জ্বালানি নিরাপত্তা

দেশীয় সক্ষমতা বাড়াতে বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা-উদ্যোগ নিতে হবে

চলমান কভিড-১৯ মহামারীতে কিছুটা হোঁচট খেলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা দুর্নিবার। ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন, বিবেচ্য তিনটি মানদণ্ডের নিরিখে ২০২৪ সালে টেকসইভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে উন্নীত করতে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনে অর্থনৈতিক গতিশীলতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। আর তার জন্য চাই বিনিয়োগ বৃদ্ধি। সরকার অবশ্য দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে খুব সক্রিয়। বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ বাস্তবায়ন করছে, আইনি বিধি ব্যবস্থায়ও ব্যাপকতর পরিবর্তন আনছে। তবে হতাশাজনক বিষয় হলো, এত সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না; বরং দিন দিন তা তলানিতে ঠেকছে। দেশে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু বাস্তবসম্মত কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় কারণ হলো শিল্প ক্ষেত্রে গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন প্রাপ্যতার ঘাটতি। দীর্ঘ সময় ধরে শিল্প খাতে বিরাজ করছে গ্যাস সংকট। কোনো উদ্যোক্তা যদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে গ্যাসের অভাবে তা চালাতে না পারেন, তাহলে তিনি ক্ষতির সম্মুখীন হবেনএটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতায় কে চাইবে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে? বাস্তবে হয়েছেও তা-ই। অনেক উদ্যোক্তা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের পর বছরের পর বছর গ্যাস না পাওয়ায় তা চালু করতে পারছেন না। তাদের সুদসহ ব্যাংকঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হচ্ছেন কারখানা বন্ধ করে দিতে। ফলে দেশে শিল্পায়ন সেভাবে গতি পাচ্ছে না, আশানুরূপভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। অর্থনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে জ্বালানি নিরাপত্তার যোগসূত্র গভীর। সরকারের জন্য এটিই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা তথা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ জরুরি।

অস্বীকারের উপায় নেই যে জ্বালানি খাত, বিশেষত বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য দৃশ্যমান। বিদ্যুৎ উৎপাদন আগের তুলনায় চার গুণ বেড়েছে। তবে সাশ্রয়ী মূল্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহে এখনো সাফল্য অর্জন করা যায়নি। বরং অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। ফলে বেড়ে চলেছে বিদ্যুতের দাম। স্বল্প মূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে দেশ দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতির চাকা শিল্প উৎপাদন স্বচ্ছন্দে চালু রাখতে পেরেছে। তবে ২০১০ সাল নাগাদ এসে গ্যাস সংকট জ্বালানি খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। এটা ক্রমে বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদের জন্য এটি মোটেই ব্যয়সাশ্রয়ী পথ নয়। তাই জ্বালানি সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্টদের স্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে। স্বল্পমেয়াদে সরকারকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু বেশি দামের এই জ্বালানির ওপর দীর্ঘদিন নির্ভর করলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না। বিশ্ববাজারে তেল, এলএনজি কয়লার দামের বর্তমান নিম্ন অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কাজেই জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় জ্বালানি জোগাতে আরো সক্রিয় হতে হবে।

দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানি তথা গ্যাস কয়লা। গ্যাস সম্পদ নিয়ে এখানে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছেএকটা সময় এমন একটা ধারণা ছিল। আর এখন বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে রকম একটি ধারণা বিরাজমান। অথচ দুটি ধারণাই ভুল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ গ্যাস অনুসন্ধানে এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। সুতরাং দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে ধারণা  থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া ঠিক নয়। নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান আহরণকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সাগরের গ্যাস দেশের জ্বালানি সংকট লাঘবে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমার ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস সম্পদ আবিষ্কার আহরণ করে চলেছে। বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে-নির্ভর ডাটা প্যাকেজের অভাব। বিষয়ে নীতিনির্ধারণী মহলের জরুরি হস্তক্ষেপ আবশ্যক। আর স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান কর্মপরিকল্পনা হতে হবে বাস্তবধর্মী। কূপ খননে অসম চুক্তির ভিত্তিতে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় সংস্থা বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য কয়লার ক্ষেত্রেও। নতুন কয়লা খনি আবিষ্কার কয়লা উৎপাদনের শ্লথ ব্যবস্থাপনায় গতি আনা সরকারের জ্বালানি চ্যালেঞ্জের বড় উপাদান। এটি বিবেচনায় নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জোরালো উদ্যোগ কাম্য। এদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়, তারও পথরেখা খুঁজতে হবে। মোদ্দাকথা হলো, জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে দেশীয় সক্ষমতার ক্রমোন্নয়নের বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন