উন্নয়ন ভাবনা-৩

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ

মোহা. কাওসার আলী

দুর্নীতি সম্ভবত একটা সর্বজনীন বিষয় বা অবস্থা (universal phenomenon)। মানব ইতিহাসে দুর্নীতিবিহীন সমাজ বা রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে মাত্রাগত পার্থক্য অবশ্যই আছে। সে কারণে বিশেষজ্ঞগণ মাঝে মধ্যে সহনীয় বা অসহনীয় শব্দের ব্যবহার করে থাকেন।

দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রধান বাধা এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কারণ দুর্নীতি অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ কমিয়ে (reduce) দেয়, বিদেশী বিনিয়োগ (FDI) নিরুৎসাহিত করে, সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো উন্নয়ন (maintenance) এর মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে সহজেই দুর্নীতি করা যায় এমন কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে (less efficient but more manipulable public projects) সরকারি ব্যয় স্থানান্তরিত (shift) করতে উৎসাহিত করে। যে কারণে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য ই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দুর্নীতি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত।

আমরা যদি এশিয়ার সামনের সারির দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাবো দুর্নীতি প্রতিরোধে সাফল্য এসব দেশের উন্নয়নে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন ২০১৯ সালে TI (Transperancy International) এর দুর্নীতি সূচকে  ১৯৮টি দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর-০৪, জাপান-২০, দক্ষিণ কোরিয়া-৩৯ ও মালয়েশিয়া-৫১। বিপরীতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ নম্বরে।

তাহলে চলুন আমরা একটুখানি পর্যালোচনা করে দেখি দেশগুলো কীভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে-

দক্ষিণ কোরিয়া
স্বাধীনতার পর ১৯৬০ এর দশকের শুরুতেও দক্ষিণ কোরিয়া ছিল চরম দুর্নীতিগ্রস্থ (rampant corruption) দরিদ্র একটি দেশ। হতাশাজনকভাবে সমাজের উপর থেকে নিচে পর্যন্ত সকলের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ ছিল দুর্নীতি। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দারিদ্র্য বিমোচনের প্রক্রিয়াটার শুরু হয়েছিল Park Chung-hee -র হাত ধরে ১৯৬১ সালে।

Park Chung-hee -র একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল দারিদ্রের ইতি টানা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে তৃতীয় পর্যায় (Third World economy) থেকে প্রথম পর্যায়ের অর্থনীতিতে (First World economy) উন্নীত করা। তিনি ‘we can do anything if we try’ কে শ্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দৃঢ়তার সাথে বলেন শুদ্ধ ইচ্ছাশক্তি (sheer willpower) থাকলে যে কোন সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এবং বাস্তবে এ অঙ্গীকারের সুস্পষ্ট সাফল্য ও প্রতিফলন আমরা দেখেছি।

১৯৬৩ সালে শুরু হওয়া প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় তুলনামূলক অধিক কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম এমন রপ্তানিমুখী বৃহৎ ভারী শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে স্বল্পসংখ্যক উদ্যোক্তাকে রাষ্ট্র থেকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্র ও উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক দৃঢ়তা ও আন্তরিকতায় তা সাফল্য পায়। এর ধারাবাহিকতায় Hyundai, LG (Lucky Goldstar), Samsung এর মত আন্তর্জাতিক মানের বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এবং তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে অর্থনীতির সকল সেক্টরে অক্টোপাসের মতো (এ ধরনের বিনিয়োগকে octopus nature বলে অভিহিত করা হয়) বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করতে থাকে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় এবং রেখে চলেছে।

পাশাপাশি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণেও দক্ষিণ কোরিয়া অনেকটাই সফল (relatively successful)। যদিও তা ধনী দেশগুলোর সংগঠন OCED (Organization for Economic Cooperation and Development)  এর নির্ধারিত মানে পৌঁছাতে পারেনি এখনো। তথাপি CPI Index নির্দেশ করছে এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া যথেষ্ট উন্নতি করেছে এবং তা চলমান আছে। CPI Index এ ২০১৪ তে ১৭৪ টি দেশের মধ্যে ৪৪ নম্বরে এবং ২০১৯ সালে ১৯৮টি দেশের মধ্যে ৩৯ নম্বরে। যেখানে বাংলাদেশ ১৪৬ নম্বরে অবস্থান করছে।

সিঙ্গাপুর

স্বাধীনতার পর ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে সিঙ্গাপুর ছিল সম্পূর্ণ একটি অনুন্নত দেশ এবং দুর্নীতি একটি মারাত্মক সমস্যা এবং জীবনের অংশ (serious problem and way of life) ছিল। তখনকার ৩০ লাখ লোকের অধিকাংশ বেকার। জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বস্তিবাসী। প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত দুর্বলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। 

সমাধান হিসেবে শ্রমঘন( labour intensive) শিল্পায়নে গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে নিজেদের কোন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা না থাকায় উন্নত বিশ্ব এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগকে সর্বোত্তম সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কঠোরভাবে দুর্নীতিমূক্ত নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছিল।

দুর্নীতি প্রতিরোধে পৃথিবীতে সবচেয়ে সফল শীর্ষ দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুরের অবস্থান চতুর্থ আমরা ইতোমধ্যেই তা জেনেছি। এই সাফল্যের পেছনের ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলো মোটামুটি এরকম-

১. সদ্য স্বাধীন দেশে নিজেদের সরকারের(self government) শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী Lee Kuan Yew এর নেতৃত্বাধীন সরকারের নেতারা সততা ও আন্তরিকতায় (honesty and integrity) ব্যক্তিগতভাবে উদাহরণ তৈরি করে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে তা অনুসরণ (follow) করতে নির্দেশ দেয়
২. সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের কোন ধরনের দুর্নীতিকে সহ্য করা হয় না
৩. সবচাইতে মেধাবীদের (best and brightest) সিভিল সার্ভিসে আনতে মেধাবীদের যথার্থ মূল্যায়নসহ আকর্ষণীয় বেতন (salaries) প্রদান
৪. মাদক ব্যবসা ও ভয়াবহ ধরনের দুর্নীতিবাজদের মৃত্যুদন্ড প্রদান ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা
৫. জাতীয়, রাজনৈতিক ও কর্পোরেট ঐক্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন লোকদেরকে সংক্ষিপ্ত বিচারে দ্রুত জেলে প্রেরণ
৬. দুর্নীতি প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন প্রনয়ন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অব্যাহত সংস্কার সাধন
৭. দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
৮. ব্যক্তির অবস্থান, মর্যাদা বা রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে আইনের বৈষম্যহীন (impartial) প্রয়োগ।

এতসব পদক্ষেপের সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে সিংগাপুর এখন দুর্নীতি প্রতিরোধে সফল দেশের তালিকায় বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম অবস্থানে। আরো অবাক করা বিষয় হলো সিংগাপুর সেই ১৯৯৫ সাল থেকে এক্ষেত্রে এশিয়ায় তার প্রথম স্থান ধরে রেখেছে। 

ফলস্বরূপ শুরু থেকেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা-বান্ধব আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি হয়। এককভাবে বা জয়েন্ট ভেঞ্চারে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। জিডিপি বাড়তে থাকে ডাবল ডিজিটে। এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর অন্যতম সেরা উন্নত দেশে রূপান্তর ঘটে।

মালয়েশিয়া
১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। কোন সন্দেহ নেই তার সফল নেতৃত্ব পশ্চাৎপদ মালয়েশিয়াকে একটি আধুনিক উন্নত ও সমৃদ্ধ মালয়েশিয়ায় পরিণত করেছে।

মালয়েশিয়াকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা সংস্কার ও শিল্পায়নের পাশাপাশি দুর্নীতি বিরোধী দৃঢ় অবস্থান হচ্ছে মাহাথিরের উল্লেখযোগ্য জাদুকরী পদক্ষেপ। মাহাথিরের আমলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। তবে শর্ত পরিপালনে কোন ছাড় দেয়া হতো না। সেখানে শর্তগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ-

১. কোন প্রতিষ্ঠান একবারের বেশি এ সু্যোগ পাবে না
২. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে
৩. কোনভাবেই প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা যাবে না
৪. কাজের উচ্চ মান বজায় রাখতে হবে।

দক্ষ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্রের দায়িত্ব ছিল মনিটরিং ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকে।

আশির দশকে গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, হাইওয়ে নির্মাণসহ মাহাথিরের অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে। ১৯৮১ সাল থেকে পরবর্তী ১০/১১ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ায় শিল্পায়নসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এতটাই বেড়ে যায় যে, ১৯৯২ সালে মালয়েশিয়া নিজের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান করেও প্রায় ৮ লক্ষ বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ করে। উৎপাদন ও রফতানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ মালয়েশিয়া এখন পৃথিবীর অন্যতম সফল রাষ্ট্র। 

২০১৯ সালে TI (Transperancy International) এর দুর্নীতি সূচকে ১৯৮ টি দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ার অবস্থান ৫১ তম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপকতা বিবেচনায় মালয়েশিয়া অনেকটা ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়।

পর্যালোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে এশিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলো পরিকল্পনামাফিক দুর্নীতি প্রতিরোধেও সফল। পাশাপাশি এটাও লক্ষ করা যায়-  দুর্নীতি প্রতিরোধে যে দেশ যত সফল অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সে দেশ তত বেশি এগিয়ে। দুর্নীতি সূচকে ৪ নম্বরে অবস্থানকারী সিংগাপুরের মাথাপিছু আয় ৬৪০০০ ইউএস ডলার, ৩৯ নম্বরের দক্ষিণ কোরিয়ার ৩১০০০ ডলার এবং ৫১ নম্বরের মালয়েশিয়ার ১২০০০ ডলার। আর ১৪৬ নম্বরে অবস্থানকারী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলার।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে দক্ষিণ কোরিয়া, সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নে বিস্ময়য়কর ভূমিকা রাখা ব্যক্তিত্ব যথাক্রমে Park Chung-hee, Lee Kuan Yew এবং মাহাথির মোহাম্মদ প্রত্যেকেই এককভাবে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যদিও দর্শনীয় উন্নয়ন সত্বেও তাদের শাসনকাল কিন্তু একেবারে বিতর্কহীন ছিল না।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তন,  দুর্নীতি প্রতিরোধসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদেরও দৃঢ় প্রত্যয় ছিল (১৯৭৫ সালের ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেখুন)। লক্ষ্য নির্ধারণেও কোন ঘাটতি ছিল বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এখন অনেক পেছনে।

তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চ্যালেজ্ঞ দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশ এখন ঐসব সফল দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে TI এর দুর্নীতি সূচক তালিকায় সম্মানজনক অবস্থানে যাওয়ার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতে অধিকতর জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে কিনা?

লেখক: সাবেক যুগ্মসচিব

e-mail: [email protected]


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন