প্রস্তাবনা

এইচএসসির পরই বিসিএস একটি প্রায়োগিক প্রস্তাব

ড. এম এ মোমেন

এই শিরোনাম পাঠ করার পর যেসব প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা যাক:

বিষয়: ষড়যন্ত্র

. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র। . সরকারকে বিব্রত করার নতুন চক্রান্ত শুরু। . এই প্রস্তাবের পেছনে বিদেশী ব্যক্তির ইশারা রয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখা দরকার। . প্রতিবেশী দেশের সিভিল সার্ভিসের চেয়ে খাটো হয়ে যাবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস।

বিষয়: যোগ্যতা

. এইচএসসি পাস করা বালক বালিকা সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার উপযুক্ত হতে পারে না, নাবালকত্ব কাটতে আরো সময় দরকার। . সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণ একাডেমির কারিকুলাম ধারণ করতে কমপক্ষে গ্র্যাজুয়েট হওয়া দরকার। . রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল বিষয়ে আলোচনা তাদের সঙ্গে করা সমীচীন হবে না, গোপনীয়তা ধারণ করার মতো পরিপক্বতা তাদের আসেনি। . কম বয়সের চপলতা চাঞ্চল্য রাষ্ট্রীয় কাজে বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ না হয়ে তারা আবেগপ্রবণ হবে।

বিষয়: সেবা প্রদান

. নাগরিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ হবে। . বিচারবোধ বিবেচনাশক্তি যথেষ্ট পরিপক্ব না হওয়ায় সুবিচার নিশ্চিত করতে পারবে না। . সেবা প্রদানের প্রশ্নে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে না। . স্থানীয় প্রভাবশালীদের খপ্পরে পড়ে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে না।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে তিনটি বিসিএস পরীক্ষা

(১৯৭৬, ১৯৭৯ এবং ১৯৮২) দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালিত একটি প্রক্রিয়ায় হাজার ৬০০ নম্বরের পরীক্ষার মাধ্যমে সফল প্রার্থীদের নির্বাচন করা হয়। আমি ১৯৮২ ব্যাচে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিই। আমার স্নাতক পরীক্ষা ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ায় পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আমাকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। উত্তীর্ণ হয়ে আমি যখন চাকরিতে যোগ দিই, তখন ২৫তম বর্ষ শেষ পর্যায়ে। একই ব্যাচের আমার কোনো  কোনো বন্ধু তখন ৩১তম বর্ষ অতিক্রম করছেন।

আমার চাকরিজীবনের প্রথম তিনটি পোস্টিং যথাক্রমে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ কক্সবাজার। এতে আমার স্কুলজীবনে অর্জিত জ্ঞানের একাংশ কাজে লাগাতে পেরেছি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সাধারণ উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান আর বাংলা ইংরেজি কমবেশি শিখে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আমার স্কুলের নাম গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল। প্রধান শিক্ষক ছিলেন খান মুহাম্মদ সালেক। স্কুল আমার পড়ালেখার যে ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে, তাতে অবলীলায় স্নাতকধারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব ছিল। আমার ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভএই ১২ বছর কেটেছে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে: রোটারি প্রাইমারি স্কুল, ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল ঢাকা কলেজ। আমার কলেজের দুই বছর পরীক্ষায় কাজে লাগতে পারে এমন কোনো পড়ালেখা করিনি। তবে প্রচুর ফিকশন নন-ফিকশন পড়েছি। বিসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণীর স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবেএমন একটি বাধ্যবাধকতা ছিল। যদি ডিগ্রির বদলে ১২ বছরের স্কুল ফাইনাল (কলেজের দুই বছরও এতে অন্তর্ভুক্ত) পাসের পর বিসিএস পরীক্ষায় বসার সুযোগ থাকত এবং আমি যদি উত্তীর্ণ হতাম, তাহলে আরো সাড়ে সাত বছর আগে কর্মজীবন শুরু করতে পারতাম।

১২ বছরের স্কুল ফাইনাল বা এইচএসসির পর বিসিএসে বসার সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে তো আলোচনা করব, তার আগে ইকোনমিক ক্যাডারে বিসিএস নিয়োগ পদ্ধতির ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই।

২০১৮-এর নভেম্বরে ইকোনমিক ক্যাডার প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ায় এত বছর ধরে শুনে আসা ২৮ ক্যাডারের সংখ্যা কমে ২৭- স্থিত হয়। এই ২৭টির দুটি প্রধান ভাগ: সাধারণ ক্যাডার কারিগরি/পেশাগত ক্যাডার।

কারিগরি/পেশাগত এর মানে কী? কারিগরি কিংবা পেশাগত? নাকি কেবল কারিগরি চাকরিগুলোই পেশাগত চাকরি? বাকিগুলো সব অ্যামেচার নাকি? এটি প্রফেশনালিজমের যুগ। যদি পেশাগত দক্ষতা না থাকে, তাহলে তো রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া হলে রাষ্ট্রেরই সর্বনাশ হবে। ধরা যাক, একজন বিসিএস প্রকৌশলী গণপূর্ত সচিব আর অর্থনীতিতে পড়াশোনা করা একজন বিসিএস অর্থ সচিব। ধরা যাক, লোকপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (মন্ত্রিত্বের এই অংশটুকু প্রধানমন্ত্রী কেন নিজের সঙ্গে রাখেন, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই) তার ইউরোপীয় এক কাউন্টার পার্টের সঙ্গে দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন—‘হচ্ছেন গণপূর্ত সচিব, তিনি পেশাজীবী আরহচ্ছেন অর্থ সচিব, তিনি পেশাজীবী নন কিংবা অ্যামেচার। এভাবে দেখলে তো মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব এবং অধিকাংশ সচিবই পেশাজীবী নন। প্রফেশনালিজমের যুগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কিংবা বৈদেশিক সম্পর্ক সচিবের যদি পেশাজীবীর দক্ষতা না থাকে, তাহলে সরকার তাদের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসায় কেমন করে? যিনি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ, সারা পৃথিবীতেই তিনি তো ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল। কিন্তু বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ২৭টি ক্যাডার তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও পেশাগত ব্যবস্থাপকের দেখা মিলবে না।

রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা গ্রহণ নিয়োগের সুপারিশ করে থাকে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন। তারাই ঠিক করে দেয় কোনটা পেশাগত ক্যাডার আর কোনটা সাধারণ। বাংলাদেশ রেলওয়ে সার্ভিসের রেলওয়ে পরিবহন বাণিজ্যিক ক্যাডার হবে সাধারণ এবং কারিগরি উভয়ই। রেলওয়ে প্রকৌশল তো অবশ্যই কারিগরি/পেশাগত ক্যাডার।

যে কয়টিকে সাধারণ ক্যাডার বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে প্রশাসন, আনসার, হিসাব নিরীক্ষা, সমবায়, শুল্ক আবগারি, ইকোনমিক, পরিবার পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র, পুলিশ, ডাক কর। তবে খাদ্য, তথ্য, পশুসম্পদ, রেলওয়ে বাণিজ্যের একাংশ সাধারণ।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য যে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে এসএসসি থেকে স্নাতক পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষার যেকোনো দুটিতে দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণী একটির বেশি তৃতীয় বিভাগ নয়। এসএসসি এইচএসসিতে সিজিপিএ থেকে দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণী এবং অনার্সে দশমিক ২৫ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী নির্ধারণ করে থাকে।

তিন স্তরে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। প্রিলিমিনারি, রিটেন ভাইভা। এমসিকিউর মাধ্যমে প্রিলিমিনারি বা প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা নেয়া হয়। ২০০ নম্বরের এমসিকিউয়ে ১০টি বিষয়ের ওপর প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেবাংলা ভাষা সাহিত্য, ইংরেজি ভাষা সাহিত্য, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ, ভূগোল পরিবেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটার তথ্য প্রযুক্তি, গাণিতিক যুক্তি, মানসিক দক্ষতা, নৈতিকতা মূল্যবোধ সুশাসন। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবেন, তাদের জন্য ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা। সাধারণ ক্যাডারের জন্য নম্বর বণ্টন: বাংলা (২০০), ইংরেজি (২০০), বাংলাদেশ প্রসঙ্গ (২০০), আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ (১০০), গাণিতিক যুক্তি মানসিক দক্ষতা (১০০) এবং সাধারণ বিজ্ঞান প্রযুক্তি (১০০) কারিগরি/পেশাগত ক্যাডারে সাধারণ বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা, এক্ষেত্রে বাংলায় ২০০ নম্বরের পরিবর্তে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়।

লিখিত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবেন, ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা ডিঙিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন তারা। নিজের পছন্দ প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করে সাধারণ ক্যাডারের প্রার্থীদের ক্যাডার নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

বিসিএস পরীক্ষায় কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির নজির যেমন আছে, দুর্নীতির সুযোগও আছে বিষয়ে পৃথক নিবন্ধ রচিত হতে পারে।

বিসিএস পরীক্ষার জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ থেকে শুরু করে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে অভিযোগের শেষ নেই। কয়েকটি তালিকা দিচ্ছি:

. বিসিএসের জন্য জীবন থেকে বেশ কয়েকটি বছর হারিয়ে যায়। . এইচএসসির পর অন্তত চারটি বছর নষ্ট হয় বিসিএসে কী আসবে তা ভেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া উপেক্ষিত থেকে যায়। . ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারদের যারা সাধারণ ক্যাডারের জন্য নির্বাচিত হন, তারা শিক্ষা প্রশিক্ষণে রাষ্ট্রের বড় অপচয়। . কৃতকার্য সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে চাকরির প্রথম দিন থেকে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। . রাষ্ট্রই বিভিন্নভাবে ক্যাডারভিত্তিক শোষণ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয় ( নিয়ে পৃথক নিবন্ধ হতে পারে)

তালিকায় অন্তত এক ডজন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। আমি প্রস্তাব করব এইচএসসি (আইএ, আইকম, আইএসসি) পরীক্ষা সমাপ্ত করার পর পরই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের জন্য চাকরিপ্রার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় বসুন (পরীক্ষার মোডালিটিজ ঠিক করা যাবে, তবে মৌখিকে নম্বর অনেক কমিয়ে আনতে হবে) প্রিলিমিনারি লিখিত, মৌখিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চার বছরের আবাসিক স্নাতক কোর্সে ভর্তি হবেন। যাদের মধ্যে নির্বাচিত কিছুসংখ্যক প্রকৌশল চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ নেবেন সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠানে বা সুবিধামতো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে। কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্যও অনুরূপ সুযোগ সৃষ্টি করা হবেন। এই পাঠকাল তাদের অস্থায়ী চাকরিকাল হিসেবে বিবেচিত হবে। কাজেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক চাকরির অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত থাকবেন। যে শিক্ষা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভেন্টকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে পারবে সে শিক্ষার কারিকুলাম তৈরি করে প্রার্থীদের চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমাদের সিভিল সার্ভিসে ক্যাডারের ছড়াছড়ি কমিয়ে সর্বোচ্চ দশ- নিয়ে আসতে হবে। আবারো উল্লেখ করছি এইচএসসির পর পাবলিক সার্ভিস কমিশন যে পরীক্ষা নেবে, তা হবে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তির জন্য। ক্যাডার নির্বাচনের বিষয় আরো অনেক পরে আসবে। বিষয়টি রাষ্ট্র ভেবে দেখতে পারে। এটি সত্য, এটি সেনাবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট নয়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের। কিন্তু সামনে যদি একটি ভালো মডেল থাকে, সেটি অনুসরণ করা মঙ্গলজনকই হবে।

 

. এম মোমেন: প্রাবন্ধিক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন