‘করোনা’ মহামারী-অতিমারী সারা বিশ্বের সব দেশের মতোই আমাদের দেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি তছনছ করে দিয়েছে। করেছে মাত্র চার-পাঁচ মাসের মধ্যে। এখনো এর তাণ্ডবলীলা চলছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। বলা যায়, মহাদুর্দিন-দুঃসময় আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। দুর্দিন-দুঃসময় থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। আমরাও কি আজকের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের ‘রোডম্যাপ’ স্থির করব। সবাই তা-ই করছে মনে হয়। সরকার, অর্থনীতিবিদ, প্রভাবশালী লোকজন, নীতিনির্ধারকরা সবাই বলছেন ভবিষ্যতের কথা। বলছেন অর্থনীতি ‘পুনরুদ্ধারের’ (রিকভারি) কথা। কথার মর্মার্থ দাঁড়ায় একটা। করোনা-পূর্ববর্তী যে অবস্থায় আমরা ছিলাম, সেই অবস্থায় আবার ফিরে যেতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত রফতানি ব্যবসা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমদানি ব্যবসা পুনরুদ্ধার করতে হবে। ‘রেমিট্যান্স’ ঠিক রাখতে হবে। এজন্য শিল্প-কারখানা পুরোদমে চালু করতে হবে। কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ছোট-মাঝারি শিল্পকে বাঁচাতে হবে। এ উদ্দেশ্যে সরকার নানা রকমের পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার লক্ষাধিক টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
সস্তায় ঋণের ব্যবস্থা হয়েছে। ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে। রফতানি বৃদ্ধির জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে। লাখ লাখ পরিবারকে পরিবারপিছু ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য দেশের অর্থনীতিতে তারল্য বাড়ানো, যাতে আমরা আবার ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার আগের জায়গায়, সম্ভব হলে আরো উন্নততর স্তরে নিয়ে যেতে পারি। এসবই তাত্ক্ষণিক করণীয় হিসেবে প্রয়োজনীয় বিবেচিত। পুনরুদ্ধারের জন্য তা-ই দরকার। এখানেই আমার প্রশ্নটি একটু খোলাসা করে বলতে চাই। যদি আগের জায়গায় যাওয়াই আমাদের করণীয় হয়, তাহলে মহাদুর্দিন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিলাম। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে পরিবর্তন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্ষমতাবিন্যাসে যে পরিবর্তন হচ্ছে, জাতীয়তাবাদের যে পুনর্জন্ম হচ্ছে, স্বদেশিকতা যে প্রাধান্য পাচ্ছে, বাজার অর্থনীতি যে বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের নিয়মাবলি যে মাঠে মারা গেছে—এসব থেকে আমরা কী শিক্ষা নিলাম। আমাদের ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধার’ দরকার, নাকি ‘অর্থনীতির পুনর্গঠন’ দরকার। এ প্রশ্ন তো আমার মনে হয় বিবেচনা করে দেখার বিষয়। আগের জায়গায় যাওয়ার অর্থ হলো, আগে যা যা ছিল, তার সবই ভালো এবং রক্ষণযোগ্য। এই উপসংহার কি ঠিক?
অর্থনীতি ও সমাজের বহু পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের উন্নয়নও লক্ষণীয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রশংসনীয়। অভাব-অনটন কিছুটা কম। উন্নয়ন অনেক দৃশ্যমান, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক সামাজিক সূচকে আমরা অগ্রগামী। কিন্তু এ পর্যালোচনাই কি শেষ কথা? উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও অর্থনীতিতে যে আবর্জনা-বর্জ্য জমা হয়েছে, এসব কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? আমরা কি পুনরুদ্ধারের কথা বলে সেইসব আবর্জনাকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে এগোব? এক নম্বর আবর্জনা বৈষম্য, চরম বৈষম্য। পাকিস্তান আমলে আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে স্বাধীনতা এনেছি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এর নেতা। আজকে বৈষম্য চরম পর্যায়ে। ব্যাংকগুলো ধনীদের ‘অস্ত্রে’ পরিণত হয়েছে। এরা দেশ থেকে টাকা পাচারের মাধ্যম হয়েছে। ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং মাধ্যম দেশের ব্যাংকগুলো। তারা ছোট খামারিদের ঋণ দেয় না। দেশের দরিদ্র অঞ্চলে তারা ঋণ দেয় না। নতুন উদ্যোক্তা তারা তৈরি করে না। ব্যাংকের মালিকানা কুক্ষিগত হচ্ছে কতিপয় পরিবারের হাতে। বৈষম্য জন্ম দেয়া, বৈষম্য লালন-পালন করা ব্যাংকের বড় কাজ হয়ে উঠেছে। দক্ষতার সঙ্গে লোকের চাকরি খাওয়া এদের নেশা হয়ে পড়েছে। মুনাফা করাই এদের কাজ। প্রশ্ন, আমরা কি ‘করোনার’ মতো এত বড় দুর্যোগের পরও করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় ব্যাংকগুলো রেখে দেব? ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি-রফতানির বদৌলতে দেশ থেকে একশ্রেণীর প্রভাবশালী লোক টাকা পাচার করে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোয় বাড়ি বানাবে, ব্যবসা করবে, তার কি কোনো প্রতিকার করব না আমরা?
ঘরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, গাড়ি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, অফিস শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, রাস্তাঘাটে যেকোনো ক্ষেত্রকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা যাদের আছে, তারা এত স্বাচ্ছন্দ্য-প্রতিপত্তি ছেড়ে কেন বিদেশে চলে যাচ্ছে? আমরা কি গরিব মানুষগুলো নিয়েই বাংলাদেশে বসবাস করব? করোনা এত বড় আঘাত দেয়ার পরও কি এ সম্পর্কে আমরা কিছুই করব না। খবরের কাগজে দেখলাম বাংলাদেশের একজন অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী করোনা চিকিৎসাকালে ডাক্তারদের বলেছেন, আমি তোমাদের সব সম্পদ দিয়ে দেব; আমাকে কষ্ট থেকে একটু মুক্ত করো। মৃত্যুশয্যায় এই আত্মোপলব্ধি বিবেচনা করে আমাদের ধনীরা কি অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে পারেন না? পারেন না কি বাজার অর্থনীতিকে আরো ‘মানবিক’ করতে? সরকার কি এভাবে ভাবতে পারে না? আজ বড়লোক, প্রভাবশালী, মন্ত্রী-মিনিস্টার, সংসদ সদস্য ও ধনীদের চিকিৎসা হয় বিদেশে—সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ও লন্ডনে। মধ্যবিত্তের চিকিৎসা ব্যয়বহুল, যা তার নাগালের বাইরে। গরিবের চিকিৎসা হাসপাতালের বারান্দায়। করোনা নামের মহাদুর্যোগের পর আমরা কি স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারে নতুন করে ভাবতে পারি না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানের দিক থেকে বিশ্বের ২০০-৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও স্থান পায় না। বিএ পাস, এমএ পাস ছেলেমেয়েরা একটা চিঠি বাংলা বা ইংরেজিতে লিখতে পারে না, শুদ্ধ করে একটা ‘এসএমএস’ করতে পারে না—আমরা এ
অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অর্থনীতি ও সমাজকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে পারি না? সঞ্চয় যে কী কাজে লাগে, তা এবার বোঝা যাচ্ছে। যাদের কিছু সঞ্চয় ছিল, তারা তা ভেঙে ভেঙে এখন চাহিদা মেটাচ্ছে। যাদের সঞ্চয় নেই, চাকরিও নেই, তারা ঢাকা শহর ছাড়ছে। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত হচ্ছে, নিম্নবিত্ত গরিব হচ্ছে, গরিব অতিগরিব হচ্ছে। শহরের সুবিধা সব একশ্রেণীর লোকের কুক্ষিগত হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে একজন অবসরপ্রাপ্ত লোক ঢাকায় একটা বাড়ি করতে পারত। স্বাধীনতার পর বাড়ি নয়, ফ্ল্যাট করতে পারত। এখন ফ্ল্যাট করাও সম্ভব নয়, জমি কেনা তো দূরের কথা। ‘করোনা’-পরবর্তী অবস্থায় আমরা কি এমন সমাজের কথা ভাবতে পরি না, যে সমাজে সবার বাসস্থল থাকবে, শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। বাজার অর্থনীতির ভিত্তি হবে মেধা, দক্ষতা, প্রতিযোগিতা ও উদ্যোগ—ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে টাকা করা নয়। করোনা-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি গ্রাম ছেড়ে সব লোক শহরে চলে আসছে। গ্রামে তাদের কাজ নেই, গ্রামে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। শহরে গড়ে উঠছে বস্তির পর বস্তি। লাখ লাখ লোকের বসবাস রাস্তায়। আমরা কি এমন কথা এই দুর্যোগের পর ভাবতে পারি না যে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে আসবে না। গ্রামেই কাজ মিলবে, সুযোগ-সুবিধা মিলবে। পাকিস্তান আমলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি। বন্যা নিয়ন্ত্রণের কথা ছিল মুখে মুখে। এখন প্রতি বছর বন্যায় লাখ লাখ মানুষ গৃহচ্যুত হয়। ঘরবাড়ি হারায় তারা। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি জলে ভেসে যায়। চাষের মাছ পুকুর থেকে উধাও হয়ে যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় বন্যা নিয়ন্ত্রণে, বাঁধ নির্মাণে। এসব ব্যাপারে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার কথা কি চিন্তা করা যায় না? প্রতি বছর ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির’ অধীনে সুবিধা নেয়া লোকের সংখ্যা বাড়ছে। এর অর্থ কী? যদি উন্নয়নের ফসল সবার মধ্যেই বণ্টিত হতো, তাহলে কি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বছর বছর বরাদ্দ বাড়ত? সরকারি খরচের কোনো গুণগত মান আমরা রক্ষা করতে পারছি না। আমরা ১ টাকার কাজ ২ টাকায় করছি। ফলে অহেতুক বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে, উন্নয়ন বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। আমরা যদি ব্যয়ের গুণগত মান রক্ষা করতে পারতাম, তাহলে বর্তমান বাজেটের টাকাতেই কমপক্ষে দ্বিগুণ কাজ করা সম্ভব হতো। বালিশ, পর্দা, ড্রামকাণ্ড আমাদের সর্বনাশ করছে। এত বড় দুর্যোগের পর কি আমরা এসব বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেব না?
ওপরে আমি কিছু আবর্জনার কথা উল্লেখ করলাম। এগুলো আমাদের অনুসারিত উন্নয়ন নীতিমালার ফসল বলে মনে করি। পরিষ্কার দেখা গেছে, আমরা যে উন্নয়ন নীতিমালা অনুসরণ করে এগোচ্ছি, তা অনুসরণ করে উন্নত দেশগুলোয় মোটেই কোনো সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হচ্ছে না। আমেরিকা বলছে, ধনীরা অন্য দেশে শিল্প করে, আমেরিকার লোক বেকার। জাপানের বৃদ্ধরা খাবারের জন্য চুরি করে, যাতে জেলে যেতে পারে। চীনের যে এত উন্নতি, সেখানে যুবক-যুবতীরা ক্রমেই একা একা জীবন যাপন করে। বিয়েশাদি করার মতো অর্থ তাদের নেই। বেইজিং শহরে ১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ভাড়া করার মতো ক্ষমতা নেই অগণিত চাকরিজীবীর। এসব বলতে গেলে আলাদা নিবন্ধ লিখতে হবে। আমি মনে করি, করোনার মতো মহাদুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবিক গুণসম্পন্ন উন্নয়ন নীতিমালা আমাদের অনুসরণ করা উচিত। পুনর্গঠন করা দরকার সবকিছু।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক