-এপ্রিলে মুদ্রাবাজারে লিরা অন্তত ১০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। লিরার দরপতনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রাষ্ট্রের আমদানি ব্যয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় কমেছে তুরস্কের মানুষের জীবনযাত্রার মান। পরিস্থিতিকে তুরস্কের অর্থনীতির জন্যকালো অধ্যায়হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরদোগান সরকার লিরার আরো দরপতন রোধে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এজন্য খোলাবাজারে ডলার বিক্রি করে লিরা কেনা হচ্ছে। এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। জুন-জুলাইয়ে লিরার মূল্যমান আগের তুলনায় বাড়তির দিকে ছিল। তবে এর পূর্ণাঙ্গ সুফল ততদিন পাওয়া যাবে, যতদিন দেশটির সরকার লিরার বিপরীতে ডলারের জোগান দিতে সক্ষম থাকবে।

পরিস্থিতিতে নজিরবিহীন একটি উদ্যোগ নিয়েছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি নিজ দেশের ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনা শুরু করেছে। এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে হাজার ৪০০ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গোল্ডম্যান স্যাকসের নোটে বলা হয়েছে, তুরস্কের সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গত বছর হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছিল। চলতি বছর এরই মধ্যে এর পরিমাণ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।

অন্যদিকে স্বর্ণ কাতারি রিয়ালে বিনিয়োগ বাড়ানোয় তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রায় হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিটের ঘাটতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নয়। বিপদ হলো করোনাকালে মুদ্রাবাজারে লিরার অবস্থান সহসা আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং লিরার রেকর্ড পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি তুরস্কের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অথচ ঐতিহাসিক স্থাপত্য হায়া সোফিয়াকে গির্জা থেকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের পর এরদোগানের রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রপাগান্ডা নিয়ে বিশ্বজুড়ে যতটা আলোচনা হচ্ছে, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি ঠিক ততটাই আড়ালে রয়ে যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আগামী দিনগুলোয় পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? আর এতে এরদোগানের ভবিষ্যৎই বা কী হবে? বিশ্লেষকদের ভাষ্য, করোনাকালে যদি মুদ্রাবাজারে লিরার দরপতন অব্যাহত থাকে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ডলারে ঋণ পরিশোধের চাপে হাবুডুবু খায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ভাটা পড়ে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়াতে বাধ্য হয়, তাহলে তুরস্কের অর্থনীতিকে মন্দার কবল থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি এরদোগানের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা কমারও সম্ভাবনা রয়েছে। দুটো বিষয়ই তুরস্ক এরদোগানের জন্য বিপদের। যতই আড়ালে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভার একসময় গিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক ক্যারিশমা দিয়ে ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির বিপর্যয় সামাল দেয়ার চেষ্টা এরদোগানের সামনে বিপদ বাড়াতে পারে।

ফরেন পলিসি অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন