পর্যালোচনা

খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ মরাল হ্যাজারড টাইপ-২

ড. শহীদুল জাহীদ

খেলাপি ঋণের বৈশ্বিক প্রমিত মান যেখানে শতাংশ বা তার নিচে, সেখানে বাংলাদেশে তা পাঁচ-ছয় গুণ বেশি। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বড় একটি সমস্যা। খেলাপি বা কুঋণ বলতে বোঝায় এর আগে সরবরাহকৃত ঋণ ফেরত না পাওয়া। এটা সত্যি যে সরবরাহকৃত ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ সাধারণত কুঋণ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং তা মোট ঋণের একটি অনুপাতে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ হার কমবেশি ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে ব্যাংক ১১ টাকা ফেরত পাচ্ছে না। ব্যাংক যদি কমবেশি ১০ শতাংশ সুদে ঋণদান করে, তবে সার্বিকভাবে নেট লোকসানের মুখে পড়ে। ব্যাংকিং খাতে অনাদায়ী পাওনা, খেলাপি বা কুঋণ যেভাবেই বলা হোক না কেন, এর মূল কারণগুলো উদ্ঘাটনে অতীতের ন্যায় বর্তমানেও তাই গবেষণা থেমে নেই।

অর্থনীতিবিদ বার্গার ডি ইয়াং ১৯৯৭ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের কারণগুলোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের কয়েকটি দেশের ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা করেন। তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ হলো মরাল হ্যাজারড বা নৈতিক বিপত্তি। মরাল হ্যাজারড বা নৈতিক বিপত্তির উত্পত্তি হয় তখনই, যখন চুক্তিবদ্ধ কোনো পক্ষ দায় থাকা সত্ত্বেও অন্য পক্ষের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট বা প্রাপ্তব্য সুবিধাদি সঠিকভাবে বা সঠিক পদ্ধতিতে দেখভাল করে না এবং সেজন্য তাদের জবাবদিহিতার জায়গাটাও অস্পষ্ট থেকে যায়। বার্গার ডি ইয়াং দেখান যে মালিকপক্ষের সরবরাহকৃত মূলধনের ব্যবস্থাপনা কর্তৃক সঠিক দেখভাল না করার কারণে অনেক দেনাদার ঋণখেলাপি হয়ে থাকেন। বার্গার ডি ইয়াংয়ের নৈতিক বিপত্তি তত্ত্বটিকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:

প্রতিটি ব্যাংকের মালিকপক্ষ তাদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে মূলধন সরবরাহ করে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী মালিকপক্ষ কর্তৃক সরবরাহকৃত মূলধনের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। এটাকে আমরা রেগুলেটরি মূলধন বলে থাকি। বাসেল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রেগুলেটরি মূলধন অনুপাতও সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ মিশ্রণে মূলধন অন্যতম উপাদান।

ব্যবসায়ের ধরনের কারণেই ব্যাংক খুবই নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বহুমাত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে প্রথমত মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রণ সুস্পষ্ট। মালিকরা যেহেতু মূলধন সরবরাহকারী, তাই ব্যাংক পরিচালনায় তারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে চান এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ে থাকেন। মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আসার যে যুক্তি তা হলো, সরবরাহকৃত মূলধনের সুরক্ষা। যদিও আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ কিন্তু মালিকরা প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপকেরও ভূমিকায় চলে আসেন। উল্লেখ্য, মালিকদের মধ্যে যারা খুবই ক্ষুদ্র সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, তারা সরাসরি ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তা পরিচালকরাই ব্যবস্থাপনায়ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাতে যে যুক্তিতে মালিকপক্ষের ব্যবস্থাপনায় থাকা, তা অনেকাংশেই ব্যাহত হয়।

সারাংশে বলতে গেলে, মালিকপক্ষ মনে করে যে ব্যবস্থাপকরা তাদের সরবরাহকৃত মূলধন সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিনিয়োগ না- করতে পারেন। ব্যবস্থাপকরা বাছবিচার না করে যদি সরবরাহকৃত মূলধন বিনিয়োগ করেন আর সঠিকভাবে সময়মতো আদায়ের ব্যবস্থা না করেন তাহলে মালিকপক্ষের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। মালিকপক্ষের প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শেয়ারপ্রতি আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে কোম্পানির মূল্য বৃদ্ধি করা। মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় না থাকলে তাদের উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না বলে তারা বিশ্বাস করে। অর্থনীতির পরিভাষায় ধরনের পরিস্থিতিকে মরাল হ্যাজারড বা নৈতিক বিপত্তি সমস্যা বলা হয়। ওই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য মালিকপক্ষ তাই পরিচালনা পর্ষদে তাদের নিয়ন্ত্রণের যুক্তি তুলে ধরেন। বার্গার ডি ইয়াংয়ের তত্ত্ব অনুযায়ী মালিকপক্ষ পরিচালনা পর্ষদে থেকে ব্যবস্থাপনার ওপর  নজরদারি করার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য রক্ষা এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে ভূমিকা পালন করতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ইসলাম নিশিয়ামা ২০১৯ সালে তাদের প্রায়োগিক গবেষণায় ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ হিসেবে মরাল হ্যাজারড টাইপ- বা নৈতিক বিপত্তি ধরন--এর কথা উল্লেখ করেন। বার্গার ডি ইয়াংয়ের তত্ত্ব অনুযায়ী নৈতিক বিপত্তির উত্পত্তি মূলত মূলধন সরবরাহকারী মালিকপক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের মধ্যে বিরাজিত। আর তাই মালিকপক্ষ ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা বন্ধ বা প্রশমনের চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলাম নিশিয়ামা অর্থনীতির সেট অব কন্ট্রাক্ট তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে দেখান যে নৈতিক বিপত্তি শুধু মালিকপক্ষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে নয়, বরং সংশ্লিষ্ট আরো অনেক পক্ষের বা পক্ষগুলোর মধ্যে ঘটতে পারে। সে ধরনেরই এক মরাল হ্যাজারড বা নৈতিক বিপত্তির উপস্থিতি লক্ষ করা যায় আমানতকারী ব্যবস্থাপনার ভেতরে। ইসলাম নিশিয়ামা আমানতকারী ব্যবস্থাপনার মাঝে বিরাজিত নৈতিক বিপত্তিকে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে মরাল হ্যাজারড টাইপ- বা নৈতিক বিপত্তি ধরন- হিসেবে উল্লেখ করেন। নৈতিক বিপত্তি ধরন- তত্ত্বকে নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যায়:

ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান অন্যান্য পণ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। প্রথমত, ব্যাংক হচ্ছে ডিপোজিটরি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ডিপোজিটরি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্যাংকসহ আর গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানই কেবল সর্বসাধারণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাংক সর্বসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করে। আমানতের প্রকারভেদ অনুযায়ী প্রতিটা ব্যাংকিং সংগঠনেরই আমানত মিশ্রণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। আমানত মিশ্রণে সাধারণত চলতি, সঞ্চয়ী মেয়াদি আমানত থাকলেও এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের আমানত মিশ্রণের অনুপাত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সে যাই হোক, প্রতিটি ব্যাংকেরই বিনিয়োগ তহবিলের সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণটি হলো এই আমানত মিশ্রণ।

আমানত সংরক্ষণের জন্য ব্যাংক পছন্দের ক্ষেত্রে আমানতকারীরা বিভিন্ন উপাদান বিবেচনা করেন। উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমানতের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা। আমানত সুরক্ষার ক্ষেত্রে দেশের আমানতকারীরা এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন  ব্যাংকগুলোকে অধিকতর সুরক্ষিত মনে করেন। আর তাই আমানতকারীরা আমানত সংরক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সে তুলনায় বিদেশী মালিকানাধীন এমনকি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোকে আমানত সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বিনিয়োগ তহবিলের উৎস তুলনামূলক সুরক্ষিত জেনে খুব বেশি বাছবিচার না করেই বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় আমানতকারীদের আমানতের সুরক্ষার বিষয়টি তাই উপেক্ষিতই থেকে যায়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান সমস্যাকে নৈতিক বিপত্তির ধরন- হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত গবেষণা ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশে সেসব ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ গড় অনুপাতের চেয়ে বেশি, যাদের আমানত উৎস তুলনামূলকভাবে অধিকতর নিরাপদ। পক্ষান্তরে বিদেশী ব্যক্তিমালিকানা ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহের জন্য অধিকতর পরিশ্রম করে বিধায় এসব ব্যাংক ব্যবস্থাপনা আমানতকারীদের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকে। বেশি দায়বদ্ধতা জবাবদিহিতার জায়গা থেকেই বিদেশী ব্যক্তি খাতের ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ঋণ মঞ্জুর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অধিকতর যত্নবান থাকে। সে কারণে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অনুপাতও তুলনামূলকভাবে কম। বলা যায়, নৈতিক বিপত্তি ধরন--এর উপস্থিতি এসব ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে কম বলেই তাদের খেলাপি ঋণ অনুপাতও কম।

অন্যদিকে আমানত সংগ্রহে কম কষ্ট করতে হয় বলে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষার প্রতি তুলনামূলক কম যত্নশীল থাকে। সেই সঙ্গে জবাবদিহিতার বিষয়টি সংকুুচিত বলে এসব ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ঋণ মঞ্জুর সিদ্ধান্তে খুব বেশি বাছবিচার করে না, যার সম্মিলিত পরিণাম হলো ভয়াবহ পরিমাণের খেলাপি ঋণ। সরল দাবি এই যে নৈতিক বিপত্তি ধরন--এর ভয়াবহ বিরাজতাই ব্যাংকিং খাতে পর্বতসমান খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ।

 

. শহীদুল জাহীদ: সহযোগী অধ্যাপক

ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন