মহামারী প্রতিরোধের রোলমডেল কিবেরা বস্তি

বণিক বার্তা ডেস্ক

কেনিয়ার নাইরোবিতে শহরের মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এলাকা কিবেরা। দেশটির বৃহত্তম এবং পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম বস্তিটির দেখা মেলে এখানেই। ১৩ মার্চ কেনিয়ার প্রথম নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পর পরই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কিবেরার বস্তি এলাকায়। শুধু মহামারী আতঙ্ক নয়, কর্মহীনতার অভিশাপেও বিপাকে পড়ে যায় কিবেরার বাসিন্দারা। কারণ কিবেরার অধিকাংশ বাসিন্দাই দিনমজুর, যাদের দৈনিক গড় আয় ডলারেরও কম।

বারোটি মহল্লায় বিভক্ত আড়াই কিলোমিটার বিস্তৃত বস্তির মোট বাসিন্দা প্রায় আড়াই লাখ। জনবহুল ক্ষুদ্র এলাকায় প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মহামারী পরিস্থিতিতে কিবেরা যে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলেন সবাই।

অবস্থায় মহামারী থেকে বস্তিবাসীদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ স্থানীয় জনসাধারণ। ব্যবস্থা করা হয় ফ্রিতে সুপেয় পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন সুবিধা, হাত ধোয়ার জন্য হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশনসহ নানা সেবা সুবিধার। একই সঙ্গে বস্তিতে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তা কতটা ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে, সে বিষয়েও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।

এমনই এক সংস্থা কিবেরা টাউন সেন্টারের (কেটিসি) টেকনিক্যাল ম্যানেজার বাইরনস খাইংগা জানান, বস্তিবাসীদের এসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে বর্তমানে তার সংস্থা পরিচালিত একটি ফ্যাসিলিটি থেকে প্রতিদিন ৮০০ থেকে হাজার মানুষ সেবা নিচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্রিতে এসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি আমরা বর্তমানে যত বেশি সম্ভব মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছি। সচেতনতা কার্যক্রম থেকে যাতে কেউ বাদ না যায়, সেজন্য আমরা এখানে প্রচলিত সবগুলো ভাষাই ব্যবহার করছি। আমরা প্রতি ২০ মিনিট পর পর ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়ার পাশাপাশি মাস্ক পরার পদ্ধতি উপকারিতা নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। বস্তি এলাকাসংলগ্ন বাস টার্মিনাল, বাজার, দোকান, গণশৌচাগার অন্যান্য স্থানে অন্তত একটি হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

স্থানীয় অধিবাসীদের বোঝানো হচ্ছে সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তার কথাও। বেসরকারি একটি সংস্থার উদ্যোগে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্যসংবলিত পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে কিবেরার বড়-ছোট সব গলি। এসব পোস্টার এমন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে, যাতে তা সবার চোখে পড়ে সহজেই। করোনাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যসংবলিত রেকর্ড বাজিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে মোটরসাইকেলে করে।

এসব পদক্ষেপ ফলপ্রসূ বলে প্রমাণও হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরাও গোটা বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। হ্যান্ড ওয়াশিং ক্যাম্পেইন স্থানীয়দের মধ্যে বেশ ভালোই সাড়া ফেলেছে। কিছুটা অস্বস্তি হলেও বিষয়টিকেনিউ নরমালহিসেবেই দেখছে তারা। ফলে যেভাবে ধারণা করা হয়েছিল কিবেরা এলাকায় তেমন একটা প্রকোপ ছড়ায়নি করোনা। বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই এখন -সংক্রান্ত কমিউনিটি সেবা কার্যক্রমেও যুক্ত হয়েছে। ফলে বস্তি এলাকাটিতে এখন সামাজিক সংক্রমণ নেই বললেই চলে। জনবহুল বস্তি এলাকায় সংক্রমণ প্রতিরোধে কিবেরা এখন গোটা বিশ্বেই রোলমডেল হিসেবে বিবেচিত।

শুধু কিবেরা নয়, গোটা বিশ্বেই বড় বড় বস্তি এলাকায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে এক ধরনের আতঙ্ক শুরু থেকেই ছিল। দেখা গিয়েছে, যেসব স্থানে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা স্থানীয় জনসাধারণ একযোগে সংক্রমণ মোকাবেলায় উদ্যোগী হয়েছে, সেসব স্থানেই সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গিয়েছে। 

সম্প্রতি এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি এলাকা মুম্বাইয়ের ধারাবির তিনটি মহল্লায় করোনার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত। শহরের পৌর কর্তৃপক্ষ, সরকারি থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগ এবং টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ যৌথভাবে সমীক্ষা চালায়।

গবেষণার ফলাফল বলছে, বস্তি এলাকাটিতে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি এতদিন যা ধারণা করা হচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।

বিশ্বের বিভিন্ন বস্তির মোট বাসিন্দা প্রায় ১০০ কোটি। অর্থাৎ প্রতি সাতজন মানুষের প্রায় একজন বস্তিবাসী। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, নিম্নমানের আবাসন ব্যবস্থা, মৌলিক সেবায় প্রবেশাধিকারের অভাব, দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা দারিদ্র্যের কারণে এসব বস্তিবাসী যেকোনো মহামারীতে থাকে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে। মুম্বাইয়ের ধারাবি, পাকিস্তানের ওরাঙ্গি টাউন, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের খায়েলিৎসা, মেক্সিকোর নেজা কেনিয়ার কিবেরাবিশ্বের বৃহত্তম পাঁচ বস্তি সংলগ্ন এলাকায় নিম্নবিত্তের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এর মধ্যে কিবেরা ছাড়া অন্য চারটি বস্তিতেই মারাত্মক আঘাত হেনেছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। অন্যদিকে ব্যতিক্রম কিবেরা হয়ে উঠেছে জনবহুল বস্তি এলাকায় মহামারী প্রতিরোধের রোলমডেল হিসেবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন