কভিড-১৯-এর সময়ে বিজ্ঞানীদের সেলফ এক্সপেরিমেন্ট

বণিক বার্তা ডেস্ক

সাম্প্রতিক সময়ে কভিড পার্টির বিষয়ে বেশ গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এমনকি এই উদ্ভট পার্টিতে অংশগ্রহণ করার পর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অবশ্য ইতিহাস বলছে, এর আগেও এমন পার্টি হয়েছে, যদিও ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯১৪ সালে ইউএস পাবলিক হেলথ সার্ভিস সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জোসেফ গোলবার্গারকে দায়িত্ব দেয় পেলাগ্রা রোগের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য। এই চর্মরোগটি পরিচিত ছিল ফোর (চার) ডিএস নামেডারমাটাইটিস, ডায়রিয়া, ডিমেনশিয়া ডেথ।

অনেক ডাক্তার সে সময় বিশ্বাস করতেন যে পেলাগ্রা অজানা জীবাণু থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। কিন্তু গোল্ডবার্গার শক্তভাবে বিশ্বাস করতেন যে এটি মূলত পুষ্টির অভাবের কারণে হয়ে থাকে। এটি প্রমাণের জন্য তিনি এবং তার স্ত্রী ম্যারি একটি ছোট আয়োজন করেন। যেখানে তারা এবং আরো কয়েকজন সাহসী স্বেচ্ছাসেবী নিজেদের শরীরে পেলাগ্রা আক্রান্তের রক্ত ইনজেক্ট করে এবং পিল আকারে রোগীদের মলমূত্র খেয়ে ফেলেছিলেন। নিজের গবেষণার যথার্থতা প্রমাণে তিনি একাধিকবার কাজের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। ক্যান্সারে ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন গোল্ডবার্গার, কিন্তু তার আগে গবেষণাকর্মের জন্য চারবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন তিনি।

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিজ্ঞানীদের সেলফ এক্সপেরিমেন্টের (স্ব-পরীক্ষা) এমন নজির রয়েছে, কভিড-১৯-এর মহামারীও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বব্যাপী গবেষকরা নিজেদের শরীর উৎসর্গ করেছেন সার্স-কোভ--এর চিকিৎসায় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য।

ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের হিস্ট্রি অব মেডিসিন বায়োএথিকসের প্রফেসর সুসান লেডেরার বলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে (সেলফ এক্সপেরিমেন্ট) একটি স্বীকৃত ঐতিহ্য। এটা প্রয়োজনীয় ছিল। আপনি নিজের এবং আপনার সন্তানের শরীর ঝুঁকিতে ফেলছেন, যা কিনা আপনার উত্তম বিশ্বাসের চিহ্ন বহন করে।

এর অনেকগুলো বিখ্যাত উদাহরণের একটি হচ্ছে, ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গে ভাইরোলজিস্ট জোনাস সাল্কের। ১৯৫২ সালে অন্যদের দেয়ার আগে যিনি পোলিও ভ্যাকসিন সবার আগে নিজের এবং তার সন্তানের ওপর পরীক্ষা করেছিলেন। একইভাবে রাশিয়ার পোলিও বিশেষজ্ঞ দম্পতি ম্যারিনা ভরোশিলোভা এবং মিখাইল চুমাকোভ ১৯৫৯ সালে পোলিও ভ্যাকসিন তিন সন্তানের ওপর প্রয়োগ করে দেখেছিলেন।

ইয়েলো ফিভারের ভ্যাকসিনের বিকাশও ঘটেছিল এমন আত্মোৎসর্গ দ্বারা। মার্কিন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ওয়াল্টার রিডের নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল ভাইরাস নিয়ে অধ্যয়নের জন্য কিউবা গিয়েছিলেন স্পেন-আমেরিকা যুদ্ধের সময়। সে সময় রোগটি যে মশার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে এটা প্রমাণের জন্য রিডের বেশ কয়েকজন সহকর্মী ইচ্ছাকৃতভাবে মশার কামড় খেয়েছিলেন। ফলে তাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং জেসে লাজের নামে একজন মৃত্যুবরণও করেন। শুরুর দিকের এই কাজটি একাধিক সফল মশক নিধন প্রোগ্রামের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, যা কিনা সংক্রমণের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছিল।

এখন কভিড-১৯-এর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা আবারো নিজেদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করছেন। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউর প্রতিবেদন অনুসারে, র্যাপিড ডেপেলপমেন্ট ভ্যাকসিন কোলাবোরেশনের সহ-উদ্যেক্তা পিটারসেন এস্টেপ করোনাভাইরাসের ন্যাসাল ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। যেখানে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রজনন বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ জর্জ চার্চসহ আরো ২০ জন গবেষক যুক্ত হয়ে নিজেদের ওপরই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন। গত মাসে অনুলিপি করার জন্য তারা তাদের ভ্যাকসিনের খুঁটিনাটি অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন।

এর বাইরে টিয়ানজিন ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট হুয়াং জিনহাইয়ের একটি বিবৃতি যুক্তরাষ্ট্র চীনের মিডিয়া বিস্তৃতভাবে প্রচার করে। যেখানে তিনি দাবি করেন, তার ল্যাবে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের চারটি ডোজ তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন, এমনকি তা কোনো প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করার আগে। জুলাইয়ের শেষ দিকে চায়নিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের প্রধান গাও ফু বলেছেন, তিনিও পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি তিনি বলেন, আমি আশা করি এটা কাজ করবে।

একইভাবে মস্কোভিত্তিক গামালেয়া গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর অ্যালেকসান্দার গিনটসবার্গও সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন যখন তিনি দাবি করেন যে তিনিও কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। এজন্য তিনি প্রশংসিতও হয়েছেন।

আজকের দিনে কেবল বিশেষজ্ঞ ভাইরোলজিস্টদেরই নতুন ভ্যাকসিন তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়ার সুযোগ আছে এমন নয়, তথাকথিত বায়োহ্যাকার যাদের কয়েকজন বিজ্ঞানী, যারা একাডেমিয়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীন দল তৈরি করেছেন, তারা শরীরকে প্রভাবিত করার জন্য নিজেরাই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। মৃদু বায়োহ্যাকিং কারো ঘুম এবং ব্যায়াম পর্যবেক্ষণের মতোই সরল, কিন্তু এর চূড়ান্ত রূপটি যুক্ত থাকতে পারে ত্বকের নিচে কম্পিউটার চিপ স্থাপন বা নিজের শরীরে সিআরআইএসপিআর ডিএনএ গ্রহণের মতো, যেমনটা ২০১৭ সালে জোসিয়া জায়নার করেছিলেন।

জায়নার এবং অন্য বায়োহ্যাকার জাস্টিন অ্যাটকিন নিজেদের শরীরে নিজেরা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিষয়ে এমআইটি টেকনোলজি রিভিউর রিপোর্টার অ্যান্তোনিও রেগালাডো চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে কয়েকটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। যেখানে বলা হয়, ১০ জন এরই মধ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে ভ্যাকসিন গ্রহণ করে থাকতে পারেন, যদিও খবরটি সুনিশ্চিত না। যেহেতু ভ্যাকসিনটি তারা নিজেরাই মিশ্রিত করেছে তাই এটা তারা নিজেরাই গ্রহণ করেছেন।

হেলসিংকি ঘোষণাপত্রে (ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক মানুষের শরীরে পরীক্ষাবিষয়ক একগুচ্ছ নৈতিক মূলনীতি) সেলফ এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। এছাড়া নুরেমবার্গ কোডেও এর কোনো উল্লেখ নেই। আবার এই চর্চাটি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধও নয়। সাফল্যের বিরুদ্ধে তর্ক করা কঠিন হলেও এটাকে অবশ্য অনুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে সেলফ এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কিত যাবতীয় নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে মেডিকেল কমিউনিটি দ্বারাই নির্ধারিত হয়।

ওয়েজির গবেষণা বলছে, উনিশ বিশ শতকে নিজের ওপর পরীক্ষার ৪৬৫টি উদাহরণ পাওয়া গেছে। তবে ১৯৫০ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে এমন ঘটনা দেখা গেছে কেবল ৮২টি। তার পরও সেলফ এক্সপেরিমেন্টের সংযুক্তিতে সর্বশেষ নোবেল পুরস্কারের দেখা মিলেছে মাত্র পাঁচ বছর আগে। অ্যান্টি ম্যালেরিয়া ওষুধ আবিষ্কারের জন্য এটি পেয়েছিলেন তু ইউইউ। যিনি নিজের শরীরে প্রথম এটি প্রয়োগ করেছিলেন। লারডার অবশ্য মনে করেন সেলফ এক্সপেরিমেন্ট এখন আর সেভাবে আলোচনায় আসে না। কিন্তু এটি এখনো ঘটছে।

দ্য সায়েন্টিস্ট থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন