কভিড-১৯ মহামারী সময়ে শ্রমিক, সম্মুখযোদ্ধা ও জরুরি সেবা প্রদানকারীদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতি পর্যালোচনা করে তাতে মহামারী পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও কর্মক্ষেত্রের জন্য করণীয় বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ সংযোজনের আলোকে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন সরকার, ট্রেড ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) উদ্যোগে আয়োজিত ‘কভিড-১৯: পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সবার জন্য (শ্রমিক, সম্মুখযোদ্ধা, সেবা প্রদানকারী)’ শীর্ষক ওয়েবিনারে গতকাল এমন অভিমত ব্যক্ত করেন তারা।
শ্রমজীবী মানুষ, কভিড-১৯ মোকাবেলায় সম্মুখযোদ্ধা ও সেবা প্রদানকারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ওপর মহামারীর প্রভাব এবং অসহায়ত্বের তুলনামূলক পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রণীত নীতিগুলোর ঘাটতি বিশ্লেষণ, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অংশগ্রহণকারীদের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ এবং এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে এ সভার আয়োজন করা হয়।
বিলস চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান সিরাজের সভাপতিত্বে এবং মহাসচিব নজরুল ইসলাম খানের সঞ্চালনায় আয়োজিত ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ অ্যান্ড সায়েন্সের ডিপার্টমেন্ট অব অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের ফ্যাকাল্টি মেম্বার একেএম মাছুম উল আলম। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ড. রশিদ-ই-মাহবুব। সম্মানিত আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের (এসএনএফ) আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য শাখা) ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইন, বিলসের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক সিনিয়র জাতীয় পরামর্শক ড. সালামত খন্দকার, আইএলও সাউথ এশিয়ার ডিসেন্ট ওয়ার্ক টেকনিক্যাল টিমের ওয়ার্কার্স অ্যাক্টিভিটিস স্পেশালিস্ট সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, আইএলও আরএমজি প্রজেক্ট চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার জর্জ ফলার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক চায়না রহমান প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধে একেএম মাছুম উল আলম বলেন, কভিড-১৯-এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। লকডাউন ও সাধারণ ছুটি নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা থাকার কারণে সচেতনতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটেছে। সমন্বয়হীনতার কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্যবিভ্রাট ও ক্ষেত্রবিশেষে গুজব রটেছে, যার কারণে মানুষের হয়রানির শিকার হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর দুর্নীতি এক্ষেত্রে সমস্যাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। জনসচেতনতা ও সমন্বয়ের অভাবে এলাকাভিত্তিক লকডাউন থেকেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করে কভিড-১৯-কে মোকাবেলা করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে ড. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, কভিড-১৯ কোনো পেশাগত রোগ নয়, এটি সংক্রামক ব্যাধি। এ বিষয় বিবেচনায় রেখেই স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে এটি মালিকপক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমিকদের সঠিক সুরক্ষা দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের মধ্যে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্র বিষয়ে আইএলওর নির্দেশনাবলি সরকার অনুসরণ করতে পারে। তিনি আরো বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেভাবে বীমার আওতায় আনা হয়েছে, সেভাবে শ্রমিকদেরও বীমা নিশ্চিত করা যায় কিনা, তা সব পক্ষকে বিবেচনা করতে হবে।
কভিড-১৯ মোকাবেলায় শ্রমিকদের আরো সচেতন করতে ট্রেড ইউনিয়নকে এগিয়ে আসতে হবে উল্লেখ করে ড. হামিদা হোসেন বলেন, শ্রমিক শুধু এক শ্রেণীর নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক মিলে বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক রয়েছেন। এজন্য কভিড-১৯ সময়ে শ্রমিকদের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বলেন, শ্রমিকদের খাদ্য ও যাতায়াতের ব্যবস্থা মালিকপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নকে সমস্যাগুলো তুলে ধরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
কভিড-১৯ সময়কালে শ্রমিকের সুরক্ষায় ট্রেড ইউনিয়নকে সঠিক ও কার্যকর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ড. সালামত খন্দকার বলেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেই কভিড-১৯ মোকাবেলায় সঠিক নির্দেশনা আসতে হবে। কেননা কভিড-১৯ শুধু জনস্বাস্থ্য সমস্যাই নয়, এটি জনস্বাস্থ্য নীতিবিষয়ক সমস্যাও বটে।
নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার উল্লেখ করে জর্জ ফলার বলেন, কর্মক্ষেত্রে পেশাগত সুরক্ষা আইএলওর সুপারিশকৃত শোভন কাজের একটি অংশ। এটিকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিতে হবে, বিশেষত কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে। এক্ষেত্রে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। এটি বাস্তবায়নে মালিকপক্ষ ও ট্রেড ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কভিড-১৯ পরিস্থিতি শুধু স্বাস্থ্যগত সমস্যাই নয়, বরং এটি একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সংকট। এখন আমাদের কভিড-১৯-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে সব পক্ষের মতামত জানা আবশ্যক।
ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, ক্ষুদ্র কারখানাগুলো প্রণোদনা দিয়ে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে শ্রমিকদের আয় অব্যাহত রাখা যায়। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং শ্রমিকদের জন্য রেশন ও নিজস্ব ব্যবস্থায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে নজরুল ইসলাম খান বলেন, কভিড-১৯ নতুন রোগ হওয়ায় এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়নি। পেশাগতভাবে এ রোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এছাড়া প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী অনেক মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছেন। বিলস এ বিষয়ে তথ্য-গবেষণা ও অ্যাডভোকেসির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তিনি বলেন, কত শ্রমিক কভিড-১৯ এবং এর লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।