মহামারী ও ব্যক্তিজীবনের বিশৃঙ্খলা

বণিক বার্তা ডেস্ক

গোলমেলে পরিস্থিতির  শুরুটা হচ্ছে হোম অফিসের টেবিলে থাকা আলগা কাগজপত্র কলম দিয়ে। সারাহ ফ্রান্সেস হিকস ভেতরে আটকে থাকা অবস্থায় তার ডেস্কে নতুন এক বিশৃঙ্খলার পাহাড় জমা হয়ে থাকতে দেখলেন। হিকসের দাদা মারা যান মহামারী শুরুর আগে এবং লকডাউন চলাকালে তিনি কাজের মধ্য দিয়ে সময় কাটান। তিনি পুরনো প্রকল্প শেষ করার আগে নতুন প্রকল্প শুরু করার মতো মানুষ নন। তিনি দ্রুত দায়িত্ব  হস্তান্তর করেন এবং তারপর ছোট উকুলুলে, টোয়ার্লিং ব্যাটন এবং ভায়োলিন কেস, পুরনো স্বরলিপির বই এবং দাদার ল্যাপটপ দিয়ে ডেস্ক ভর্তি করলেন। কিন্তু তার কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

অরল্যান্ডোর ফ্রিল্যান্স রাইটার হিকস বলেন, আমি বিশৃঙ্খলার মধ্যে কাজ করতে পারি না। তিনি সাধারণত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কফি শপে কাজ করাকে প্রাধান্য দেন। হিকস বলেন, নিজের কাজে মনোযোগ দেয়ার জন্য আমার সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। যখনই আমি কোনো বিশৃঙ্খলা দেখি, আমি সেটাকে ঠিক না করা পর্যন্ত অন্য কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারি না।

এমন না যে হিকস একাই এমন কিছু অনুভব করছেন, কভিড-১৯ এড়াতে অনেক মানুষকে যখন ঘরে থাকতে হচ্ছে এবং বাসায় বসে কাজ করতে হচ্ছে তখন এমন অনুভূতি আরো তীব্র হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এবং সম্ভবত আরো আগে থেকে প্রচলিত জ্ঞান সফলতাকে যুক্ত করেছে শুদ্ধতার সঙ্গে। ধর্মতত্ত্ববিদ জন ওয়েসলি ১৭৭৮ সালে বলেন, পরিচ্ছন্নতা ধার্মিকতার নিকটবর্তী।

সাম্প্রতিক সময়ে স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন আমাদের চেতনা, আবেগ, মানসিক স্বাস্থ্য, আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা এবং আরো অনেক কিছুর ওপর বিশৃঙ্খলার প্রভাব নিয়ে। গবেষকরা নিম্ন মানের কর্মপরিবেশ যেমন প্রখর আলো হট্টগোলসম্পন্ন অফিসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন কাজের উৎপাদনশীলতা কাজ নিয়ে সন্তুষ্টির বিষয়গুলো। এলোমেলো বিশৃঙ্খল কর্মক্ষেত্র উদ্বেগের স্তরকে বাড়িয়ে দেয়।

নিউরোইমেজিং দেখায় কিছু মানুষের মস্তিষ্ক অবেচতনভাবেই কেবল সুশৃঙ্খল চিত্রে প্রতিক্রিয়া দেখায়। পরিপাটি চিত্র অনেক দর্শককে এক ধরনের প্রশান্তির অনুভূতি দেয়। কিন্তু বিশৃঙ্খল অবস্থা যখন আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে তখন এটা অনেককে উদ্বিগ্ন করে তোলে। অনেক মানুষের জন্য কর্টিসোল স্তর দ্রুত নড়াচড়া করতে থাকে এবং তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে অথবা দ্রুত দগ্ধ হতে থাকে। এই মানসিক অবস্থা আমাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। আবার অনেকের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিশীলতার চিহ্ন বহন করে।

লরেন্স জে পিটার যিনি পিটার প্রিন্সিপাল লেখক, তিনি জিজ্ঞাসা রেখে বলেছিলেন, যদি বিশৃঙ্খল ডেস্ক বিশৃঙ্খল মনের চিহ্ন বহন করে, তবে খালি ডেস্ক কিসের চিহ্ন বহন করবে? লাইনটার দায় অবশ্য ভুলবশত প্রায়ই আলবার্ট আইনস্টাইনের ওপর চাপানো হয়, যার আসলেই বিশৃঙ্খল ডেস্ক ছিল, একইভাবে আরো অনেক চিন্তকদের ক্ষেত্রেও, যেমন টমাস এডিসন স্টিভ জবস। মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা বলছে, একদল ছাত্র যারা বিশৃঙ্খল জায়গায় কাজ করেছে তারা যারা পরিষ্কার জায়গায় কাজ করেছে তাদের চেয়ে অধিক সৃষ্টিশীলতা দেখিয়েছে।

পরিষ্কারভাবেই, বিশৃঙ্খলা কিছু মানুষের জন্য অন্যদের চেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি করে। আর যখন এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ ঠিক করা হয়, সেটি অনেকের কাছে সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু অনেকে এমন পরিবেশে থাকে যা পরিবর্তন করা যায় না, তখন মানিয়ে নেয়াটাই প্রয়োজনীয়।

আপনার বিভক্ত মনোযোগ

২০০৮ সাল থেকে নিউরোলজি সাইকোলজির প্রফেসর সাবিনে কাস্টনার মনোযোগের বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জিজ্ঞাসু  ছিলেন কীভাবে মানুষের মস্তিষ্ক আমাদের এলোমেলো পরিবেশে এবং বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া জানায় তা জানতে। কাস্টনার গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের রাস্তার দৃশ্য দেখান এবং ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এফএমআরআই) স্ক্যানের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কের সক্রিয় অংশে রক্তের পরিবহন পর্যবেক্ষণ করেন।

বেশ কয়েক বছর ধরে একাধিক পরীক্ষায় কাস্টনার অংশগ্রহণকারীদের ছবির বস্তুতে মনোযোগ দিতে বলেন, যেমন ব্যক্তি কিংবা গাড়ির ওপর। প্রতিটি কেসে ফ্রন্টাল কর্টেক্স, যা কিনা চেতনা নিয়ন্ত্রণে, স্মৃতি, মনোযোগ এবং আবেগী প্রতিক্রিয়ায় গুরুত্বপূূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা এফএমআরআই স্ক্রিনে দৃশ্যমান হয়। অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্ক ছবির যেকোনো একটা জিনিস প্রক্রিয়াকরণের তুলনায় মনোযোগ দেয়ার জন্য অনেক শক্তি খরচ করে।

কাস্টনার বলেন, আমাদের অনেকেই বিশৃঙ্খলা প্রক্রিয়াকরণে ভালো নন। এটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে এবং সহজ কাজ সম্পাদন করার জন্য আমাদের মস্তিষ্ককে দিয়ে অনেক পরিশ্রম করাতে পারে। যত বেশি উদ্দীপক বিষয় মোকাবেলা করব, তখন আমাদের মস্তিষ্ককে আমরা যা চাই তা বের করতে অনেক বেশি কাজ করতে হবে।

২০১১ সালে কাস্টনার দেখলেন, যেসব মানুষ নিজেদের ঘর এবং কাজের জায়গা পরিচ্ছন্ন রাখে তারা অনেক ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারে এবং তাদের উৎপাদনশীলতাও বেশি। অন্য গবেষণাও নিশ্চিত করেছে যে ভিজুয়াল প্রতিবন্ধকতা কমানোর মাধ্যমে চেতনার বোঝাও কমানো যায় এবং স্মৃতিকেও চাপমুক্ত রাখা যায়। আমাদের পরিবেশ আমাদের মনোযোগকে প্রভাবিত করে, যা আমাদের হরমোন মেজাজকেও প্রভাবিত করে।

মহামারী পরবর্তী দুনিয়ায় স্কুল সম্ভবত আর আগের মতো হবে না। বিচক্ষণ শিক্ষকরা নিউরোসায়েন্সের শক্তি ব্যবহার করে বিশৃঙ্খলা দূর করবেন এবং শিক্ষণকেন্দ্রিক স্থান তৈরি করবেন। ফ্লোরিডার একটি বিশেষায়িত হাইস্কুলের শিক্ষক জারড স্মিথ, যিনি জানেন সংগঠিত স্বাচ্ছন্দ্যময় ক্লাসরুম বিশৃঙ্খল পরিবেশের চেয়ে বেশি শিক্ষণ উপযোগী। তাই তিনি তার ক্লাসকে সেভাবে সাজিয়েছেন। দেয়ালগুলো চিত্রকর্ম  দিয়ে সাজিয়েছেন এবং প্রচলিত ডেস্কের পরিবর্তে নান্দনিক টেবিল রোলিং চেয়ার দিয়েছেন। তিনি পরিচ্ছন্নতা, খোলা জায়গা এবং আরামদায়ক বসার স্থানের ওপর জোর দেন। এসবের পরিবর্তনের ফলে ছাত্রছাত্রীদের ফলও ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মহামারীকালে আমরা যখন বাসা থেকে কাজ করছি, তখন এই বিশৃঙ্খলা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে এসেছে। কারণ পরিবেশ আমাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন