করোনাসংকট

উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রগতি কি থমকে যাবে?

নোয়া স্মিথ

সাম্প্রতিক দশকগুলোয় জোরালো প্রবৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কয়েক মিলিয়ন নাগরিককে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বেরিয়ে নিয়ে এসেছে। তবে করোনা মহামারী তাদের এই অর্জন ফের হুমকিতে ফেলছে। এদিকে আবার যুক্তরাষ্ট্রের পতন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

১৯৯০ সালের দিকে উন্নয়ন যাত্রা শুরু করে দরিদ্র দেশগুলোর কিছু ধনী দেশে পদার্পণ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং ইউরোপের কিছু দেশ পুরোপুরি উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। চীন বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে চমকপ্রদ ও জোরোলা শিল্পায়নের মাধ্যমে ক্রমেই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। আবার মালয়েশিয়া, তুরস্ক, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং থাইল্যা-ও উন্নত দেশের তকমা অর্জন করেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ, ইথিওপিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো দ্রুত শিল্পায়নের পথে যাত্রা শুরু করছে; যদিও প্রধানত প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানিকারক দরিদ্র দেশগুলো চাহিদায় একটি বড় ধরনের উল্লম্ফন থেকে প্রভূত উপকৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই প্রবৃদ্ধি অভিবাসী রেমিট্যান্স প্রবাহের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি ও রেমিট্যান্সের যুগল বন্ধন বৈশ্বিক হতদারিদ্র্য নাটকীয় মাত্রায় কমিয়ে বৈশ্বিক অসমতার কিছুটা নিম্নতর করেছে। 

দুর্ভাগ্যক্রমে, এই প্রসন্ন প্রবণতা বর্তমানে বড় বিপদের দিকে ধাবমান। স্বল্পমেয়াদে, সবচেয়ে বড় হুমকি করোনাভাইরাস মহামারী। এই ভাইরাস বিশ্বকে একটি অর্থনৈতিক খাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রাক্কলন করেছে যে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদন ২০২০ সালে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময় থেকে যা হবে সবচেয়ে বড় পতন। একইসঙ্গে বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ায় রেমিট্যান্সেও বড় ধস নেমেছে।

যদিও আইএমএফ ২০২১ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত আগের ফিরে আসার প্রাক্কলন করেছে, অনেকগুলো কারণে তা নাও ঘটতে পারে। একটি বিষয় হলো যে, এমনকি আগামী বছরের প্রথম দিকে একটি কার্যকর টিকা এলেও এটি বিশ্বের সবার কাছে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যাবে। তার মানে কিছু দেশকে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্ট অর্থনৈতিক অভিঘাত মেনে নিয়েই চলতে হবে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কঠিন ও বিপদজনক হবে। এতে বাণিজ্য সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে। একবার বাণিজ্য সম্পর্কগুলোর অবনমন ঘটলে সেগুলো আবার শক্তিশালী করতে কিছুটা সময় লাগবে, বিশেষত যেহেতু বিশ্ব অনেকটাই সুরক্ষাবাদেও (প্রটেকশনিজম) দিকে যাত্রা করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যকার কেন্দ্রীয় সম্পর্ক এরই মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে আংশিকভাবে পাক খুলেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রাক্কলন করেছে যে চলতি বছর বিশ্ববাণিজ্যে ৩২ শতাংশ পতন ঘটবে।

ব্যাহত হওয়া বাণিজ্য সম্পর্ক রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধির কৌশল অব্যাহত রাখতে মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং থাইল্যান্ডের মতো শিল্পায়নের দিকে হাঁটা দেশগুলোর পথ কঠিন করে তুলবে। এসব দেশ প্রায়ই ক্ষেত্রে এখন উন্নত বাজারগুলোয় ইলেক্ট্রনিকস, গাড়ি/যানবাহন এবং অন্য উৎপাদিত পণ্য বিপুল পরিমাণে রফতানি করে। অধিকন্তু, দমিত বিক্রয়, কমে আসা উৎপাদন এবং ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে করোনাভাইরাস ওইসব উন্নত দেশকে তাদের সরবরাহ নিগড়সম্পর্কিত কৌশলগুলো পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন এরই মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি থেকে দেশকে সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় চৌহদ্দীর মধ্যে সরবরাহ নিগড় সংহত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। এটি যদি রীতিতে পরিণত হয়, তাহলে সেটি শিল্পায়নমুখী দেশগুলোর রফতানি উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা মাত্রা বাড়ানোর বিষয়টি আরো কঠিন করে তুলবে। বিশ্ব বাণিজ্য থেকে একটি সাধারণ পশ্চাদ্ধাবন মহামন্দার মতো পরিস্থিতিতে পর্যবসিত হতে পারে।

তবে এক বছর হোক বা পাঁচ বছর হোক, একসময় অবশেষে করোনাভাইরাস থেকে অর্থনীতিগুলো পুনরুদ্ধার হবে। আস্থা ফিরে এলে এবং মহামারীর স্মৃতি বিবর্ণ হয়ে এলে দেশ ও কোম্পানিগুলো আবারো বৈশ্বিক বাণিজ্যূ সম্প্রসারণের দিকে যাত্রা করবে। সমস্যা হলো ওই সময় উন্নয়নশীল দেশগুলো একটি নতুন সমস্যার মুখোমুখি হবে। আর তা হলো- যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভূমিকা দমিত হওয়া।

ঐতিহ্যিকভাবে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হতে চাওয়া দেশগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র শেষ ভরসার ক্রেতা হিসেবে কাজ করে এসেছে। দেশটি জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান থেকে বিপুল পরিমাণ শিল্প উৎপাদিত পণ্য কিনেছিল, যা দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল। ডলারকে সঞ্চিতি মুদ্রা হওয়ার সুযোগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উন্মুক্ত পুঁজিবাজার বজায় রেখেছে, এমনকি যদিও এটি (ডলার) অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ঘাটতিতে ভূমিকা পালন করেছে এবং চীনের ডব্লিউটিওতে প্রবেশসহ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিগুলো করার দিকে প্রলুদ্ধ করেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে, যা তাদের ব্যবসা-পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করতে সাহায্য করেছে। অধিকন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ততা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যৌথ উদ্যোগ, বিদেশে অধ্যয়ন-গবেষণা এবং সরবরাহ নিগড়ের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বের প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা চর্চা আয়ত্ত করতে সাহায্য করেছে। এভাবে দেশগুলো উৎপাদনশীলতা লক্ষণীয়ভাবে বাড়িয়েছে।

তবে জাতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পতনের দিকে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে দেশটি সবচেয়ে খারাপভাবে করোনাসংকট সামলেছে, এর মধ্য দিয়ে  সেখানে গভীর প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় উন্মোচিত হয়েছে। দেশটি তিক্ত বিভাজন ও অব্যাহত অস্থিরতায়ও ভুগছে। এমনটি অব্যাহত থাকলে দেশটি অর্থনৈতিক আকার, রফতানি এবং হাইটেক এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির দিক থেকে চীনের কাছে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান হারাবে। সঞ্চিতি মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থানও নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে।

এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রগতিতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি, পুঁজি নিয়ন্ত্রণ এবং বণিকবাদী প্রবৃদ্ধি নিয়ে চীন বোধহয় দেশটির বাজারগুলোয় মুক্তভাবে তার হামবড়া ভাব দেখাতে আগ্রহী।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে একটি চীনকেন্দ্রিক বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিস্থাপন এভাবে গত তিন দশকে বজায় থাকা বৈশ্বিক উন্নয়নের সুখী-স্বস্তিকর প্রবণতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ফলে একটি নতুনভাবে রুদ্ধ, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বিকাশউন্মুখ প্রতিযোগী দেশগুলোর (পড়ুন উদীয়মান দেশগুলো) জন্য আগের ছন্দে এগিয়ে যাওয়া সম্ভবত বেশ কঠিনই হবে। 

লেখক:  স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্সের সহকারী অধ্যাপক
ব্লুমবার্গ থেকে ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন