রিয়েল ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস

কভিড এবং কমনসেন্স

কৌশিক বসু

কভিড-১৯-এর তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটিকে নিয়ে আমাদের বোঝাপড়ারও উন্নতি ঘটছে। পদার্থবিজ্ঞানবিষয়ক জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা যেমন জানি অ্যারোসল কীভাবে বাতাসে ভেসে থাকে, তেমনি মহামারীসংক্রান্ত বিদ্যা দিয়ে আমরা জেনেছি করোনাভাইরাসটি কীভাবে কাজ করে বা এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী। আমরা আরো জানতে পারছি কভিডের জীবাণু কীভাবে নতুনদের সংক্রমিত করছে। আমাদের এই বোঝাপড়াটা আশা জাগিয়ে তুলছে যে আমরা শিগগিরই আরো কার্যকরভাবে মহামারী মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। তবে এটি সামাজিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক নিয়ম-নীতি আইনগুলোর মধ্যকার বিতর্কিত কিছু পরিবর্তনের কথাও বলছে।

চীনের উহান থেকে মহামারীটির বিস্তার লাভ এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর -বিষয়ক জোর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে যে সরকারগুলোর এক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সরকারি কর্মকর্তা পুলিশদের কীভাবে কাজে লাগানো উচিত এবং কোন বিষয়গুলোকে সামাজিক নিয়ম হিসেবে প্রচার করা উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে, -বিষয়ক তর্কটি এতটাই মেরুকৃত হয়েছে যে মানুষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে অবিলম্বে ডানপন্থী বামপন্থী হিসেবে বিভক্ত হয়ে গেছে। যেহেতু সাধারণ মানুষ এভাবে নিজেকে একটি শ্রেণীতে ফেলতে পছন্দ করে না, অবশ্যই ভুলভাবে নয়, তাছাড়া অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিতে নিজেকে প্রকাশ করতে নারাজ।

এমনকি নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে আমাদের প্রয়োগযোগ্য আইনের প্রয়োজন। বিশেষ করে মহামারী শুরুর দিনগুলোয়, লোকেরা যখন খুব যৎসামান্যই ভাইরাসটি সম্পর্কে ধারণা রাখত, সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা পছন্দের ওপর ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাপকাঠি নির্ধারণ করাটা ভীষণ বোকামি হয়েছিল। কেননা কিছু লোক তখন মাস্ক ব্যবহারের পরোয়া না করেই একটি জায়গায় জড়ো হলো। এতে কিছু দেশে ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। পর্যায়ে আমরা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদাহরণ টানতে পারি।

তবে চরম অবস্থায় মধ্যে আমাদের আচরণ পরিবর্তনের জন্য এককভাবে সরকারগুলোকে দায়বদ্ধ করার বিষয়টিও কিন্তু সমান বিপজ্জনক। বিশেষত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিপক্ষকে গ্রেফতার করা এবং ভিন্ন মত প্রকাশকারীদের দমনের জন্য মহামারীকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দায়বদ্ধ। তবে অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই স্বজনতোষী পুঁজিবাদের দিকে অগ্রসরের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত, যেখানে হাতেগোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা হ্রাস মজুরি শোষণ করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে। সামাজিক নিয়মগুলো অনেক সময় সরকারি আদেশের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকরী হয়। কারণ এগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নমনীয়তা অনুমোদন করে, সরকারি বিধিবিধানগুলো তা সরবরাহ করতে পারে না। যেমন ইথিকার ফরেস্ট হোম ড্রাইভে একটি সেতু রয়েছে, সামাজিক রীতিনীতি ক্রীড়া-কৌশল শেখার জন্য এখানে চলাচল করাটা বেশ উপযোগী। এর সঙ্গে অবশ্য উইলিয়াম ফার্গুসনেরকালেকটিভ অ্যাকশন এবং এক্সচেঞ্জবইটিও পড়তে হবে। যাই হোক, সেতুটির কথা বলছিলাম, কারণ এটি এতটাই সংকীর্ণ যে দুই দিক থেকে দুটো গাড়ি একসঙ্গে পার হতে পারে না। ট্রাফিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে আইন দ্বারা এটিকে একমুখী সেতু হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে কিংবা সকালের সময়টায় গাড়িগুলো শুধু বাম থেকে ডানে আর সন্ধ্যার দিকটায় ডান থেকে বামে যাতায়াতের নিয়ম বেঁধে দেয়া যেতে পারে; অথবা এমন আইন করা যেতে পারে যে বাম থেকে ডান দিককার একজন চালক সেতুটি পার হওয়ার পর বিপরীত দিকের চালককে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এভাবে একটি একটি করে উভয় দিকে গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করলে অবশ্য প্রতিবারই কোনো গাড়ির পেছনে অন্য কোনো গাড়ি থাকে না এবং সময় নষ্ট হয়।

তাই এখানে কোনো রকম ট্রাফিক আইন ছাড়াই গাড়িগুলো যেভাবে যাচ্ছে, সেটাই ভালো। নিয়ম এমন যে একই দিক থেকে আসা তিন কিংবা চার নম্বর গাড়ি সেতুটি পার হওয়ার পর পেছনের চালক থেমে যান এবং বিপরীত দিকে অপেক্ষায় থাকা গাড়িগুলোকে আসার সুযোগ করে দেন। অলিখিত নিয়ময় অনেকটা আইনের মতোই। তবে এটি কঠোর নয়, নমনীয়। কেউ যদি খুব তাড়ায় থাকে, তবে সে নিয়মটির ব্যত্যয়ও করতে পারে। বিপরীত দিকের গাড়িগুলোকে কয়েক সেকেন্ড সময়ের জন্য অপেক্ষায় রেখে পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠতম চালক হিসেবে সে সেতুটি পার হতে পারে। 

আমরা যেমন এখন কভিড-১৯-এর পাশাপাশি ভাইরাস কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সে-সম্পর্কিত বিষয়গুলো বুঝতে পারি। তাই আমরা নিজ থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে আমাদের কখন কতটা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। ছয় ফুট ( দশমিক মিটার) দূরত্ব রেখে চলার নিয়মটি হয়তো নমনীয় করার প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি অত্যধিক লম্বা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে থাকেন কিংবা এমন কারো সঙ্গে আলাপ করতে থাকেন যে তার চিবুকটি খানিকটা উঁচু করে কথা বলছে, সেক্ষেত্রে আপনাকে তার থেকে আরো এক ফুট বেশি দূরত্ব রেখে দাঁড়াতে হবে, যাতে তার মুখ থেকে নির্গত ড্রপলেট থেকে আপনি আক্রান্ত না হন।

এজন্য আমাদের একটি পরিচ্ছন্ন যুক্তিযুক্ত গাইডলাইন তৈরি করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে লোকেরা তাদের আচরণে ভারসাম্য আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি একটি গবেষণায় বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে, গবেষণাটি করেছেন সানফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিকা গান্ধি তার সহযোগী গবেষক। তারা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, আপনি যদি কভিড-১৯ পজেটিভ হন, সেক্ষেত্রে ফেসমাস্কের ব্যবহার আপনার বহন করা জীবাণু থেকে অন্যদের সুরক্ষিত করার পাশাপাশি আক্রান্ত অন্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে আপনাকে আরো বেশি সংক্রমিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। তাই আমাদের ফেসমাস্ক ব্যবহারের সামাজিক ব্যক্তিস্বার্থগত উভয় কারণই বিদ্যমান। কিন্তু আপনি যদি একলা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যান, সেক্ষেত্রে মাস্ক না পরার যথার্থ কারণ রয়েছে। এছাড়া আপনি যদি কারো সঙ্গে অবস্থান করেন বা একসঙ্গে থাকেন, সেক্ষেত্রেও মাস্ক না পরার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য, কেননা পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে বিষয়টি এমন যে হয়তো সবাই- সংক্রমিত কিংবা কেউই ভাইরাসটি বহন করছে না।

কভিড-১৯ সম্পর্কে আরো বেশি জানার মধ্য দিয়ে নিজেদের জন্যই আমরা আরো ভালো নিয়ম তৈরি করব। তবে পর্যায়ক্রমে দুটো বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। প্রথমত, মহামারীবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছে যে নির্দিষ্ট অনুসন্ধানবিষয়ক কার্যকারিতা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাস্তবে আমরা কার্যকারিতার বিষয়টি কখনই শতভাগ প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। সংশয়বাদ সচেতনতার একটি মাত্রাসহ আমাদের অবশ্যই -জাতীয় সব দাবিকে বিবেচনা করতে হবে, যেন পরবর্তীতে আমরা তা সংশোধন করতে পারি।

আইনের শক্ত হাতে সামাজিক রীতিনীতিগুলোর ক্ষেত্রে নমনীয়তাকে প্রাধান্য দেয়ার অন্যতম কারণ এটি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা এখন জানি যে নভেল করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ হচ্ছে না। যে সমাজের স্বল্প কিছু লোক মাস্ক ব্যবহার করছে, সেখানে লক্ষণহীন ভাইরাস বহনকারীর সংখ্যা ৯০ শতাংশেরও বেশি হতে পারে, অরিগনে প্রাদুর্ভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে। লক্ষণহীন ভাইরাস বহনকারীরা যদি মাস্ক ব্যবহার না করে, সেক্ষেত্রে তাদের অপ্রকাশিত লক্ষণগুলো আমাদের আরো বেশি অরক্ষিত করে তোলে। তাছাড়া বিষয়টি আরো একটি ইঙ্গিত প্রদান করে যে মাস্কের ব্যবহার কভিড-১৯-কে আরো বেশি ছড়িয়ে দেয়ার পরোক্ষ কারণ হতে পারে।

এটি কিন্তু অবশ্যই মাস্ককে উপেক্ষা করার পক্ষের কোনো যুক্তি নয়। বরং আমরা যেসব ধারণা বহন করে চলেছি, সে-সম্পর্কিত বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেয়া। আমাদের এসব ধারণার উৎসমূল লোককাহিনী কিংবা বিজ্ঞান যা- হোক  না কেন, আমাদের নিজেদের আচরণগুলোকে ইতিবাচক করতে কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ ভীষণ জরুরি।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ  আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন