সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে লকডাউন

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত গোটা দুনিয়া। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে শুরু করে অর্থনীতি সামাজিক জীবনকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে এই মহামারী। প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখে ফেলছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোতেও। যেখানে কিছু কিছু সম্পর্ক শক্তিশালী হলেও বিপরীতে কিছু আবার মারাত্মক হুমকির মুখেও পড়েছে। অনেক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অন্য মানুষের সঙ্গে আটকে পড়েছে এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেকে লকডাউনে একাকী জীবন পার করেছে, যারা কিনা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের কেউ কেউ যখন তীব্র মিথষ্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে, সেখানে অন্যরা তা একেবারেই করতে পারেনি।

অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কগুলো আমাদের জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো দ্বারাই আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়।  তাই এটা বুঝতে পারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে কীভাবে এমন চরম পরিস্থিতি সেই সম্পর্কের অবস্থাকে বদলে দেয়। এমন না যে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এটা হচ্ছে, সম্ভবত মাস কিংবা বছর ধরে এমন কিছু আমাদের দেখতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আভিভার করা একটি জরিপ  অনুযায়ী, ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মাঝে যারা সম্পর্ক শেষ করতে চান তাদের সংখ্যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ছিল শতাংশ, কিন্তু ২০২০ সালের মে মাসে সেটি তিন গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতাংশে।

এদিসে ফ্রান্সে ব্যাপক আকারে লকডাউন চলাকালে বড় পরিসরে একটি জরিপ করা হয়েছিল। যেখানে লকডাউন কীভাবে আমাদের সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করেছে তার একটা চিত্র পাওয়া গেছে। যাতে  দেখা গেছে কিছু সম্পর্কে অগ্রাধিকার পাওয়ার পাশাপাশি শক্তিশালী হয়েছে যত্ন, সমর্থন এবং বর্ধিত যোগাযোগের মাধ্যমে, সেখানে অন্য কিছু সম্পর্ক বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্বল হয়েছে।

যদিও নমুনাটি হঠাৎ করে নারী এবং অধিকতর শিক্ষিতদের দিকে বেশি ঝুঁকছিল। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৬ হাজার মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে কীভাবে ফ্রান্সের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ লকডাউনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার রোমাঞ্চকর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া গেছে।

অনেকে একে কারাগারের কঠোর পরীক্ষা হিসেবে দেখেছেন এবং কখনো কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কও পরিবর্তিত  হয়েছে। যদিও জীবত্কালের বৃহৎ পরিসরে এই লকডাউনকে ছোটই বলা যায়। কিন্তু এই সময়ের মাঝে সম্পর্কগুলোতে মৌলিক পরিবর্তন সংগঠিত হয়েছে। যা ইঙ্গিত দেয় যে কারো কারো ক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তিত হতে পারে। সময়ের মধ্যে নতুন সম্পর্ক যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি পুরোনো অনেক সম্পর্ক হারিয়েও গেছে।

অনেক মানুষের ক্ষেত্রে প্রথম সবার ওপরে চলে আসে পরিবার কিংবা কাছের বন্ধুদের খোঁজ রাখা এবং তাদের ভালো থাকা। তারা আবেগি সমর্থন প্রদান করে, কখনো উপাদানগত বাস্তবিক সাহায্যও প্রদান করে এবং বিপরীত দিক থেকেও একই সহায়তা পেয়ে সুবিধা ভোগ করেছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বয়স লিঙ্গ কীভাবে মানুষ সম্পর্ক পরিচালনা করবে তাতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। এই লকডাউনে নারীরা যোগাযোগের ক্রীড়নক এবং সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে দম্পতি হিসেবে বসবাসকারী মহিলারা সম্পর্কের যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি তারা পরিবার এবং দুর্বল লোকজনের দেখাশোনাও করছে। তাদের কাছে লকডাউনের সময়টা বেশ উদ্বেগেরও ছিল।

তবে বয়স্ক লোকজন জানিয়েছে, তাদের জন্য লকডাউনের সময়টি বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল এবং নিজেদের ঘরে তারা সময়টা বেশ উপভোগ করেছে।

তবুও সাধারণভাবে পুরুষ উত্তরদাতারা বলেছে, লকডাউনের সময় তাদের সঙ্গীর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

বয়স পারিবারিক জীবনের অবস্থাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাচ্চারাও তাদের বাবা-মার সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তা, পরামর্শ যত্নের উৎস হিসেবে সম্পর্কের যে মাত্রা তাকে উন্নতি করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে তরুণরা দায়িত্ব না নেয়ার পথে হেঁটে আত্মীয়স্বজনের পরিবর্তে বন্ধুদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ করেছে।

সাধারণভাবে, তরুণরা যারা কিনা তুলনামূলকভাবে বেশ মিশুক এবং ঘন ঘন বাইরে আসা-যাওয়া করে, তাদের জন্য এই লকডাউন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু কঠিন সময়টাকে তারা পুষিয়ে নিয়েছে অনেক বেশি অনলাইন কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে। তাদের বেশির ভাগ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে বেশি ব্যয় হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরাই বিশেষ করে সম্পর্কজনিত অস্থিরতার মাঝে বেশি ছিল। তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এবং তাদের যে বিশাল সামাজিক নেটওয়ার্ক তা চালিয়ে নিতে সক্ষম ছিল না বলেও জানায়।

বয়স্ক লোকদের জন্য, যাদের বয়স কিনা ৬০ বছরের বেশি তাদের বেশির ভাগই (৫৯ শতাংশ) নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি, তবে তারা পুরোনো যে সম্পর্ক তাও নষ্ট করেনি। এই বয়সের যারা উত্তর দিয়েছেতাদের মাঝে যারা নতুন সম্পর্ক তৈরি করেছে সেখানে ৭২ শতাংশই ছিল তাদের প্রতিবেশী। অবশ্য এদের মাঝে বেশির ভাগই আবার ছিল নারী উত্তরদাতা।

সব মিলিয়ে ফরাসি এই জরিপ আমাদের সামনে যা তুলে ধরে তা হলো এই লকডাউন পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাঝে সম্পর্কের যে বন্ধন তাকে অনেক বেশি দৃঢ় করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য যে সম্পর্কগুলো তা অনেক বেশি দূূরে সরে গেছে। যেমন সহকর্মীদের সঙ্গে কিংবা সংঘবদ্ধ কার্যক্রমের যেসব বন্ধুত্ব ছিল সেসব।

মহামারী চলাকালে এই পরিবর্তিত ভূমিকা এবং সম্পর্কবিষয়ক অধ্যয়ন আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে গুরুতর সংকটের সময়ে কোনো ধরনের সামাজিক সংযোগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

স্ক্রলডটইন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন