বৈরুতের মতো বিস্ফোরণ ঝুঁকিতে রাজধানীবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

লেবাননের রাজধানী বৈরুতে রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পর্যন্ত ১৩৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো চার হাজারের বেশি। এতে তিন লাখের মতো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিস্ফোরণের জন্য দায়ী হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, যা বৈরুত বন্দরের একটি গুদামঘরে অবৈধ অনিরাপদভাবে মজুদ ছিল দীর্ঘ পাঁচ বছর। বন্দরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আদালত বিপজ্জনক পদার্থ রফতানি কিংবা বিক্রি করতে নির্দেশ দিলেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে লেবাননকে।

বৈরুতে লোমহর্ষক বিস্ফোরণের পর নড়েচড়ে বসছে গোটা বিশ্ব। এমন বিপজ্জনক পদার্থ বা রাসায়নিক কারখানা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে অনেক দেশ। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিডনি থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুদ সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ঘটনার পর ভারতও চেন্নাইয়ের ৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। পুরান ঢাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ বিপজ্জনক সব রাসায়নিক পদার্থের বিপুল মজুদ থাকলেও তা সরানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ রয়েছে, তা বৈরুত বন্দরে মজুদ রাসায়নিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কোনো ধরনের মনিটরিং ছাড়াই যত্রতত্রভাবে রাখা হচ্ছে এসব কেমিক্যাল। ফলে যেকোনো সময় বৈরুতের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে রাসায়নিক পদার্থের মজুদ নিরাপদ স্থানে সরানো এবং কঠোর মনিটরিং নিশ্চিতের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

এদিকে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বলছেন, তারা রাসায়নিক দ্রব্যের সঙ্গে নয়, বরং মৃত্যুকূপের মধ্যেই বসবাস করছেন। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন দোকান থাকলে যে কোনো সময় নিমতলী বা চকবাজারের চুড়িহাট্টার চেয়েও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো সময় আবার জ্বলে উঠতে পারে পুরান ঢাকা। যে কোনো কেমিক্যাল গোডাউন থেকে ঘটতে পারে অগ্নিকাণ্ড বিস্ফোরণ। বলা যায়, আগুনের ওপর বসবাস আমাদের। কখন কী ঘটে, সে চিন্তায় রাতের বেলায় ঘুমও আসে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজারই আছে বাসাবাড়িতে। মাত্র ৭০০ গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি সব গুদামই অবৈধ। প্রশাসনের চোখের সামনে এসব গোডাউনে ক্ষতিকর ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসা করে যাচ্ছেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ী।

২০১০ সালের জুন ঢাকার নিমতলীতে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুন কেমিক্যাল দাহ্য পদার্থের গুদাম দোকানে ছড়িয়ে পড়লে ১২৪ জনের প্রাণহানি হয়। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর দাবি ওঠে, পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে প্রাণঘাতী কেমিক্যাল কারখানা আর গুদাম সরিয়ে নেয়ার। তখন ব্যবসায়ীরা বলেন, উপযুক্ত জায়গা পেলে ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেবেন, যদিও তা করেননি তারা।

নিমতলী ট্র্যাজেডির পরও কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে না নেয়ার বড় খেসারত দিতে হয়েছে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় পারফিউমের কারখানা গোডাউনে আগুনে প্রাণ হারান ৭১ জন। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। একই সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ও কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সাময়িকভাবে পুরান ঢাকার গোডাউন সরাতে দুটি প্রকল্প নেয়া হয়। তবে নিরাপদ কেমিক্যাল পল্লী এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর প্রচেষ্টা প্রায় ১০ বছর ধরে চললেও এখনো সরানো সম্ভব হয়নি। আগে শুধু পুরান ঢাকায় এসব কেমিক্যাল মজুদ থাকলেও প্রশাসনের চাপে এখন গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে কেমিক্যাল গুদাম দোকানগুলোয় কোনো সাইনবোর্ড রাখা হয়নি। ফলে আগে শুধু পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকলেও এখন ঝুঁকিতে গোটা রাজধানীর মানুষ। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে, যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু কেরানীগঞ্জ নয়, সিটি করপোরেশন টাস্কফোর্সের অভিযানের পর বাড্ডা, ধানমণ্ডি যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, মুগদা, বাসাবো মিরপুরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনেক ব্যবসায়ী কেমিক্যালের মজুদ সরিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ সরিয়ে নিয়েছেন গাজীপুর, টঙ্গী নারায়ণগঞ্জে। অনেকেই এসব এলাকায় নতুন করে কারখানা চালু করেছেন। কেমিক্যাল গুদামে বিস্ফোরণে ঝুঁকি থাকায় এসব এলাকার বাসিন্দারাও উদ্বিগ্ন।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ ব্যাপারে বণিক বার্তার সঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে না চাইলেও দপ্তরের আর একজন বিস্ফোরক পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই ওই এলাকার ঠিকানায় একটি লাইসেন্সও দেয়া হয়নি। অবৈধ কেমিক্যাল কারখানাগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পরিচালনা করেন। বিস্ফোরক পরিদপ্তর শুধু ছাড়পত্র দিয়ে থাকেন। যে কারণে লাইসেন্স না দিলেও পুরান ঢাকায় অবৈধ কারখানা গুদামের অভাব নেই। প্রশাসনে কিছুটা তোড়জোড়ের পর অনেকে বাসাবাড়ি গলির মধ্যে কেমিক্যাল সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

পুরান ঢাকা ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট স্থিতিশীল হলেও উচ্চ তাপমাত্রায় এটি বিস্ফোরিত হতে পারে। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণেই খননশিল্পে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে এবং সন্ত্রাসীরা বোমা তৈরিতেও রাসায়নিক ব্যবহার করে। রাসায়নিক পদার্থ তেল বা অন্য কিছুর সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ হতে পারে। অনেক সময় আগুনের সংস্পর্শে এলেও বিস্ফোরণের ঘোষণা ঘটতে পারে। তবে ভয়ের বিষয় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহূত হচ্ছে সার তৈরিতে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সার তৈরির কারখানা থাকলেও এসব মজুদ থাকে অধিকাংশ ঢাকাতে। তার বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে কেমিক্যাল গোডাউন যথাযথ মনিটরিং প্রয়োজন।

গত বছর চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকায় মজুদ থাকা কেমিক্যাল সরিয়ে শ্যামপুর টঙ্গীতে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পুরান ঢাকার বিভিন্ন ভবনে রক্ষিত কেমিক্যাল অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য রাজধানীর শ্যামপুর টঙ্গীতে নিরাপদ স্থানে সরানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়। কদমতলী থানার শ্যামপুর মৌজায় অবস্থিত বিসিআইসির উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায় বিএসইসির খালি জায়গায় এগুলো সরিয়ে নেয়া হবে বলেও জানানো হয়। প্রাথমিকভাবে দুটি স্থান মিলিয়ে ১২ দশমিক ১৭ একর জমির ওপর চার লাখ বর্গফুট আয়তনের স্টিল শেড নির্মাণ করে এগুলো সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া টঙ্গীতে স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের ছয় একর, ঢাকায় শ্যামপুরে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের ছয় একর। তবে পরিকল্পিত কেমিক্যাল পল্লী নির্মাণ করতে সময় লাগবে অনেক।

বাংলাদেশ অ্যাসিড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ পলাশ বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো নিয়মনীতি না থাকার কারণে দেশে অবৈধভাবে বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুদ করা হয়। যে কারণে নগরবাসী ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে সরকার একটি কেমিক্যাল পল্লী গড়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেটার দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। যদি সরকার খাতের জন্য একটি সুন্দর নীতিমালা তৈরি করে, তাহলে পোশাক শিল্পের মতো একটি বড় শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে কেমিক্যাল খাত। দ্রুত কেমিক্যাল গুদাম নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম বণিক বার্তাকে বলেন, গত ক্রয় কমিটির সভায় কেমিক্যাল পল্লীর মাটি ভরাটের বিষয়টি আমরা উপস্থাপন করেছিলাম। কমিটির কিছু পর্যবেক্ষণ আছে, পর্যবেক্ষণ অনুসরণের নির্দেশনা আমরা এরই মধ্যে দিয়েছি। এটি হয়ে এলে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে দিতে পারব। মাটি ভরাটের কাজ শেষ হতে চার-পাঁচ মাস সময় লাগতে পারে। আশা করছি, খুব দ্রুত এক বছরের মধ্যে হয়তো উদ্যোগটির ভালো উন্নতি দেখতে পাব। কেমিক্যাল সংক্রান্ত ঝুঁকির বিষয়ে যথাযথ পর্যবেক্ষণ মতামত জানাতে পারবেন বিস্ফোরক পরিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন