প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবার গঠনের অধিকার

মাসুদ রানা

প্রতিটি মানুষই, সে যেমনই হোক পেতে চায় কাছের মানুষের স্পর্শ। কালো- সাদা, ধনী -গরীব , প্রতিবন্ধী- অপ্রতিবন্ধী সবাই চায় ভালোবাসার স্পর্শ । স্পর্শ অনুভব করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক অসাধারণ ক্ষমতা। ভালোবাসার, স্নেহময় স্পর্শ অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারে, মানুষকে নতুন করে বেঁচে থাকার সাহস যোগায়। যে দিন এই পৃথিবী থেকে স্নেহময় স্পর্শ উঠে যাবে সেদিনই হয়তবা মহাপ্রলয় ঘটবে। এ স্পর্শ একজন মানুষ জীবনের প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে। তবে যৌবনে এ স্পর্শের পরশ পেতে মানুষ মরিয়া হয়ে যায়। এটাই সহজাত প্রবৃত্তি। যৌবনের ধর্মই এটা। এ প্রবৃত্তির কারণেই মানুষ পরিবার গঠন করে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধি ঘটছে। মানবজাতি টিকে আছে। কিন্তু অনেকেই পরিবার গঠনের স্বাভাবিক, ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ধরনের একটি জনগোষ্ঠী হচ্ছে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বিয়ে ও পরিবার গঠনে আইনগত বিধি নিষেধ না থাকলেও  সমাজের মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী কিছু মানুষকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে । 

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, একটি দেশের মোট জনগোষ্ঠীর আনুমানিক ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার । প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুযায়ী দেশে  ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে। সব ধরনের প্রতিবন্ধী নারী পুরুষ সমাজে বিয়ে ও পরিবার গঠনের অধিকার বিষয়ে বৈষম্যের শিকার। কর্মক্ষম, শিক্ষিত পুরুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিয়ের পিড়িতে বসতে পারলেও অনেক শিক্ষিত, কর্মক্ষম নারী  প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীরা বিয়ে করতে পারছে না । তাদের বিয়ের প্রসঙ্গ আসলে তারা কথা বলতে পারে কিনা , দেখতে পায় কিনা এগুলো বেশি বিবেচনায় আনা হয় । প্রতিবন্ধী নারীদের যৌন, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার গঠন ও  অধিকার বিয়ে কেউ ভাবে না। প্রত্যেকের বিষয়টি ভাবা উচিত । তাদের নিজস্ব চাহিদা আছে । কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিয়ে করলে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে মশকরা হয়। তবে পুরুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তুলনায় যেমন নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বেশি বৈষম্যের শিকার তেমনি  নিম্নোক্ত ০৪ চার ধরনের – যথা:

০১। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার

০২। সেরিব্রাল পালসি

০৩ । বুদ্ধি প্রতিবন্ধী

০৪। ডাউন সিনড্রোম

এ আক্রান্ত প্রাতিবন্ধী ব্যক্তিরা বেশি বৈষম্যের শিকার । এ চার ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিতে  নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন -২০১৩ অনুযায়ী  বলা হয় নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি। এই চার ধরনের প্রতিবন্ধীতা সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন হয় জীবনব্যাপী পরিচর্যা। এদের অবস্থান সবচেয়ে নাজুক। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ও পরিচর্যা পেলে  মৃদৃ মাত্রার নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে পুর্নবাসিত হতে পারে। অনেক মৃদৃ মাত্রার  নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন যুবক বর্তমানে স্বাবলম্বী হয়ে জীবন যাপন করছে। যা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে । 

এ ধরনের যুবকদের অনেকেই নিজেদের অক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে সমাজে চলতে চায়। চাকরি, ব্যবসা করতে চায় । বিয়ে করে পরিবার গঠন করতে চায়। বিয়ে ও পরিবার গঠন বিষয়ে আইনগত কোন বাধা না থাকলেও  বাধ সাধে পরিবার, সমাজ। এ ছেলে কীভাবে বিয়ে করবে? কার সাথে বিয়ে হবে  ইত্যাদি। 

কেন এ ধরনের কথা বলা হয়? শুধুই কি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অক্ষমতা এজন্য দায়ী? আমার মনে হয় তা না। এক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্পদলিপ্সা দায়ী । অনেক প্রতিবন্ধীতা সম্পন্ন ব্যক্তি জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ নিজেরা জোগাড় করতে সক্ষম । সমাজ জীবনের জটিল হিসেব হয়তবা এরা বুঝে না , আর এ জন্যেই হয়তবা নিজেকে জোরালোভাবে এরা উপস্থাপন করতে পারেনা। তার  প্রতিবন্ধীতা হয়ে উঠে  তার ন্যায্য উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার উপলক্ষ মাত্র। অথচ ২০০৬ সালে  প্রণীত জাতিসংঘের সনদ ইউএনসিআরপিডি-তে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোর ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এখানে আর্টিকেল ২৩ তে Respect for home and the family শিরোনামে বলা হয়েছে-1. States Parties shall take effective and appropriate measures to eliminate discrimination against persons with disabilities in all matters relating to marriage, family, parenthood and relationships, on an equal basis with others, so as to ensure that:

 (a) The right of all persons with disabilities who are of marriageable age to marry and to found a family on the basis of free and full consent of the intending spouses is recognized; 

(b) The rights of persons with disabilities to decide freely and responsibly on the number and spacing of their children and to have access to age-appropriate information, reproductive and family planning education are recognized, and the means necessary to enable them to exercise these rights are provided. 

(c) Persons with disabilities, including children, retain their fertility on an equal basis with others.

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ১৬ (ঙ)  নং ধারায় বিয়ে ও পরিবার গঠনের অধিকার দেয়া হয়েছ । সেখানে বলা হয়েছে -মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সহিত সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন করার অধিকার একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির থাকবে । প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩  এবং  প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা বিধিমালা ২০১৫ এর আলোকে প্রতিবন্ধী বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা  ২০১৮-২০২৫ মেয়াদের  জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে সামাজিক অংশগ্রহন ও পরিবার গঠন বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কি কি কাজ করবে সে সর্ম্পকে বিস্তারিত বলা আছে। একটি অর্ন্তভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য যে সকল আইন কানুন দরকার তার সব কিছুই  সরকার প্রনয়ন করেছে । এখন দরকার সেগুলোর যথাযথ এবং কার্যকর বাস্তবায়ন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণে কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে আরা বেশি এগিয়ে নেয়া দরকার। বিদ্যমান ভাতা ব্যবস্থার সঙ্গে বিয়ে করতে ইচ্ছুক প্রতিবন্ধীতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বিয়ের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন (ডিপিও) এর সংখ্যা, কাজের গুণগত মান বাড়ানো গেলে এ কাজগুলো ত্বরান্বিত করা আরো সহজ হবে । 


 মাসুদ রানা

প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা,

প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র , পীরগঞ্জ , রংপুর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন