ইঞ্জিন-লোকবল সংকটে নাজুক পণ্য পরিবহন সেবা

যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি রেলওয়ে

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

যাত্রী পরিবহন খাতে লাভের পরিবর্তে ভর্তুকি দিয়ে সেবা পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলের অপারেটিং আয় হয় মূলত পণ্যবাহী ট্রেন সেবা খাত থেকে। তবে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা হিসেবে জনগণকে সেবা প্রদানের কারণে যাত্রীবাহী ট্রেনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পণ্য পরিবহনে খাতটি প্রায়ই থাকে অবহেলিত। ট্রেন পরিচালনার আনুষঙ্গিক সুবিধা সংকটে চাহিদা অনুপাতে পণ্যবাহী ট্রেন চালাতে পারত না রেলওয়ে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ২৫ মার্চ থেকেই রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন সেবা প্রায় বন্ধ রয়েছে। সময় রেলের আনুষঙ্গিক সুবিধাগুলো অব্যবহূত থাকলেও পণ্য পরিবহন খাতে তা ব্যবহার করতে পারেনি রেলওয়ে। গত কয়েক মাসে রেলের পণ্য পরিবহনের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনায় তথ্য জানা গেছে।

রেলের যেকোনো ট্রেন পরিচালনার প্রধান শর্ত হচ্ছে ইঞ্জিন, বিএফসিটি, ওয়াগন, কোচ, লোকবল, ভালো মানের রেলপথ, ত্রুটিহীন সিগন্যালিং ব্যবস্থা ইত্যাদি। মালবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন সংকটে ভুগছিল। প্রতিদিন সারা দেশে প্রায় ৩০টির বেশি মালবাহী ট্রেন চলাচল করলেও ইঞ্জিন পাওয়া যেত চাহিদার তুলনায় কম। মালবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য যেসব ইঞ্জিন সরবরাহ করা হতো, সেগুলো ছিল সবচেয়ে নিম্নগতির এবং সবচেয়ে পুরনো। তবে নভেল করোনাভাইরাসের সংকটকালে সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে ইঞ্জিন সরবরাহে কোনো সমস্যা নেই। এর পরও সময়ে গুডস পরিবহন খাতে আয় বাড়েনি। একই সময়ে রেলের অপারেশনাল কাজে নিযুক্ত লোকবলের সিংহভাগই অলস বসে থাকলেও সেটিও কাজে লাগাতে পারেনি রেলওয়ে।

বিষয়টি উঠে এসেছে রেলের সাম্প্রতিক বেশকিছু নথিতেও। পূর্বাঞ্চলের গুডস পণ্য পরিবহন হিসেবে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত রেলওয়ে পণ্য পরিবহন করেছে লাখ ১৯ হাজার ৯০ টন। অথচ ২০১৯ সালের মার্চ-জুন পর্যন্ত চার মাসে পণ্য পরিবহন করেছিল লাখ ৬৫ হাজার ২৩৯ টন। কারণে রেলের খাতে আয় প্রায় কোটি টাকা কমে নেমে এসেছে ১৯ কোটি ২৭ লাখ ১৩ হাজার ৭৫০ টাকায়।

মালবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী স্টেকহোল্ডারদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব। সড়ক নৌপথে যে সময়ে পণ্য পৌঁছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগে ট্রেনে। যাত্রীবাহী ট্রেনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আগে মালবাহী ট্রেনগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথিমধ্যে বা বিভিন্ন সেকশনে বসিয়ে রাখা হতো। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল না করা বা সীমিত আকারে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করায় বিরতিহীনভাবে মালবাহী ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে গ্রাহকদের সুবিধা দেয়ার সুযোগ ছিল গত কয়েক মাসে। কিন্তু রেলের প্রচারণার অভাব, দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় নভেল করোনাভাইরাসের সময়ে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনায় জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেনি রেলওয়ের পরিবহন বাণিজ্যিক বিভাগ।

মার্চে পূর্বাঞ্চলে ৮২ হাজার ৫৭৮ টন পণ্য পরিবহনের পর এপ্রিলে পণ্য পরিবহন নেমে আসে মাত্র ৩৬ হাজার ৫২ টনে। এরপর মে মাসে পরিবহন বেড়ে ৪৮ হাজার ৯১৩ এবং জুনে কিছুটা বেড়ে ৫১ হাজার ৫৪৭ টনে উন্নীত হয়। যদিও ২০১৯ সালের মার্চে ৭২ হাজার ৯৪৭ টন, এপ্রিলে ৬২ হাজার ৪৮৯, মে মাসে ৬৬ হাজার ৭৯৭ জুনে পণ্য পরিবহন হয়েছিল ৬৩ হাজার টন। 

এদিকে করোনাকালে কনটেইনার, জ্বালানি, খাদ্যশস্যের মধ্যে সরকারি খাদ্যপণ্য পরিবহন বেড়েছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ১৯ হাজার ৩৯৭ টন সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহন হলেও চলতি বছরের একই সময়ে (চার মাস) পরিবহন হয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৭ টন। এর মধ্যে মার্চে হাজার ৯০৮ টন, এপ্রিলে ১৩ হাজার ৭০৫ টন, মে মাসে ১০ হাজার ৮৬ টন জুনে সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহন হয়েছে হাজার ৬৩৮ টন।

এদিকে কনটেইনার পরিবহনেও নাজুক পরিস্থিতি পার করছে রেলওয়ে। মার্চে ৫০ হাজার ৭৮ টন কনটেইনার পণ্য পরিবহন করলেও এপ্রিলে সেটি নেমে আসে হাজার ৮৯৯ টনে। এরপর মে মাসে কিছুটা বেড়ে ২২ হাজার ৮২৭ টনে উন্নীত হলেও জুনে এসে ফের কমে ১৬ হাজার ৮৩৬ টনে নেমে যায়। 

যদিও রেলওয়ের দায়িত্বশীলরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দেশের আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় বিগত কয়েক মাসের পণ্য পরিবহন আয়ে প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া জ্বালানি পরিবহনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় রেলপথের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রেলপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হলেও রেলওয়ে শুধু বন্দর কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। কারণে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দুর্যোগকালে রেলের মাধ্যমে বড় আকারের পণ্য পরিবহন কার্যক্রম চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে রেলওয়ে।

যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকার সুযোগে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ী বা স্টেকহোল্ডারদের কাছে রেলওয়ের জনপ্রিয়তা অর্জনের সুযোগ থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সাদেকুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা করোনাকালে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকায় রেলপথে পণ্য পরিবহনের জন্য বন্দরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু বৈশ্বিক বিরূপ পরিস্থিতির কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কম হওয়ায় রেলওয়ে সুবিধা করতে পারেনি। আশা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে আগের মতো রেলপথে পণ্য পরিবহন আরো বাড়ানো সম্ভব হবে।

রেলের সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২৬ মার্চ থেকে রেলের প্রতিদিনকার চলাচল করা ৩৪৮টি ট্রেনের মধ্যে প্রায় ৩১৭টিই বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। ৬৭ দিন পর অর্থাৎ ৩১ মে থেকে প্রথম দফায় জোড়া এবং মে থেকে আরো ১১ জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করে রেলওয়ে। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আর নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে না। সময়ে রেলের ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকৌশলগত সুবিধা অলস বসেই আছে। সময়ে সড়কপথে পরিবহন সংকট, ঝুঁকির কারণে পরিবহন শ্রমিকদের অভাব এবং সড়কপথের পরিবহন খরচ তুলনামূলক বেশি হলেও রেলপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি রেলওয়ে।

রেলসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, রেলওয়ে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশে পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিলে কৃষিজ পণ্য, আম কোরবানির ঈদের আগে পশু পরিবহনের একাধিক উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসায়ীদের পণ্য পৌঁছানোর বিষয়ে রেলের সদিচ্ছা থাকলেও উদ্যোগে ঘাটতি ছিল। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা রেলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এখনো আস্থাহীন। করোনাকালে পরিবহন সংকট, পরিবহন শ্রমিক সংকট ছাড়াও নানা সমস্যার মধ্যে ছিল বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। সড়কপথের নানা সমস্যা সত্ত্বেও রেলপথে পণ্য পরিবহনে এগিয়ে আসেনি তারা। রেলপথে পণ্য পরিবহনের দীর্ঘসূত্রতা, গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব, পণ্য পৌঁছানোর পর অন্য একটি পরিবহনে করে নির্ধারিত মূল গন্তব্যে পণ্য নিয়ে যাওয়ার সমস্যায় ব্যবসায়ীরা রেলপথ বিমুখ বলে মনে করছেন তারা।

প্রসঙ্গত, রেলের কনটেইনারসহ পণ্য পরিবহনকে বেগবান করতে ২০১৬ সালে রেলওয়ে কনটেইনার সার্ভিস করপোরেশন নামের একটি পৃথক কোম্পানি গঠন করে রেলওয়ে। এজন্য একজন সার্বক্ষণিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু না হওয়ায় রেলপথে সম্ভাবনাময় পণ্য পরিবহন কার্যক্রমও বাড়াতে পারছে না রেলওয়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন