চার বছর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কেনেথ রগফ কাগুজে মুদ্রা ধাপে ধাপে নিঃশেষ করার একটি শক্তিশালী ডকুমেন্ট তৈরি করেছিলেন। তার বই ‘দ্য কার্স অব ক্যাশ’-এ রগফ আলোচনা করেছেন যে বেশি কাগুজে মুদ্রা, বিশেষত উচ্চমূল্য নির্দেশক ব্যাংক নোটগুলো কর ফাঁকি সহজতর করা এবং মাদক ব্যবসায় শক্তি জুগিয়েছে সরবরাহ নিগড়কে সব রকমের অবনমন করার মাধ্যমে। একটি ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে যে লন্ডনে পরীক্ষা করা ৫০০টি ব্যাংক নোটের মধ্যে কেবল চারটিতেই কোনো কোকেনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
অধিকন্তু, ক্যাশের অস্তিত্ব মুদ্রানীতিকে বাধাগ্রস্ত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণাত্মক সুদহার বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়, যখন বিনিয়োগকারীদের ১০০ ডলারের নোটগুলো নিরাপদে রাখার বিকল্প থাকে। এটি মনে হয় কিছু সময়ের জন্য একটি পরম বিন্দু ছিল, তবে কভিড-১৯ সংকট কয়েকটি দেশের নীতি এজেন্ডায় দৃঢ়ভাবে ঋণাত্মক হারকে স্থান দেয়া হয়েছে, যদিও এখনো যুক্তরাষ্ট্রে তা করা হয়নি।
রগফ যেমনটা লিখেছেন, ক্যাশ পরিশোধ ব্যবস্থা (পেমেন্ট ম্যাকানিজম) হিসেবে পিছু হটেছে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। সুইডেনে মনে হয় কাগুজে মুদ্রা ক্রোনা চোখের সামনেই বিলয় ঘটছে। মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম সুইস এখন ক্ষুদ্র মূল্যের লেনদেনে আধিপত্য বিস্তার করে। স্টকহোমে সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিয়ার কেনার চেষ্টাকারী যেকোনো ব্যক্তিই জানেন যে তার তৃষ্ণার্ত থাকতে হবে, যদি তার ওয়ালেট ক্যাশে পূর্ণ থাকে।
আবার কভিড-১৯ সংকট ব্যাংক নোট থেকে মানুষকে দূরে থাকার আরেকটি কারণও হাজির করেছে। এটি ব্যাপকভাবে কথিত আছে যে ভাইরাস নগদ অর্থ আদান-প্রদানের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ফলে এটি অনেক আউটলেটকে ‘নো ক্যাশ’ লিখে সতর্কবার্তা লিখে দেয়ায় উদ্বুদ্ধ করেছে। আমার গ্রামে এমনকি ট্রাভেলিং ফি ও চিপ ভ্যানও এখন গ্রহণ করা হবে কেবল একটি সংস্পর্শহীন কার্ডে। প্রকৃতপক্ষে এই অদ্ভুত গল্পের আদৌ কোনো ন্যায্যতা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে কারেন্সি নোটে নভেল করোনাভাইরাস ছড়ানোর কোনো প্রমাণ নেই। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন টেইট-বার্কার্ড বলেছেন, ক্যাশ রোগের ভেক্টর নয়, যতক্ষণ কেউ কোনো ব্যাংক নোটে হাঁচি না দেয়।
তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। সংক্রমণের প্রথম মাসে যুক্তরাজ্যে ক্যাশের ব্যবহার ৬০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। লেনদেনের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। একটি জরিপে প্রায়ই ৭৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই বলেছেন যে তারা ভবিষ্যতে ক্যাশ কম ব্যবহারের আশা করেন।
এই প্রবণতা—যেটি উন্নত বিশ্বজুড়ে অনুকৃত হয়েছে—ডিজিটাল ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম প্রভাইডারদের কার্যক্রম আরো চাঙ্গা করেছে। অ্যাপল পে ও পেপল ভালো করছে। ফিনটেক নিওব্যাংকগুলো তাদের ব্যবহারকারী ভিত্তি অব্যাহতভাবে বাড়িয়েছে, যদিও অনেক প্রশ্ন আছে যে তারা আদৌ একটি টেকসই ব্যবসায়িক মডেল এখনো খুঁজে পেয়েছে কিনা। ফেসবুকের লিবরা কারেন্সি তৈরি হয়ে বসে আছে। এর পৃষ্ঠপোষকরা নিয়ন্ত্রকদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে এই মডেল নিরাপদ ও অর্থ পাচার প্রটোকলের সঙ্গে পরিপালনযোগ্য, সংগতিপূর্ণ।
ক্যাশের অধিকতর পতন ডিজিটাল কারেন্সির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নিজস্ব কাজে বড় ধরনের প্রণোদনা জুগিয়েছিল। ব্যাংক নোটের মাধ্যমে নাগরিক ও ব্যবসায়ীরা কয়েক শতাব্দী ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর একটি প্রত্যক্ষ দাবি ধারণে সমর্থ হয়েছে। যদি ক্যাশ তিরোহিত হয় তাহলে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল কারেন্সির (হোক সেটি পাইকারি, খুচরো কিংবা উভয়ই ধরনের) পক্ষে কি কোনো যুক্তি নেই? ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্টস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সক্রিয়ভাবে একটি ডিজিটাল কারেন্সি প্রবর্তনের বিষয়টি বিবেচনা করছে, যদিও এখনো বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেনি। ই-ক্রোনা চালু করার প্রস্তুতি নিয়ে সুইডিশ রিকসব্যাংক এক্ষেত্রে প্রথমে থাকতে পারে।
তাহলে কি হাতের ক্যাশের বিদায় ঘটতে যাচ্ছে? আমেরিকান কাগুজে মুদ্রা কি তাহলে তার আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে?
উত্তরটি পরিষ্কার নয়। প্রথম ক্ষেত্রে একদিকে নগদ হস্তান্তরের মাধ্যমে লেনদেনের সংখ্যা কমে গেলেও এমনকি নিচের প্রান্তে সার্কুলেশনে ক্যাশের পরিমাণ অনেক দেশেই প্রকৃতপক্ষে বেড়েছে। বিআইএসের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের শেষের দিকে সার্কুলেশনে মুদ্রার মূল্য ইতালিতে ৮ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৭ শতাংশ বেড়েছিল। সতর্কতামূলক ক্যাশের মজুদ ও ধারণ বেড়েছে। বড় বড় অর্থনীতিতে কেবল চীনেই জিডিপি বিবেচনায় বস্তুগত মুদ্রার অনুপাতে চরম পতন শুরু হয়েছে।
ক্যাশ হ্যান্ডলিং ফ্যাসিলিটিজগুলো প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্মণও পরস্ফুিট। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি থেকে বাদ পড়া সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাংক অব কানাডা রিটেইলারদের ক্যাশ গ্রহণ অব্যাহত রাখার কথা বলেছে, যেহেতু ব্যাংক হিসাব ও কার্ড না থাকা মানুষগুলো কেনাকাটা করতে পারছে না। নিউইয়র্ক শহর, সানফ্রান্সিসকো ও নিউ জার্সি স্টেট রিটেইলারদের ক্যাশ গ্রহণ প্রত্যাখ্যান করা বারণ করেছে। এমনকি সুইডেনেও সব ক্ষেত্রেই সুইডিশরা এটিকে কাজে লাগাতে পারে না। ক্যানটানটোপররেট (ক্যাশ রেবেলিয়ন) নামের একটি অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ এখন দরিদ্র ভোক্তাদের কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের সামর্থ্য-সক্ষমতা ধরে রাখতে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে সরকার একটি ‘অ্যাকসেস টু ক্যাশ’ রিভিউ প্রকাশ করেছে, যা দেশের বড় ব্যাংকগুলোর এডিএমের বাধ্যতামূলক পরিচালন বজায় রাখার পরামর্শ দেয়, এমনকি যদিও এর উপযোগিতা দ্রুত কমছে।
মোট কথা, এখনই ডলার নোটের শ্রদ্ধার্ঘ্য (অবিচুয়রি) লেখা শিগগিরই হতে পারে। এর সেবার চাহিদা এখনো শক্তিশালী রয়ে গেছে। নন-ব্যাংকগুলোকে ডিজিটাল সার্ভিস অফার করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কিছু যুক্তি থাকতে পারে। এর একটি কারণ হতে পারে সম্ভবত অংশত মুদ্রা ছাপিয়ে মুনাফাকৃত আয়ের ক্ষতি এড়ানো, যা একটি লিবরা প্রভাবিত বিশ্বে সরকারগুলোর চেয়ে ফেসবুককেই সমৃদ্ধ করবে। তবে যতক্ষণ না কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও ঋণ বণ্টনকাজে প্রবেশের ইচ্ছা পোষণ করে, ততক্ষণ তারা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বড় মাত্রার শাখাগুলোর হ্রাস এড়াতে চাইবে।
আমি সন্দেহ পোষণ করি যে অদূরভবিষ্যতে আমরা এক ধরনের মিশ্র অর্থনীতির পেমেন্ট ব্যবস্থায় বাস করব। ক্যাশ একটি ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখবে; যদিও তা আগের চেয়ে পরিমিতভাবে এবং বিভিন্ন ধরনের কার্ড ও প্রত্যক্ষ ডিজিটাল ট্রান্সফার সহযোগে।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]
হাওয়ার্ড ডেভিস: রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের চেয়ারম্যান
ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির