বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সুলুক সন্ধানে

বণিক বার্তা ডেস্ক

সার্স-কোভ- ভ্যাকসিনের সন্ধান করা বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মুহূর্তে একমাত্র লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আর কোনো রোগ নিয়ে এতটা অবিচল মনোযোগ দেখা যায়নি। জনগণ বিশ্বাস করে যেকোনো কার্যকর টিকা পাওয়া গেলেই কেবল মহামারীটি কমবে।

কতগুলো ভ্যাকসিন বর্তমানে পরীক্ষা করা হয়েছে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে বর্তমানে অন্তত ২৮টি ভ্যাকসিন বিশ্বব্যাপী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। যার মাঝে চারটির সফলভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে। যা এখন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে বিস্তৃত পরীক্ষা কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য। এছাড়া আরো ১৫০-এর বেশি ভ্যাকসিন এখন বিকাশের প্রথম পর্যায়ে আছে।

ভ্যাকসিনের ওপর আমাদের রয়েছে অগাধ বিশ্বাস। কারণ অনেক বছর ধরে এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মানবঘাতী রোগগুলো নির্মূল হয়ে আসছে। ভ্যাকসিনগুলো কেন নিরাপদ এবং সংক্রামক মহামারী থেকে বের হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল? কারণ, কয়েক দশক না হলেও এগুলো সাধারণত কয়েক বছর ধরে গবেষণা বিকাশের অধীনে থাকে।

যাই হোক, কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে সময় নষ্ট করা বিলাসিতার ব্যাপর। তবু বড় বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারীরা ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার আগে অন্তত ১২ থেকে ১৮ মাস সময়ের কথা বলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সম্ভাবনাগুলো বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। যদিও এই সময়সীমার মাঝে ভ্যাকসিন অর্জন করতে পারাটা একটি বিশাল ব্যাপার হবে। পাশাপাশি এই সম্ভাবনাও আছে যে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার স্তর যতটা আশা করা হচ্ছে ততটা নাও হতে পারে।

গবেষকরা অনেকগুলো প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন প্রোটিন তৈরির জন্য যা কিনা মূল ভাইরাসের এস প্রোটিনের মতো দেখতে, কিন্তু তার ক্ষমতা আছে হোস্টের ইমিউন সিস্টেমকে লক্ষ করে অ্যান্টিবডি নিউট্রোলাইজ করার এবং মেমোরি টি সেলের প্রতিক্রিয়াকে প্ররোচিত করার।

যেহেতু ভ্যাকসিনটি কোটি কোটি স্বাস্থ্যবান মানুষকে সরবরাহ করতে হবে, তাই তাদের বিকাশের পথ প্রায়ই শক্তিশালী সময়সাপেক্ষ হয়। মানুষের শরীরে বিস্তৃতভাবে পরীক্ষার আগে এর সুরক্ষা কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার জন্য একে ব্যাপকভাবে প্রাণিদেহে পরীক্ষা এবং অধ্যয়ন করা জরুরি। এরপর এর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা দেখার জন্য খুব মনোযোগ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

চলমান বেশকিছু ট্রায়ালের মাঝে কয়েকটি যথেষ্ট এগিয়ে আছে। এর মাঝে একটি ভ্যাকসিন হচ্ছে সিএইচএডিওএক্স১, যা ডিজাইন করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং তৈরি করেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এটি তৈরি করা হয়েছে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাস থেকে, যা কিনা শিম্পাঞ্জির সর্দিজ্বরের কারণ। এটি এতটা ব্যাপক আকারে পরিবর্তিত করা হয়েছে যেন মানবদেহে কোনো ধরনের সংক্রমণের কারণ না হয়। যুক্তরাজ্যের ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী হাজার ৭৭ জন স্বেচ্ছাসেবীর মাঝে দৈবচয়নে করা নিয়ন্ত্রিত ট্রায়ালের প্রথম দ্বিতীয় পর্যায়ের ফল প্রকাশ করা হয়েছে, যা কিনা এখন পর্যন্ত বেশ প্রতিশ্রুতিশীল। যদিও এটা যথেষ্ট নিরাপদ সুরক্ষিত কিনা তা নির্ণয় করার সময় এখনো আসেনি।

নানা দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিবর্তনশীল বয়সের মানুষের মাঝে এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে। এছাড়া এখানে আরো কিছু সম্ভাবনাময় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে। যেখানে চীনের সিনোভ্যাক জার্মানির ফাইজার বায়োনটেক উল্লেখযোগ্য। দুটি কোম্পানিও ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে। 

এছাড়া আরো একটি ভ্যাকসিন বেশ প্রতিশ্রুতিশীল, যা আবিষ্কার করছে ইউএস বায়োটেক ফার্ম মর্ডানা। এটি সব স্বেচ্ছাসেবীর মাঝে যারা কিনা এই ভ্যাকসিনের উচ্চ ডোজ গ্রহণ করেছে তাদের ভালো সুরক্ষা প্রোফাইল প্রকাশ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ১০০ মাইক্রোগ্রাম ডোজ উচ্চ মানের নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডি এবং শক্তিশালী মেমোরি টি সেলের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এই ভ্যাকসিনও এখন তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে।

এদিকে ভারতও আন্তর্জাতিক মানের ভ্যাকসিন প্রস্তুতের ক্ষেত্র। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ভ্যাকসিনের চাহিদা পূরণ করে দেশটি। পুনেভিত্তিক সেরাম ইনস্টিটিউট অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপুল পরিমাণের ভ্যাকসিন ডোজ তৈরি করছে। তারা  ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে  ১৪০০ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করেছে।

পাশাপাশি অন্তত সাতটি দেশীয় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানি ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ে  ট্রায়ালে আছে। যারা মাঝে দুটি ভারত বায়োটেক জায়ডোসকাডিলা এরই মধ্যে প্রাক-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন করে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে।

এই প্রক্রিয়ার জটিল দিকটি প্রোটিন তৈরি করা, যা কিনা মূল ভাইরাসের কাছাকাছি হবে এবং যার বিরুদ্ধে শরীর ভাইরাসটিকে নিউট্রোলাইজ করার জন্য অ্যান্টিবডি বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবে। কিন্তু যেকোনো ধরনের বিচ্যুতি অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট (এডিই) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্লকিং ফ্যাক্টর-এর দিকে চালিত করে। সাধারণত বলা যায় ধরনের অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে নিউট্রোলাইজ করার পরিবর্তে সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করতে পারে। যাকে বলা হয় ফেক ভ্যাকসিন। যা সুরক্ষা দেয়ার পরিবর্তে সুপ্তভাবে প্রাথমিক সংক্রামকের কাজ করে।

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেছে। এটা করা হয় মূলত কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের বিজ্ঞান নৈতিকতাবিষয়ক ধারণা আলোচনার জন্য। যেখানে বেশির ভাগ বক্তা গতি, মানবাধিকার এবং সবকিছুর বিনিময়ে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ নৈতিক অনুশীলনের কথা বলেন। তারা সেখানে ন্যায়সংগত প্রাপ্তির জন্য নতুন নীতি পদ্ধতি গ্রহণের কথা বলেন, যেন আগামী গ্রীষ্মের আগেই ভ্যাকসিন সহজলভ্য হয়।

তবে কভিড-১৯ কে দূর করতে প্রকৃত ভ্যাকসিন উপলব্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের ভাইরাসের গতি শ্লথ করার কাজটিতে সহায়তা করতে হবে। সামাজিক দূরত্বের নীতি মেনে চলা, জনপরিসরে মাস্ক পরা এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাসগুলোকে বজায় রাখতে হবে।

হিন্দুস্তান টাইমস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন