ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের প্রতিবেদন

তিন মাসে ৫০ কোটি ডলার মজুরি হারিয়েছেন পোশাক শ্রমিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব কম-বেশি পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে। সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে দেশগুলোর শ্রমঘন শিল্পের অনেক কারখানা। অনেক ক্ষেত্রে কারখানার শ্রমিক মজুরি পেলেও তা ছিল আংশিক বা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। মজুরি কম পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশেও।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের প্রতিবেদন বলছে, করোনার প্রভাবে গত মার্চ থেকে মে তিন মাসে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা মজুরি বাবদ হারিয়েছেন ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ হাজার ২৬১ কোটি ২৪ লাখ টাকা

শ্রম অধিকার রক্ষাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) গতকাল শ্রমঘন পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরিতে করোনার প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।আন্ডার পেইড ইন দ্য প্যানডেমিক: অ্যান এসটিমেট অব হোয়াট দ্য গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি ওজ ইটস ওয়ার্কার্সশীর্ষক ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে সিসিসি বলছে, মহামারীকালে দরিদ্র পোশাক শ্রমিকরা মজুরি বাবদ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী লাখো পোশাক শ্রমিক নিয়মিত মজুরি পাননি অথবা কোনো মজুরিই পাননি এমন দাবি জানিয়ে সিসিসি বলছে, ব্র্যান্ডগুলোর বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশের ফলে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত পোশাক শ্রমিকদের মজুরিবিহীন ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে সিসিসির আনুমানিক হিসাব বলছে, দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পোশাক শ্রমিকরা নিয়মিত আয়ের ৩৮ শতাংশ পেয়েছেন। ভারতের কিছু অঞ্চলে হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। মহামারী পরিস্থিতিতে ভালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এমন দেশ এবং চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোর শ্রমিকরা মার্চ থেকে মে মাসের মজুরি বাবদ ন্যূনতম দশমিক ১৯ থেকে দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন।

প্রতিবেদনে প্রারম্ভিক বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, জানুয়ারিতে চীন থেকে পোশাক প্রস্তুতকারক দেশগুলোতে যখন কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন অনেক কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ হতে বাধ্য হয়। পোশাক শিল্পে এর পরের ধাক্কা আসে যখন ইউরোপ আমেরিকায় মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। তখন পোশাকের ভোক্তা চাহিদা হঠাৎ করেই পড়ে যায়। পাশাপাশি ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করে এবং এরই মধ্যে রফতানি হওয়া পণ্যের দামি পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায়।

সার্বিক পরিস্থিতির ফলেই কারখানা বন্ধ হতে বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছেন এমন তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যতবার কারখানা বন্ধ হতে বাধ্য হয়েছে, তখনই শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ ছাড়া বা বিনা নোটিসে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজ থেকে বরখাস্ত ৭২ দশমিক শতাংশ শ্রমিককে ছুটি দেয়া হয়েছে ৮০ দশমিক শতাংশ শ্রমিককে মার্চের মজুরি পরিশোধ ছাড়াই বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়, মহামারীর আঘাতের আগের হিসাবে বাংলাদেশের হাজার ৫০০ পোশাক কারখানায় ৪৪ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো। পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি মাসিক হাজার টাকা কিন্তু সাধারণ আনুমানিক হিসাবে মাস শেষে শ্রমিকরা পান গড়ে হাজার ৫৮০ টাকা। হিসেবে মাসে সব শ্রমিক পান হাজার ২১৫ কোটি টাকা বা ৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

কভিড-১৯-এর ব্যাপ্তি বাড়তে থাকলে মার্চে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ে দ্রুতগতিতে ক্রয়াদেশ বাতিল হতে থাকে এবং ২৩ মার্চের মধ্যে ১৫০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়। মার্চে ন্যূনতম ১৫০টি কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। হিসাব অনুযায়ী লাখ ৪৭ হাজার শ্রমিক কোনো মজুরি পাননি, বাকি ৪২ লাখ শ্রমিক গড়ে হাজার ৬২২ টাকা বা ১০১ ডলার করে পেয়েছেন।

মার্চ মাসের ২৬ তারিখ থেকে সরকারি ঘোষণায় শুরু হওয়া শাটডাউন ১৬ মে পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ে কারখানা সচল বা বন্ধ রাখা নিয়ে দিকনির্দেশনার অস্পষ্টতায় শ্রমিক হয়রানির ঘটনা ঘটে। কাজের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ার পাশাপাশি গণপরিবহনের অনুপস্থিতিতে গ্রামে যাওয়া গ্রাম থেকে আসা নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় শ্রমিকদের।

লকডাউন ক্রয়াদেশ বাতিলের সমন্বয়ে এপ্রিলে মজুরি পরিস্থিতি আরো প্রকট হয় জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, হাজার ২০৩টি কারখানার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও ৫৮০টি কারখানা বন্ধ হয়। ১১৯টি কারখানা লকডাউনের মধ্যে সরকারি সহায়তার বাইরে ছিল। হাজার ৫৯৮টি কারখানা এপ্রিলের বেশির ভাগ সময় কার্যক্রম চলমান রাখে। মে মাসের লকডাউন থাকলেও ২৬ এপ্রিলের পর স্বল্প শ্রমিক নিয়ে বেশির ভাগ কারখানা চালু হয়।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এপ্রিলে পুরো মাস কাজ করেছেন এমন শ্রমিকরা তাদের মজুরির ৬০ শতাংশ পান, যা পরে ৬৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়। ২৬ এপ্রিলে যে শ্রমিকরা পুনরায় কাজ শুরু করেন, তারা ২৬ দিনের জন্য ৬৫ শতাংশ মজুরি এবং বাকি পাঁচদিনের পূর্ণাঙ্গ মজুরি পান। মজুরি কারখানা মালিকের দেয়ার কথা। বন্ধ কারখানাগুলোর শ্রমিকরা কোনো মজুরি পাননি, লকডাউনের আওতায় থাকা শ্রমিকরা ৬৫ শতাংশ মজুরি গ্রহণ করেছেন এবং সরকারি সুবিধার বাইরে থাকা শ্রমিকরা কোনোকিছুই গ্রহণ করেননি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলের শ্রমিকরা নিয়মিত মজুরির চেয়ে ১৩ শতাংশ কম পেয়েছেন, এপ্রিলে পেয়েছেন ৪৬ শতাংশ কম, মে মাসে পেয়েছেন ২৫ শতাংশ কম। হিসেবে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গড়ে ২৯ দশমিক শতাংশ কম মজুরি পেয়েছেন শ্রমিকরা। ডলারে যার পরিমাণ ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার এবং বাংলাদেশী মুদ্রায় হাজার ২৬১ কোটি ২৪ লাখ।

যেহেতু মূল দায়িত্ব ছিল ক্রেতাদের, সেহেতু ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ অবমাননাকরএমন মত প্রকাশ করে বিজিএমইএ সভাপতি . রুবানা হক বলেন, যে দেশগুলোতে পোশাক উৎপাদন হয়, সেই দেশগুলোর ওপর ভিত্তি না করে প্রতিবেদনটি হওয়া উচিত ছিল সোর্সিং (ক্রয়) এলাকার ওপর ভিত্তি করে। ওই প্রতিবেদনটি হতো গ্রহণযোগ্য। এপ্রিলে যেখানে অন্য সব দেশ নো ওয়ার্ক নো পে অনুসরণ করছিল, তখন বাংলাদেশে এপ্রিলে কাজ না করা শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে। ম্যানুফ্যাকচারারদের অপদস্থ করা নয়, প্রতিবেদনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল সমস্যার শিকড়ে, যা আমাদের প্রান্তে ছিল না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন