রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মৃত্যু

প্রকাশ দত্ত

এই সময়ে করোনাভাইরাস বিশ্ব মহামারী পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী জনগণের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। যারই প্রেক্ষিতে সারা পৃথিবীর ন্যায় আমাদের দেশের শ্রমিকদের ওপর চলছে ছাঁটাই, লে-অফ, চাকরিচ্যুতির খড়গ। এমন সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের ঘোষণা যেন ‘চিতার আগুনে ঘি ঢেলে’ দেওয়ার মত। সোনালী আঁশ খ্যাত বাংলাদেশের পাট ও পাটশিল্পের এই অবস্থার জন্য কে বা কারা দায়ী, তা নিয়ে হচ্ছে বিস্তর আলোচনা। আর আলোচনায় উঠে আসছে পাটশিল্পের আদ্যপ্রান্ত। আজ তাই পাটশিল্প গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট যদি না জানি তাহলে বোঝা যাবে না কাদের স্বার্থ রক্ষায় গড়ে উঠেছিল এই পাটকল। 

উপনিবেশিক অবিভক্ত ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসন-শোষনের মৃগয়া ক্ষেত্র। আর ব্রিটিশের আনুকূল্যে এবং প্রয়োজনে দেশের সামন্ত-মুৎসুদ্দি শ্রেণি গড়ে তুলেছিল পাটকল। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৮৮৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড শ্যাম সুন্দর সেন নামের একজন বাঙালি অংশীদারকে নিয়ে কলকাতার হুগলী নদীর তীরবর্তী বিশড়া নামক স্থানে প্রথম পাটকল স্থাপন করে। পাটশিল্পের কাঁচামাল পাট, সস্তা শ্রম বিশ্ব বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদার ওপর নির্ভর করেই যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৫ সালে পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১১টিতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাটশিল্পের কারখানাগুলো সব পড়ে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু ৮০ শতাংশ পাট উৎপাদন হত পূর্ববাংলায়। অথচ পূর্ববাংলায় কোন পাটকল ছিল না। ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জে বাওয়ানী জুট মিল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে পাটকলের যাত্রা শুরু হয়। সেই একই বছর ১২ ডিসেম্বর ২৯৭ একর জায়গার ওপর ৩ হাজার ৩০০ তাঁত নিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল স্থাপন করে আদমজীরা তিন ভাই। প্রাথমিকভাবে শেয়ার বিক্রি মাধ্যমে ৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই পাটকল বার্ষিক ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হয়। বিশ্ব বাজারে পাটের তেজিভাব থাকার কারণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এবং একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণির দোসর পাকিস্তানের আমলা দালাল পুঁজিপতি গোষ্ঠী পাটশিল্প স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। একের পর এক প্রতিষ্ঠা হতে থাকে পাটকল। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭৫টি। এর মধ্যে ৬৭টি পাটকল ছিল পূর্ববঙ্গে। 

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পাকিস্তানিদের মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, শিল্প কারখানাসহ সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ বণ্টন ও লুটপাট করার মহোৎসব শুরু হয়। সেই মহোৎসবের একটি ক্ষেত্র হয় পাটকলগুলো। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশে পিও ২৭ (বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজেজ ন্যাশনালাইজেশন অর্ডার ১৯৭২) অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসির মোট ৬৭টি পাটকলের তদারকি, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) গঠিত হয়। গঠনের পর থেকেই বিজেএমসির কর্মকর্তা, আমলা, মন্ত্রীসহ পাটশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি স্বার্থান্বেষী মহল লুটপাট করতে থাকে। তারপরও ৭১ পরবর্তী দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল বেশি। কিন্তু যাদের অবদানে পাট সোনালী আঁশ হয়েছিল সেই শ্রমিক-কৃষকের ঘরে সে সুদিনেও আশার আলো জ্বলেনি।

১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিব হত্যার মধ্যদিয়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের ফলে এদেশে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সাথে ৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময়ে মার্কিনের পরিকল্পনায় ক্ষমতাসীন সরকার শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিক রাজনীতিকে ধ্বংস করতেও পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন ধ্বংস করে সরকার এবং বিজেএমসি মিলে তাদের বশংবদ নেতৃত্ব সামনে আনে শ্রমিকদের সিবিএ’তে। এ সকল ক্ষেত্র প্রস্তুত করার প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হতে থাকে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া। তারই ফলে জেনারেল এরশাদের আমলে ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয় এবং সরকার পুঁজি প্রত্যাহার করে নেয় আরও ৮টি পাটকল থেকে। একইসাথে বিশ্বসংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে একই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আনতে গ্রহণ করে স্যাপ ও ইস্যাপ কর্মসূচি। ৮০’র দশকে এই দু’টি কর্মসূচি সামনে আনা হয়। তারই আলোকে অগ্রসর হতে থাকে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া। এটা শুধু পাটকলে নয়, ব্যাংক, বীমা, শিল্প কলকারখানাসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কার্যকরি করা হয়। এই নীতির আলোকে বেসরকারি পাটকলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের পতনের মধ্যদিয়ে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে একক আধিপত্যকারী শক্তি হিসেবে ১৯৯০-৯১ সালে মার্কিনের আবির্ভাব ঘটে।

৯০ পরবর্তী পশ্চিমা দেশগুলো একচেটিয়া লগ্নিপুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা ও বেপরোয়া লুটপাটের স্বার্থে সামনে আনে বিশ্বায়নের স্লোগান। তাদেরই সংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কর্মসূচি সামনে আনা হয়- (১) শিল্প ক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যক্তিগত মালিকানার নীতি (২) কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও ব্যক্তিগত মালিকানায় বিপণন নীতি (৩) বাণিজ্য ক্ষেত্রে অবাধ আমদানি নীতি ও (৪) অবাধ মুদ্রানীতি। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে ঘোষণা করা হয় ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা’। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে সংস্কার কর্মসূচির আওতায় আরও ১১টি পাটকল বন্ধ করা হয়। অন্যদিকে শ্রমিক অঙ্গনে সিবিএ দখল, ইউনিয়ন দখল, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। শ্রমিকনেতা মানে গাড়ি, বাড়ি, অঢেল সম্পত্তির মালিক- ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এইপ্রচারণা সর্বব্যাপী রূপ দেওয়া হয়। যার ফলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন থেকে মুখে ফিরিয়ে নেয়। একইসাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরে জনগণের মনে বিরাষ্ট্রীয়করণের সপক্ষে মত তৈরি করা হয়। শ্রমিক অঙ্গনে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ-স্কপকে অব্যাহত রেখে সংগ্রামের পরিবর্তে সমঝোতা এবং আপসকামিতার ধারাকে জোরদার করা হয়। ২০০২ সালে এশিয়ার বৃহত্তর পাটকল খ্যাত আদমজি পাটকল বন্ধ করা হয়। এই সকল গণবিরোধী কাজ করার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিশ্বব্যাংকের কাছে অনেক বেশি আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ১৯৮৪ পরবর্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানধীন প্রতিষ্ঠান বিক্রির নামে যে ঢালাও লুটপাট শুরু হয় সে ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ‘যে টাকা দিয়ে মিল কিনেছিল মিলের লোহালঙ্কড় বিক্রি করে ওই সমস্ত মিলের মালিকরা দ্বিগুণ লাভ করে’। ৭১ পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালরা যে লুটপাট শুরু করেছিল তা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলায় অল্প সময়ে অতি দ্রুত কোটিপতি বনে যাওয়া দেশের তালিকায় এদেশের নাম শীর্ষে।

আমাদের অর্থনীতিসহ জীবনের সকল প্রয়োজনের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া লগ্নিপুঁজি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও আচড় লাগেনি এই শোষণ প্রক্রিয়ার গায়ে। যে কারণে পাকিস্তান আমলে শ্রমিকরা যে সকল দাবিতে রাস্তায় থাকতো বাংলাদেশ আমলেও সেই একই দাবিতে আজও রাস্তায় আছে এবং জীবন দিতে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে কোন কোন অঞ্চল এবং দেশকে তারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হয়ে থাকে। লগ্নিপুঁজি নির্ভর শিল্প স্থাপন ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে তারা নয়া উপনিবেশিক ভারতকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের পাটশিল্প ধ্বংস করে ভারতে পাটশিল্প গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা ও স্বার্থ। রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ হওয়ার পর আলোচনায় আসলো ৫০ হাজার শ্রমিকের জীবনসহ প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার। প্রশ্ন তোলা হল কীভাবে পাটকল লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে? এর পেছনের কারণ হচ্ছে পশ্চিমাদের পরিকল্পনা, রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা, বিজেএমসির দুর্নীতি, ভ্রান্ত ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি, সরকারের ভ্রান্ত নীতি। হাজারো প্রশ্ন সামনে আসলেও সামনে আসলো না প্রকৃত দায়ী যে সাম্রাজ্যবাদ ও তার সংস্থা বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ’র নীতি। যা কার্যকরী করে চলেছে এদেশের ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারই। 

তাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মৃত্যু আকস্মিক কোন বিষয় নয়, এটা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাষ্ট্রীয় নীতিরই ফলস্বরূপ। আজ তাই দেশ, জাতি ও জনগণের সামনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের জন্য দায়ী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ এই বিষয়টি এবং করণীয় কী তা তুলে ধরতে হবে শ্রমিক শ্রেণির পক্ষের শক্তিকে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার দম্ভ সম্পূর্ণ বেআব্রু হয়ে পড়ার মধ্যদিয়ে যে নতুন বাস্তবতা সামনে আসছে তাকে যুক্তির আলোকে তুলে ধরতে হবে শ্রমিকশ্রেণিকে। জাতীয় ক্ষেত্রে বিভক্তি সৃষ্টিকারী উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই পথের পথ প্রদর্শকের দ্বায়িত্ব নিতে হবে শ্রমিকশ্রেণিকে।

লেখক : যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, কেন্দ্রীয় কমিটি
ই-মেইল : [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন