সময়ের ভাবনা

চীন ছাড়ছে জাপানের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কি সুবিধা নিতে পারবে?

মো. শরীফ হাসান

জাপানের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারণে চীন থেকে তাদের কারখানা সরবরাহ ব্যবস্থা স্থানান্তরের মতো জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। কার্যত জাপান সরকার পুনরায় দেশটিতে উৎপাদন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দিয়েছে এবং আরো শূন্য দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যে সব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা অন্য দেশে সরিয়ে আনার জন্য অনুসন্ধান করছে। জাপান চীনের কূটনীতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পরে এবং ১৯৭৮ সালে জাপান-চীন শান্তি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে দুই দশক (১৯৭৯-২০০০) ধরে জাপান চীনকে সহায়তা করে আসছিল। ১৯৯৮ সালের দিকে জাপান ছিল বৃহত্তম দাতা দেশ এবং চীনকে দেয়া সব দ্বিপাক্ষিক সাহায্যের ৬০ শতাংশেরও বেশি ছিল জাপানের দেয়া।

১৯৭৯-৯৮ সালে চীনের সংকটময় সময়ে ২৬৭ দশমিক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগের মধ্যে শতাংশের বেশি ছিল জাপানের, যা ছিল হংকংয়ের ৫২ শতাংশ বিনিয়োগের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের ঐতিহাসিক তাত্পর্য থাকার কারণে জাপানের বিনিয়োগ মূলত ডালিয়ানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দেশীয় রফতানি বাজারের পণ্য উৎপাদন করতে সস্তায় শ্রমের সদ্ব্যবহার করা ছাড়াও জাপানের বিনিয়োগ মানবসম্পদ উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি মূলধন গঠনে সহায়তা করেছিল।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াকে জাপান দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিল। জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে এশিয়ার কারখানার প্রধান পৃষ্ঠপোষক চীনে যেতে শুরু করেছিল এবং উচ্চমানের জাপানি সরঞ্জাম, রীতিনীতি প্রযুক্তি সরবরাহ করছিল। ১৯৯৫ সালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের (এমআইটিআই) জরিপ অনুযায়ী, চীন থেকে জাপানের উৎপাদনের ২৯ শতাংশ পুনরায় জাপানে রফতানি হয়। বিশ্বব্যাপী সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ধারায় চীনের অংশ ১৯৮০-এর দশকে দশমিক শতাংশ থেকে দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০-এর দশকে দশমিক শতাংশ হয়েছিল। আঞ্চলিক মূল্য সংযোজনে চীনের অংশ ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে গিয়ে ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ৩৫ শতাংশ হয়েছিল।

চীন ছেড়ে যাওয়ার কারণ

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যবিরোধের ফলে চীনা পণ্যে উচ্চহারে শুল্ক নির্ধারণের কারণে স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চীন থেকে আমদানীকৃত ২৫০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের হাজার ৮৪০টির বেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তিন ধাপে নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছিল। চীনের অভ্যন্তরে দেশীয় চাহিদা কমে যাওয়া এবং শ্রমের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমে সংকটপূর্ণ হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় দশমিক ৬০ ডলার এবং ভিয়েতনামে দশমিক ৭০ ডলারের তুলনায় চীনের একজন শ্রমিকের দৈনিক গড় আয় ২৭ দশমিক ৫০ ডলার। চীনের বয়স্ক জনসংখ্যার বিপরীতে আসিয়ান সদস্যভুক্ত তুলনামূলক অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশে মধ্যবয়সী জনসংখ্যার গড় বয়স বিশ্বের গড় ২৯ দশমিক বছরের চেয়ে অনেক কম। এশিয়ার অন্যান্য অংশে উৎপাদন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার মতো আকর্ষণীয় জনসংখ্যা, অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজারে প্রবেশের সুবিধা, দক্ষ কর্মী, বৈধ শুল্ক সুবিধা, ব্যয়সাশ্রয়ী ব্যয়সংকোচন নীতি চলমান শিল্প-কারখানা স্থানান্তরের পথকে আরো সুগম করেছে।

কভিড-১৯-এর লকডাউন সময়কালীন বৃহৎ আকারে সরবরাহ ব্যবস্থার বিঘ্ন ঘটায় উত্তর কোরিয়ার শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানবাধিকার কঠোর হাতে দমন করাকে সমর্থন করা এবং পূর্ব চীন সাগরে জাপানের সঙ্গে সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে চলমান বিরোধের মতো -অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। তাছাড়া চীনের অভ্যন্তরে উর্বর উপকূলবর্তী অঞ্চলের উৎপাদকরা কম খরচ নীতিগত সুবিধা পাওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তর প্রদেশে শিল্প-কারখানা স্থানান্তর করছেন। প্রকৃতপক্ষে এই অভ্যন্তরীণ শিল্প স্থানান্তরের প্রবণতা ২০০০ সাল নাগাদ শুরু হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন অর্থনৈতিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত বিশেষত উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চীন থেকে আংশিক অথবা পুরোপুরি প্রস্থানের পথ সুগম হয়েছে। এতে  অ্যাপল, এইচপি, ডেল, মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন, সনি, নিনটেন্ডো, লেনোভো, এসার আসুসের মতো প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম এশিয়ান নিক্কেই রিভিউর জরিপ অনুযায়ী, ৫০টির বেশি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে চীন ছেড়ে চলে গেছে অথবা ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

বাংলাদেশ কি সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে?

এটি সত্য যে নভেল করোনাভাইরাসের অশুভ ছায়া দেশের ওপর পড়ার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। ২০২০ সালের অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০) একমাত্র প্রবাস থেকে পাঠানো অর্থের সূচক ছিল ইতিবাচক, যা প্রতি বছর ২০ দশমিক শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

আমদানি রফতানি উভয়েরই বৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। বেসরকারি খাতের আমানত বৃদ্ধির হার জানুয়ারিতে হ্রাস পেয়ে দশমিক শতাংশ হয়েছিল, যা ২০২০ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক শতাংশের চেয়ে অনেক কম ছিল। সূচকগুলো ব্যাংকিং খাতের জন্য অধিকতর খারাপ; এটি উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ, স্বল্প লভ্যাংশ এবং তারল্য সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি সত্যি চীন ছেড়ে চলে যায়, তাহলে কি বাংলাদেশের এই সুযোগ লুফে নেয়ার সুযোগ রয়েছে?

বিশ্বব্যাংকেরডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স’-এর সহজবোধ্যতা বিচারে এই সম্ভাবনা খুব একটা আশাপ্রদ মনে হচ্ছে না। যে সূচকের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ৪১টি পূর্ণ নমুনা দিয়ে বিচার করা হয়।

অনেকগুলো গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ব্যবসা করার সহজসাধ্যতা সূচকের র্যাংকিংয়ের সঙ্গে সুনিশ্চিতভাবে বিদেশী বিনিয়োগ যুক্ত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ১৭৬তম অবস্থান থেকে একলাফে ১৬৮তম অবস্থানে চলে আসা ব্যপকভাবে সবার নজরে ছিল। কিন্তু আসলে গত ১০ বছরের র্যাংকিং বিবেচনা করলে উন্নতি যথেষ্ট সন্তোষজনক ছিল না।

২০১০ সালে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৮তম, যখন ভারত বাংলাদেশের থেকে অনেক পেছনে ১৩৯তম স্থানে ছিল এবং ভিয়েতনাম ছিল ৯০তম স্থানে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ঠিক উল্টো পথে ধাবিত হয়ে ১৬৮তম অবস্থানে ছিল; অন্যদিকে ভারত উল্লেখযোগ্যভাবে একলাফে ৬৩তম স্থান দখল করে এবং ভিয়েতনাম ৭০তম স্থানে উন্নীত হয়েছিল।

পরিসংখ্যানে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান ছিল। যে সময়ে ভারত ভিয়েতনাম ক্রমে উন্নতি করছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবণতা প্রায় স্থির ছিল।

যদিও আঙ্কটাডের ২০০৯ সালের ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ধারা ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে সর্বাধিক দশমিক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। বিনিয়োগের অধিকাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদন শ্রমশক্তি খাতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল এবং জাপান টোব্যাকো কর্তৃক বৃহৎ দশমিক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো অধিগ্রহণের মাধ্যমে।

উপরন্তু, ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ যেখানে দেশের জিডিপির অনুপাতে খুবই কম, যা মাত্র শতাংশের কাছাকাছি ছিল, সেখানে ভিয়েতনামে জিডিপির অনুপাতে দশমিক শতাংশ ছিল।

এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া মিলিয়ন ডলারের ওপর থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের জন্য ১০০ শতাংশ কর রেয়াতের সুযোগ দিয়েছে। থাইল্যান্ড গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিল, চীন থেকে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করে সে দেশে যাবে, তাদের ৫০ শতাংশ কর রেয়াত করা হবে।

মালয়েশিয়া উচ্চমানসম্পন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে পাঁচ বছরের জন্য বিলিয়ন রিঙ্গিত (২৩৮ মিলিয়ন ডলার) সমমূল্যের প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

সংক্ষেপে উপরের প্রসঙ্গের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, দেশে মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং উৎপাদন খাতে দক্ষতার অভাব, কঠিন করপোরেট কর সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্যবসা শুরু করার আগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রণোদনার অভাবে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কম আকর্ষণীয়।

দেশ বিভিন্ন খাতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের সুবিধা গ্রহণে সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে আরোহণ করতে পারত। এছাড়া তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস, বৃহৎ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ভারী শিল্পের জন্য উপযুক্ত হতে পারত, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি এখনো আমাদের জন্য বাস্তবে পরিণত হতে পারেনি।

 

মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন