বেদখলে বিপুল পরিমাণ বনভূমি

কার্যকর ব্যবস্থা নিক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়

প্রাতিবেশিক ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ বনভূমি অপরিহার্য হলেও বনের ওপর মানুষের আগ্রাসন থেমে নেই। বৃক্ষ নিধন করে প্রতিনিয়ত চলছে বন উজাড়ের মচ্ছব। শিল্প মালিক কিংবা ক্ষমতাশালীদের একটি গোষ্ঠী প্রভাব খাটিয়ে বনের জমিতে গড়ে তুলছেন ইমারত। কেউ কেউ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে বনের জমি দখলে নিয়ে রেখেছেন। বন বিভাগের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর থেকে পর্যন্ত দেশে বেদখল হওয়া বনভূমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে লাখ ৮০ হাজার একর। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ আরো বেশি। এর মধ্যে কাগজপত্রে কোনো ধরনের সমস্যা না থাকা বেদখলকৃত বনভূমির পরিমাণও কম নয়। পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির উপস্থাপিত তথ্যে এর পরিমাণ নিদেনপক্ষে এক লাখ একরের অধিক বলে জানা গেছে। বেদখলে থাকা বনভূমির সর্বশেষ অবস্থা, দখলকারীদের কতবার আইনি নোটিস দেয়া হয়েছে, নিয়োজিত আইনজীবীদের ভূমিকা কী ছিল, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছে আলোচ্য কমিটি। এক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি বেদখল হওয়া বনভূমি উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ আশা করি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, গত প্রায় এক দশকে বন উজাড় দখল হতে হতে দেশের বনভূমি তলানিতে ঠেকেছে। এশিয়ার দেশগুলোয় বনের পরিমাণ সবচেয়ে কমের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে। এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থা আর মাত্র দুটি দেশেরপাকিস্তান মঙ্গোলিয়া। দেশের বনভূমি আজ যে অব্যাহতভাবে ক্রমহ্রাসমান, তার কারণ প্রাকৃতিক নয়, বরং মানবসৃষ্ট। দিনে দিনে আমরাই বনজঙ্গল উজাড় করে চলেছি। কিছু স্বার্থান্ধ মানুষের অপিরণামদর্শী কর্মকাণ্ড, দায়িত্বহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনাহীনতা, দূরদৃষ্টির অভাব এবং বাছবিচারহীন অবকাঠামো নির্মাণই সাধারণভাবে এজন্য দায়ী। বন ধ্বংসের ফলে এরই মধ্যে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার অপরিহার্যতার কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এখন দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংরক্ষিত বনভূমি, ব্যক্তি পর্যায়ে রোপণ করা গাছপালা, সামাজিক বনায়ন, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীসহ নানা উদ্যোগ মিলিয়ে দেশে বনভূমির পরিমাণ এখন বেড়ে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে তা ২০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু বেদখল হওয়া বনভূমি উদ্ধার করা না গেলে লক্ষ্য কতটা অর্জন হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের জোরালো তত্পরতার বিকল্প নেই।

কেবল অভ্যন্তরীণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল যে ক্রমেই কমছে তা নয়; আমরা দেখছি উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনও নানা দিক থেকেই ক্রমসংকোচনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এটা আরো ভয়াবহ। কেননা বন যেমন ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগে আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে, তেমনি এর বনজ সম্পদ দেশের অর্থনীতিতেও বিপুল ভূমিকা রাখছে। তাই সুন্দরবনসহ সামগ্রিক বনাঞ্চল রক্ষায় আমাদের জুতসই পরিকল্পনা নিতে হবে।  

দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত বনভূমি থাকার পরও ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম নিজ নিজ দেশের বনাঞ্চল সম্প্রসারণ করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এসব দেশে সামাজিক বন বিভাগ অ্যাগ্রো ফরেস্ট্রি, কমিউনিটি ফরেস্ট্রি, কমার্শিয়াল ফরেস্ট্রি, আরবান ফরেস্ট্রিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আমাদেরও সেদিকেই এগোতে হবে।

জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক অভিঘাত সামনে আরো বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে যতটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে, সেই বনাঞ্চল সুরক্ষায় অবিলম্বে মনোযোগী হতে হবে বন বিভাগের নীতিনির্ধারকদের। একই সঙ্গে বনভূমি তথা জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির মচ্ছবে মত্ত ব্যক্তি গোষ্ঠীকে চিহ্নিতপূর্বক আইনের আওতায় আনতে হবে। রুখতে হবে তাদের অপতত্পরতা, সর্বোপরি উদ্ধারে বলিষ্ঠ ব্যবস্থা নিতে হবে বেদখল থাকা বনের জমি। অস্বীকার করা যাবে না, বন সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতি অঙ্গীকারের ঘাটতি নেই। বিভিন্ন সময়েই আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বন সুরক্ষার কথা বলেন; বলেন নতুন বন সৃজনে নানা আয়োজনের কথা। কিন্তু তার বাস্তব প্রতিফলন খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এখন এক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে কাজের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন