সময়ের ভাবনা

করোনাকালের ‘রোমান হলিডে’

নীলোফার রাজা চৌধুরী

(গতকালের পর)

বিকাল ৫টায় আমার স্বামী ফেরার সঙ্গে সঙ্গে টিভি খুলে খবরটা আবার দেখে বেরিয়ে পড়লাম। চেষ্টা করলাম ভুলে যেতে। গন্তব্য গতকালের রেস্তোরাঁ। মনে হলো দেলোয়ার সাহেবরা আমাদের জন্য আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন। তাদের ইতালিয়ান মালিক এখানে নেই, তাই তারা একটু বাড়তি সময় দিয়েছেন আমাদের। আমরা বাংলাদেশী, তিনদিন থেকে ইতালিয়ান খাবার খাচ্ছি। তাই তারা বাসা থেকে চাল, ডাল, দেশী মসলা, কাঁচামরিচ ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। আমাদের অনুমতি পেলেই রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু আমরা যখন এগুলোর পরিবর্তে আবারো ইতালিয়ান খাবারের অর্ডার দিলাম, মনে হলো বেশ অবাকই হয়েছেন। তাদের শেফ সাহেবও এসে দেখা করলেন।

নতুন কোনো দেশে গেলে আমাদের আরো একটা অভ্যাস হলো, সে দেশে যদি কোনো বাঙালি এলাকা থাকে, তবে সেটা ঘুরে দেখা। ওখানকার বাঙালিদের জীবনযাত্রা কেমন, কেমন পরিবেশে ওরা থাকে ইত্যাদি দেখার কৌতূহল আমার। দেলোয়ার সাহেবদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যাপারে। শুনলাম ওখানকার জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের আসার ব্যাপারে জেনে গেছেন এবং তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন আমাদের জন্য। তারা বাঙালি এলাকাতেই থাকেন। রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। ১৫-২০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম। রাস্তার পাশেই দু-তিনজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। প্রেসিডেন্ট সাহেবের নিজেরই রেস্তোরাঁ এটা। ভেতরে ঢুকলাম। স্থানীয় বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। আমরা তো রাতের খাবার খেয়েই এসেছি। খুব অবাক হলেন আমরা এত তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই শুনে। বুঝতে পারছিলাম তাদের সঙ্গে একটু দেশীয় খাবার না খেলে  খারাপই লাগবে। তাই সবার সঙ্গে বসে আমরা হালিম আর নান রুটি খেলাম। গল্পের মাধ্যমে বুঝলাম কভিড-১৯ সম্পর্কে তারা মোটেই সচেতন নন। রোমবাসীদের দেখে ব্যাপারে মোটেই সচেতন মনে হয়নি। সারা দিনে কভিড নিয়ে আমার ভেতরে যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা অনেকখানি যেন কাটিয়ে উঠলাম। 

পরদিন আমাদের প্রোগ্রাম ছিল রোম শহরেই ঘুরে বেড়ানো। তার পরের দিন সকালে যাব ভ্যাটিকান এবং সন্ধ্যায় ট্রেনে ভেনিস। 

ঘুমানোর আগে টিভি খুলে বসলাম খবরটা দেখব বলে। অবাক হলাম এই অল্পদিনে উহানে কীভাবে করোনা বিস্তার লাভ করেছে। শুনলাম রোমে আরো দুজন করোনা রোগী পাওয়া গেছে এবং মারাও গেছে। ভয়ে বুকটা হিম হয়ে গেল। ঘুমাতে পারলাম না কেউই। রাত ৩টার দিকে আবার টিভি খুলে শুনতে পেলাম ইতালির উত্তরে অর্থাৎ অনেকটা ভেনিসের কাছের দুটো শহরে করোনা ধরা পড়েছে এবং ওই দুটো শহর লকডাউন করে দিয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ভেনিসের প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে দেশে ফিরে যাব। শুরু হলো টেলিফোন, মেসেজ, -মেইলের পালা। আগের দুটো টিকিট বদলে নতুন দুটো টিকিট জোগাড় করা একই ফ্লাইটে এবং দু-একদিনের মধ্যে কাজটা সহজ নয়। আমাদের টিকিট ছিল ভেনিস থেকে দুবাই। সেই টিকিট বদলে এখন করতে হচ্ছে রোম থেকে দুবাই। ঝামেলাটা একটু বাড়তি। দেশে-বিদেশে অনেকেই আমাদের জন্য উদ্বিগ্ন। 

টিকিটের খবর না পাওয়া পর্যন্ত আমরা হোটেল থেকে বের হতে পারছি না। প্রতিটি মিনিট অপেক্ষা করছি অধীর আগ্রহে। অবশেষে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে খবর পাওয়া গেল। একই ফ্লাইটেই দুটো টিকিট। এফএও এবং দেশের যে কয়েকজন ব্যাপারে আমাদের জন্য কাজ করেছেন, অনেক কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম তাদের কাছে। 

বিকালে অনেকটা হালকা মেজাজে আমরা হেঁটে বেড়ালাম। একেকদিন একেক ধরনের রেস্তোরাঁয় ভিন্ন স্বাদের খাবারের মজাই আলাদা। হোটেল থেকে একটু দূরে দু-তিনটা রেস্তোরাঁ দেখা গেল। তার একটাতে ঢুকে পড়লাম। রেস্তোরাঁর ভেতরে এত লোকের সমাগম দেখে কে বলবে যে এখানে লোকজনের মধ্যে করোনার কোনো চিন্তা আছে! বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। লোকজন জায়গার অভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রেস্তোরাঁর ভেতরের ডেকোরেশন ক্ষণিকের জন্য মন থেকে সারা দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টা দেড়েকের বেশি বসতে পারলাম না। বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে। হোটেল থেকে দেয়া বিশাল ছাতাটা খুব কাজে লাগল।

হোটেলের রেস্তোরাঁ সকাল ৭টায় খোলা হয়। কিন্তু আমাদের জন্য সেদিন ৬টায়ই খোলা রাখল। নাশতা খেয়েই বাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টি নেই, তবে বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা। কোট গায়ে দিয়ে মাথাটা শাল দিয়ে পেঁচিয়ে নিলাম। মিনিট ১০-১৫ যেতেই বাসস্ট্যান্ড চোখে পড়ল। বাসের নাম্বার দেখে উঠে পড়লাম। আজকে নিজেকে এত ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। ভ্যাটিকানে আসতে পারবস্বপ্নটা কবে থেকে দেখা শুরু করেছিলাম মনে করতে পারছি না। বাসে উঠে বাসচালককে বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমরা ভ্যাটিকানের কোথায় নামতে চাই। কী বুঝলেন জানি না। রাস্তায় কয়েকটা জায়গায় বাস থামল। যাত্রীরা ওঠানামা করল। ঘণ্টাখানেক  পর বুঝলাম আমরা শেষ স্টপে এসে যাচ্ছি। কিন্তু বাসের দুই ধারের জায়গাগুলো আস্তে আস্তে খুব পরিচিত মনে হতে লাগল। অবশেষে বাস থেকে নেমে দেখি এটা আমাদের হোটেলরই আশেপাশের জায়গা। একটা ঘণ্টা আমরা বাস জার্নি করে ফিরে এসেছি। মনে মনে খুব হাসলাম। এখানেই একজন ভদ্রলোককে পেয়ে গেলাম, যিনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। বুঝতে পারলাম আমাদের ভুলটা কোথায়! এবার রাস্তার অন্য পাশে গিয়ে একই নাম্বারের অন্য বাসে আমরা উঠলাম। এবার ঠিকই শেষ স্টপে গিয়ে বাস থামল, আমরা ভ্যাটিকানে এসে নামলাম। 

ভ্যাটিকান নগরী ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মূল পুণ্যভূমি। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩০ কোটি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী আছে। তাদের ধর্মীয় নেতা পোপ এখানেই বসবাস করেন। ভ্যাটিকানকে বলা হয় দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ। যদিও ভ্যাটিকান ভৌগোলিকভাবে ইতালির মধ্যেই অবস্থিত, কিন্তু এটা একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত।  বাংলাদেশেও ভ্যাটিকানের একজন রাষ্ট্রদূত আছেন। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এটা গঠিত হয় ১৯২৯ সালে। সম্ভবত ভ্যাটিকান পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ, যার আয়তন ১২১ একর এবং জনসংখ্যা ৮২৫। ভ্যাটিকান যদিও আলাদা একটা দেশ, কিন্তু বোঝার কোনো উপায় নেই। সে রকম কোনো বর্ডার পোস্ট বা সীমান্ত ঘাঁটি নেই। সে দেশে ঢোকার জন্য পাসপোর্ট, ভিসারও কোনো প্রয়োজন নেই। নেই তাদের কোনো সেনাবাহিনী; পোপই তাদের রাষ্ট্রপ্রধান, সর্বেসর্বা।

বাস থেকে নামতেই দু-চারজন ট্যুরিস্ট এজেন্ট কাছে এগিয়ে এল। তাদের একজনের সঙ্গে আমরা কথাবার্তা বললাম। সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলে সে। তাদের অফিসে নিয়ে গেল। টিকিট করে আমরা সাত-আটজনের একটা দল হয়ে গেলাম। গাইড ডেবরা আমাদের নিয়ে চলল ভ্যাটিকান দেখাতে। এয়ারফোন কানে দিয়ে সবাই চললাম তার পেছনে। ডেবরার ইংরেজি বলার ঢঙটাই আলাদা। খুব সুন্দরী, স্মার্ট মহিলা। মাঝে মাঝেই জোক বলে হাসাচ্ছিল। তার কাছে শুনলাম সাধারণত এখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ট্যুরিস্ট থাকে। কিন্তু আজকে মাত্র আড়াই হাজার। সে অবাক হয়ে বলছিল যে জানে না লোকে মিছামিছি ভয় পাচ্ছে কেন! এটা ঠিক নয়। যদিও তখন ইতালির উত্তরাঞ্চল করোনার আক্রমণে মোটামুটি জর্জরিত। 

আরো অনেক দলের পাশাপাশি আমরাও হেঁটে চলেছি। এখানে অনেকগুলো দলই ছিল, কিন্তু জাপান চীন দেশীয়দের ছাড়া আর কারোরই মুখে মাস্ক চোখে পড়েনি।

সেন্ট পিটার ভ্যাসেলিকা, সিসটিন চ্যাপেল ভ্যাটিকান জাদুঘরগুলো এখানকার দর্শনীয় স্থান। ভ্যাটিকানের ইতিহাস এবং বর্তমান দুটোই জুড়ে রয়েছে বিখ্যাত সব পেইন্টারস, ভাস্কর এবং তাদের কীর্তি। বিখ্যাত পেইন্টার ভাস্করদের মধ্যে আছেন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, বারনিনি, ব্রামানটি, জিয়ামো, বটিক্যালি, রাফায়েল প্রমুখ। পৃথিবীর সব চিত্রকলার এক বিশাল সমাহার হলো ভ্যাটিকান। সিসটিন চ্যাপেলে গিয়ে তো আমি মুগ্ধ। যারা চিত্রকলা পছন্দ করেন, সেইসব গুণগ্রাহীদের জন্য সিস?টিন চ্যাপেল হচ্ছে এক বিশাল ব্যাপার, স্বপ্নের মতো। চারদিকে আর্টের এত ছড়াছড়ি যে কোনটা দেখব এবং কোনটার ছবি তুলব বুঝে ওঠার আগেই কানে ডেবরার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠে সামনে এগোনোর জন্য। আমরা হাঁটছি, দুই ধারের চিত্রকলাগুলো দেখে দেখে। মাঝে মাঝেই ডেবরাকে থামিয়ে দাঁড়িয়েছি, যাতে মাথার উপরের চিত্রকলাগুলো দেখতে পারি। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। শত শত বছর ধরে পৃথিবীর অনেক নামিদামি, গুণী শিল্পীদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল এই চিত্রকলাগুলো। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এগুলো দেখতে, এগুলোর ওপর গবেষণা করতে। চিত্রকলাগুলো নিয়ে মানুষের মোহ এত বেশি যে মানুষ এগুলো নিয়ে বই লিখেছে, ছায়াছবি তৈরি করেছে। ডেন ব্রাউনেরদা ভিঞ্চি কোড’, ‘এঞ্জেলস অ্যান্ড ডিমনসবইগুলো হচ্ছে তার বড় উদাহরণ। এগুলো দিয়েই পরে বড় বড় সিনেমা তৈরি হয়েছিল। ভ্যাটিকানের ইতিহাস অতিসমৃদ্ধ এবং মোহনীয়। এখানে এক বিশাল লাইব্রেরি রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ প্রায় অসাধ্য। শোনা কথা, লাইব্রেরিতে যিশু খ্রিস্টের সময়কার বিভিন্ন ধরনের দলিলপত্র, ধর্মগ্রন্থ ইত্যাদির এক বিশাল সমাহার নাকি গচ্ছিত আছে। 

দেখে দেখে কখন যে আবার রোমে প্রবেশ করে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়ল বেশ অনেক রেস্তোরাঁ। মনে হলো কোনোটাতেই বসার জায়গা নেই। একটু ফাঁকা পেয়ে একটাতে ঢুকে পড়লাম। এখানেও একজন বাঙালি ওয়েটারের দেখা পেলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কভিডের ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন মনে  হচ্ছিল তাকে। তার চিন্তা হলো, কভিডের জন্য তার কাজ চলে গেলে দেশে তার পরিবারের জন্য অনেক অসুবিধা হবে। এত লোকের খরচের টাকা কীভাবে পাঠাবেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই তাকে খাবার অর্ডার দিলাম। ঐতিহ্যবাহী ডেসার্টটিরামিসু জন্য বললাম। দরজার বাইরে লোকজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে জায়গার অভাবে। আমাদেরও সময়ের খুব অভাব। তাই দেরি না করে বাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। 

এবার নির্ধারিত স্টপে না নেমে আমরা দু-একটা পরের স্টপে নামলাম। আগেই বলেছি আমরা সেদিনই সন্ধ্যার ফ্লাইটে দেশের জন্য টিকিট পেয়ে গেছি। 

রোমের সবচেয়ে পরিচিত ঐতিহাসিক নিদর্শন হলোকলোসিয়াম  আমরা আগের দিনে হেঁটে হেঁটে কলোসিয়ামের বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রোম শহরের অনেক ঐতিহাসিক স্থান দেখেছি। কিন্তু সময়ের অভাবে কলোসিয়ামের ভেতরে আর ঢোকা হয়নি। আজকে তাই এই সুযোগটা নিতে চাইলাম। অনলাইনে কলোসিয়ামের টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল বলে আমাদের সময় অনেক বেঁচে গিয়েছিল। তবু ভেতরে ঢোকার জন্য মানুষের লম্বা লাইন দেখে ঘড়ির দিকে তাকাতে হচ্ছিল বারবার। ৫টার মধ্যে হোটেলে ফিরতে না পারলে যথাসময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছানো হয়তো কঠিন হয়ে যাবে। গেটম্যানদের বুঝিয়ে বলায় ওরা আমাদের লিফট দিয়ে উপরে ওঠার সুযোগ করে দিল। 

কলোসিয়ামটি তৈরি হয়েছিল ক্রিস্টপূর্ব ৮০ সালে। এটা অনেকটা উন্মুক্ত মঞ্চ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় এমফিথিয়েটার।  প্রায় ৮০ হাজার লোক একসঙ্গে বসার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই কলোসিয়াম থিয়েটার। এখন অনেকটা ধ্বংসাবশেষ। এটার মাঝখানটা জুড়ে রয়েছে বিশাল খোলা উন্মুক্ত জায়গা। আমরা অনেকেই গ্লাডিয়েটরস সিনেমা দেখেছি। গ্লাডিয়েটরস হলো স্বাস্থ্যবান শক্তিধর যোদ্ধা, যাদের কাজই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতিদের নানাভাবে মনোরঞ্জন করা। এই উন্মুক্ত স্থানেই তারা একে অন্যের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হতো।  অনেক সময় রোমান সাম্রাজের বিদ্রোহীদের এখানে নিয়ে এসে শাস্তি দেয়া হতো। বিভিন্ন সময় এসব বিদ্রোহীকে বাঘ, ভালুকের সামনে ছুড়ে দেয়া হতো এবং এসব কটু-বীভৎস দৃশ্য রোমান অধিপতিরা উপভোগ করতেন। 

কলোসিয়াম থেকে বেরিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে ফিরলাম। বিকাল ৫টা তখন বেজে গেছে। নিচেই দেখতে পেলাম এফএও থেকে আসা গাড়ি আমাদের অপেক্ষায় আছে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দরের উদ্দেশে আমরা হোটেল ছাড়লাম। খারাপ লাগছিল গাড়িতে বসার পর। ভেনিসের জন্য হোটেল বুকিং দেয়া আছে কয়েক দিনের জন্য, আসা-যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কাটা। সবই ছেড়ে যাচ্ছি কভিডের জন্য। হোটেল থেকে বেরোনোর আগে রিসেপশনিস্টের কাছ  থেকে জানতে পারলাম গত রাত থেকে আমরাই ছিলাম ওদের একমাত্র অতিথি। ভাইরাসের কারণেই। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এই হোটেলে কর্তব্যরত যারা আছেন, তাদেরসহ আপামর রোমবাসী কীভাবে কভিডের ব্যাপারে এত নির্লিপ্ত এবং উদাসীন ছিল তখন পর্যন্ত। তাদের দেশেই উত্তরাঞ্চলে তখন করোনা ভীষণভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। এর পরও রোমবাসীর এই নির্লিপ্তটা অবাক করার মতোই। জানি না, এটা ইতালিয়ানদের কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিনা। ইতালিতে কভিডের ভয়াবহ পরিণতির কারণ কি তাদের এই নির্লিপ্তটা

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দরে নেমে চেক-ইনের পর লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। এমিরেটসের বিশাল সুপরিসর লাউঞ্জ। অতিথি শুধু আমরা দুজন। সারি সারি সুস্বাদু খাবার সাজানো। যেহেতু আমরাই শুধু অতিথি, মনে হলো ওখানে আমরা ভিআইপিরও ভিআইপি হয়ে গেছি। একটু পরপর এসে জিজ্ঞেস করছে নতুন আর কিছু খাব কিনা। প্রয়োজনে তৈরিও করে দিচ্ছে। আমাদের ছবিও তুলে দিল। প্লেনে ওঠার জন্য বোর্ডিং গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানে কিছু মাস্ক পরা লোকজন চোখে পড়ল। প্লেনে তিন সিটের একটা রো-তে আমরা বসে আছি। মিনিট পাঁচেক পরই একটা মেয়ে এসে বসল আমাদের পাশে। মাস্ক পরা। মনে হলো পূর্ব এশীয় কোনো দেশের হবে। সে বসেই খুব ব্যস্ত হয়ে গেল।  কোলের ওপর ব্যাগটা রেখে একটার পর একটা জিনিস বের করছে।  হঠাৎ দেখি প্লাস্টিকের একটা পিপিই বের করে পরে ফেলল। আঁতকে উঠলাম। টিভিতে দেখা ভয়টা কি এখন আমাদের পাশেই! বিমানবালার কাছে জানতে চাইলাম পেছনে কোনো সিট খালি আছে কিনা। সেও মনে হলো খুব ভয় পেয়েছে। তাড়াতাড়ি করে আমাদের পেছনের দিকের সিট দিল। যাত্রী অনেক কম থাকায় অসুবিধা হয়নি। প্লেন ছাড়তে ঘণ্টাখানেক দেরি হলো। পরপর বিমানকর্মীর চার-পাঁচটা দল এসে ওর সঙ্গে কথা বলল। মেয়েটার আশেপাশের যাত্রীরাও মনে হলো ভয় পেয়েছে। অনেকেই সিট বদলাতে চাইল। অন্য যাত্রীদের মধ্যে মাস্ক পরা খুব কমই ছিল।

দুবাই বিমানবন্দরে মাস্ক পরা লোকের সংখ্যা দেখে মনে হলো পৃথিবী এই অল্প দিনে অনেক বদলে গেছে। লাউঞ্জে চলে গেলাম তাড়াতাড়ি।  সন্তানদের সঙ্গে ফোনে কথা হলো। ওরা আমাদের নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করছিল। জেনেছিলাম দেশে এখন সবাই মাস্ক পরছে এবং বিমানবন্দরে জ্বর মাপার জন্য স্ক্যানার লাগানো হয়েছে। প্লেনে উঠেও দেখতে পেলাম কিছুসংখ্যক লোক সারাক্ষণ মাস্ক পরেই ছিল। প্লেনে একটা স্বাস্থ্য জরিপ কার্ড পূরণ করতে হলো। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমরা জ্বর মাপার স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে এলাম। কিন্তু আমাদের প্রায় ঠেলেই চার-পাঁচজন যাত্রী স্ক্যানার ক্রস করে চলে গেল। হাসলাম। ওই স্ক্যানারে তখন কার শরীরের তাপমাত্রা দেখাবেআমার না অন্য কারো! হাতের পূরণ করা কার্ডটা এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর হাতে দিলাম। তিনি কার্ডটা হাতে নিলেন, কিন্তু এটার দিকে তাকালেনও না আমরা ঠিকমতো পূরণ করেছি কিনা। পুরো জিনিসটাই আমাদের কাছে দায়সারা গোছের বলেই মনে হলো। 

আমরা সন্তানদের বলে রেখেছিলাম ওরা যেন দুই সপ্তাহ আমাদের বাসায় না আসে, কারণ ওই সময়টা আমরা সেলফ? কোয়ারেন্টিনে থাকতে চাই। সন্ধ্যার একটু পরই বিমানবন্দর থেকে বাসায় এসে পৌঁছলাম। এসেই দেখি আমার মেয়ে ইমিতা আগের রাতেই এসে গেছে। এত বেশি চিন্তা করছিল যে আমাদের জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। বারবার অবাক লাগছে এই এক সপ্তাহে দেশে কভিডের ব্যাপারে কেউ কেউ কত সচেতন হয়েছে। অল্প সময়ে আমরা গোসল সেরে ফেললাম। আমার ছেলে ওয়ামেকও তার অফিসের কাজে ওয়াশিংটন গিয়েছিল দুই সপ্তাহের জন্য। আমাদের আসার পরদিন সেও ফিরল এবং যথারীতি ওরাও আমাদের বাসায় চলে এল। পরের দুই সপ্তাহ আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল সন্তানদের ব্যাপারে হয়তো আমাদের আরো অনেক বেশি সতর্ক থাকা উচিত ছিল। তবে আল্লার অশেষ মেহেরবানি যে আমরা সবাই সুস্থ ছিলাম এবং আছি। ফেরার চার মাস হয়ে গেল। কভিডের কারণে সারা পৃথিবীর চেহারার কত পরিবর্তন। স্কুল, অফিসসবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। সবাই বাসায় বসে কাজ করছে। কতদিন হলো সবাই এভাবে বাসায় একসঙ্গে থাকার সুযোগ হয়নি। সে এক অন্য রকমের আনন্দ যেন।

আমার মনে হয়, আমার মনটা নিজেকে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। একদিকে চিন্তামুক্ত আছিসবাই নিজ নিজ বাসায় মোটামুটি নিরাপদেই আছে। অন্যদিকে আতঙ্ক তো আছেই। পাল্লা দিয়ে যেভাবে কভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? দেশে-বিদেশে মৃত্যুর মিছিল ক্রমে বাড়ছে। লকডাউনের ফলে মেহনতি মানুষের হাহাকার বেড়েই চলেছে। জানি না দেলোয়ার সাহেবরা বা বাকি রোম প্রবাসী কোথায় কেমন আছেন।

যেন আনন্দ আর উদ্বেগের এক নিষ্ঠুর সমাহার। পরেরটাই বেশি। অনেক বেশি। (শেষ)

 

নীলোফার রাজা চৌধুরী: সাবেক এনজিওকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন