পিপলস লিজিং কোম্পানি থেকে আত্মসাৎ করা রিলায়েন্স ফিন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) ও তার সহযোগীদের ৩ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। টাকাগুলো জব্দ করার জন্য ১০ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।
দুদকের তথ্যমতে, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে ৩৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন পিকে হালদার। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকা ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কৌশলে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি ও তার সহযোগীরা, যা এখন দুদক তদন্ত করছে। এর অংশ হিসেবে আদালতের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব অর্থ জব্দ করেছে দুদক।
পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করে ওই কোম্পানিকে পথে বসিয়েছেন পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা। অর্থ আত্মসাতের বিভিন্ন নথিপত্র পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং রিলায়েন্স ফিন্যান্সের এমডির কাছে চিঠি পাঠিয়ে সংগ্রহ করেছেন দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। এছাড়া অর্থ আত্মসাতে ব্যবহূত বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্যও সংগ্রহ করেছে দুদক। বিএফআইইউ থেকে পিকে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাত্সংক্রান্ত নথিপত্র এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব তথ্যের ভিত্তিতেই আদালতে এসব অর্থ জব্দের আবেদন করে দুদক।
পিকে হালদার এখন পর্যন্ত ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন লিজিং প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ বের করে নিয়েছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তার ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠানের খোঁজ এখন পর্যন্ত দুদক পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে—বিআর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, নিউ টেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, আরবি এন্টারপ্রাইজ, আনন কেমিক্যাল, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, আর্থস্কোপ লিমিটেড, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, কোলাসিন লিমিটেড, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড, ওক্যাইমা লিমিটেড, জিঅ্যান্ডবি এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, মুন এন্টারপ্রাইজ, কনিকা এন্টারপ্রাইজ, সিগমা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, আইমেক্সকো, সুখাদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, সন্দ্বীপ করপোরেশন, উইনটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেড, এমওএইচ ফ্যাশন লিমিটেড, এসএ এন্টারপ্রাইজ, শাহাদাত ট্রেডার্স, সাবির ট্রেডার্স, গ্রিনলাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণ, রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড, ক্রসরোড করপোরেশনস লিমিটেড, তামিম অ্যান্ড তালহা ব্রাদার্স লিমিটেড, ডিজাইনস অ্যান্ড সোর্স লিমিটেড, জেডএ অ্যাপারেলস, সুপিরিয়র টেক্সটাইল, নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড সিমটেক্স টেক্সটাইল লিমিটেড ও এমজে ট্রেডিং।
এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণের বিভিন্ন নথি তলব করে ১২ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে চিঠি দিয়েছে দুদক। চিঠিতে এ-সংক্রান্ত আর কারো অনুকূলে ঋণ বিতরণ করা হলে সেসব ঋণের গ্রাহকের কেওয়াইসি, ঋণের প্রস্তাব, শাখার ঋণসংক্রান্ত প্রস্তাব, ক্রেডিট কমিটির অনুমোদন, বোর্ড মেমো চাওয়া হয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়ার বিষয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এভিপি আল মামুন সোহাগ ও সিনিয়র ম্যানেজার মো. রাফসান রিয়াদ চৌধুরী। এ দুজনকে ২৫ আগস্ট দুদকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে চিঠি পাঠিয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
এছাড়া এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের পরিচালক স্বপন কুমার মিস্ত্রি ও কাজী মমরেজ মাহমুদকে নোটিস দেয়া হয়েছে। হাল ইন্টারন্যাশনালের এমডি হলেন সুস্মিতা সাহা, পরিচালক প্রিতিশ কুমার হালদার ও অমিতাভ অধিকারী। তাদের ১৮ আগস্ট দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে। একই দিনে হাজির হতে নোটিস পাঠানো হয়েছে আনন কেমিক্যালের পরিচালক উজ্জ্বল কুমার নন্দী, অনিতা করকেও। আর ১৯ আগস্ট জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হতে বলা হয়েছে আরবি এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর রতন কুমার বিশ্বাস ও রেপ্টাইলস ফার্মের চেয়ারম্যান শিমু রায়কেও।
এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ হাশেম, সাবেক এমডি রাশেদুল হকসহ বর্তমান বোর্ড অব ডিরেক্টরদের বক্তব্য দেয়ার জন্য শিগগিরই নোটিস পাঠানো হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
অবৈধ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত সম্পদের বেশির ভাগই বিদেশে, বিশেষ করে কানাডায় পাচার করেছেন প্রশান্ত হালদার। বর্তমানে নিজেও বিদেশে অবস্থান করছেন তিনি। তবে ঢাকায় তার নামে একাধিক বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে এবং নামে-বেনামে একাধিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রথম যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে, তাদের মধ্যে প্রশান্ত কুমার হালদার ছিলেন একজন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত বছরের ১৪ নভেম্বর ও চলতি বছরের ১০ আগস্ট হাজির হতে নোটিস পাঠিয়েছিল দুদক। তবে ৩ অক্টোবর বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই তিনি দেশ ছাড়েন বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। মামলার এজাহারে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।