কভিড-১৯ কি নতুন চিন্তা তৈরি করবে?

দিলীপ এম মেনন

ইতালিয়ান সাহিত্যিক আন্তোনিও স্কুরাতি সম্প্রতিলিখেছেন, কীভাবে আমি আমার মেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারব যে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি তখন আমরা একটি যুগের শেষ দেখছি। সবাই জানি যে আমরা একটি নজিরবিহীন সময়কাল পার করছি। রাষ্ট্র যেভাবে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ঘরের ভেতর আটকে রাখতে পেরেছে, সেটা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রসারিত করেছে। গৃহবন্দি করে রাখা এর আগে রাজনৈতিক অসন্তোষের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হলেও এখন তা স্বাভাবিক জীবনযাপনে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে আমরা এমন একটি নতুন যুগের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে ধরনের হস্তক্ষেপ নজরদারিকে আমরা নিশ্চিত ধরে নিয়েছি। অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা স্বেচ্ছায় নজরদারিতে নিজেদের সমর্পিত করেছি। এটা আমরা করেছি বৃহত্তর স্বার্থে। এই সমর্পণ একেবারেই স্বতন্ত্র পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

আগামবেনের মতো দার্শনিক যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে রাজনৈতিক সংকট মহামারী সংকট রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জরুরি অবস্থার জন্য আদর্শ হয়ে ওঠে।

রাজনীতির নতুনতর রূপ

তবুও সমাজ রাজনীতির নতুনতর ফর্মের উত্থান ঘটছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বে) পুলিশ দ্বারা বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হত্যা অব্যাহত আছে, যা কিনা মানুষকে রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছে। যদি ভাইরাস আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে নীরব ভ্রমণের মাধ্যমে আমাদের খুন করে ফেলে, তবে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া আমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে না।

অবস্থায় পুঁজিবাদের শেষও দেখে ফেলছেন কেউ কেউ, যেখানে অনেকে মার্কিন আধিপত্য বিশ্বায়ন পর্বের সামনে দাঁড়িও টেনে দিয়েছেন। সমান্তরালে সামনে আসছে চীনের উত্থানের বিষয়টিও।

যাই হোক, আমাদের এখানে দেখতে হবে জাতি, সমাজ ব্যক্তির ওপর বৈশ্বিক লকডাউনের প্রভাবও। সব লকডাউন একই রকম হলেও প্রত্যেকে এর অভিজ্ঞতা পেয়েছে ভিন্ন নিজস্ব উপায়ে।

মৌলিক প্রশ্নগুলো মানুষের লকডাউনের অভিজ্ঞতাকে নির্ধারণ করে: মানুষের চাকরি আছে কিনা, নিজস্ব ঘর আছে কিনা, মানুষের পাতে খাবার আছে কিনা এবং জনস্বাস্থ্যে প্রবেশাধিকার আছে কিনা? আমরা এখন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে ফিরে এসেছি: খাবার, পোশাক বাসস্থান। এসব ঘটনার সংমিশ্রণে যা তাত্পর্যপূর্ণ তা হলো বৈশ্বিকভাবে মানবিক পরিস্থিতির একটি সাধারণ অনুভূতি।

রাজনৈতিক পরিসরে সংসদীয় বিতর্কের চমকপ্রদ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সরকারগুলোকে রুক্ষ পথে হাঁঁটতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক বরাদ্দ এবং নাগরিক সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরিবর্তে প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে সামনে এসেছে।

তথ্যের বিভাজন

বর্তমান এই সংকট কুসংস্কারের ঝোঁককে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সংকটের কারণে তথ্যের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, জনমত স্থান পেয়েছে সত্যের ওপর। গুজবই নির্ধারণ করে জনপরিসরের পরিস্থিতি।

যুক্তরাষ্ট্রে গণপরিবহনে চীনা নাগরিকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এর মাঝে ভারতে তাবলিগ--জামাতের একটি সম্মলেন অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে যারা ঘরে ফিরে যায় তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং কভিড-১৯- আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যায়। দিল্লি থেকে শুরু করে এমনকি কেউ কেউ এটি বহন করে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #করোনাজিহাদ নামে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়, যেখানে মুসলমানদের দায়িত্বহীন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

জাতিগত ধর্মীয় বিভাজনগুলো দূূরত্ব বাড়িয়েছে দরিদ্র অসহায়দের মাঝেও: গৃহকর্মী, ডেলিভারির কাজে নিয়োজিত কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, জরুরি সেবায় নিয়োজিত লোকজন। শারীরিকভাবে কাছাকাছি আসার ভয় সামাজিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে।

যেমন নিউ নরমাল শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করা হয় ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর এবং বাস্তবতা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিকস আর তার পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। যা এখন বর্তমান পরিস্থিতিকেও ব্যাখ্যা করছে।

মহামারীকালে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ব্যক্তি সমষ্টির কাছ থেকে যে সামাজিক প্রত্যাশা তাকে স্থানচ্যুত করেছে। এটি মৃত্যু-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার পেছনে খরচের বিষয়টিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

রাষ্ট্র, সমাজ সামাজিকতা

মহামারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হচ্ছে এটি সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতির ওপর থেকে অনুমানের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে।

মহামারীকালে রাষ্ট্রগুলোকে চিকিৎসা সামাজিক সংকট মোকাবেলায় বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে ব্যাপক মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে, কেননা তারা রোগ মোকাবেলায় সামনের সারিতে থেকে কাজ করেছে।

এছাড়া বিভিন্ন দেশ রাজ্যের মহামারী মোকাবেলায় আলাদা আলাদা ব্যবস্থা সম্ভবত জনগণের সঙ্গে সরকারের যে বোঝাপড়া তাকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স লকডাউনে গেলেও সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য হার্ড ইমিউনিটির পথে হেঁটেছে। যেখানে সুইডেনের মতো দেশের হার্ড ইমিউনিটি বেছে নেয়ার অর্থ হচ্ছে তারা তাদের অঞ্চলে অন্যদের তুলনায় বেশি মৃত্যু দেখবে (ডেনমার্কের চেয়ে দুই গুণ ফিনল্যান্ডের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি) এই ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র নাগরিকদের মরতে দেয়ার রাজনীতির পথ অবলম্বন করেছে।

বিশ্বব্যাপী দেশগুলোতে জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, যেমন চীনের স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় বুলগেরিয়া কিংবা ব্রাজিলের তুলনায় ৫০ শতাংশ। যা কিনা সত্যিকার অর্থেই আতঙ্কের। চীনের উহানে যেখানে কিনা ভাইরাসের উত্পত্তি, সেখানে বেশির ভাগ মানুষই অভিবাসী শ্রমিক, যাদের মাত্র ২০ শতাংশের চিকিৎসা বীমা রয়েছে। এছাড়া চীনে চিকিৎসা সুবিধার স্বল্পতাসহ আরো নানা সমস্যা রয়েছে।

গণতন্ত্রের পরবর্তী অনুমান সম্পর্কে কী বলা যায়: স্বতন্ত্র নাগরিক? মাস্ক পরার বিষয়টি মানুষের স্বাতন্ত্র্য হারানোর প্রশ্নটিকে সামনে এনেছে। যা কিনা একটি চেহারাবিহীন সমাজের ধারণা দিয়েছে। যেটি পর্দার বিরুদ্ধে পশ্চিমা কুসংস্কারের যে ধারণা তাকে প্রকাশ করেছে।

তবে কভিড-১৯ আমাদের অন্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়েছে। সেটি উহান থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন যেখানেই হোক না কেন, আমাদের দিয়েছে অভিন্নতার ধারণা। ভাইরাসটি দেশীয় সীমান্তকে নিয়ে পরিহাস করেছে এবং মানুষের শরীরের মধ্য দিয়েই ভ্রমণ করেছে। অবশ্য তার পরও দেশগুলো ভাইরাসকে আটকানোর জন্য সীমান্তে বিধিনিষেধ কড়াকড়ি করেছে এবং মানুষের শারীরিক চলাফেরাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। যাই হোক, আমাদের সম্মিলিত শ্বাসপ্রশ্বাসও আক্রান্ত হচ্ছে, তবুও একটি নতুন রাজনীতি নতুন সামাজিকতার উত্থান এখান থেকে হতে পারে।

স্ক্রলডটইন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন