সৌদি আরবে প্রবাসী সেবা কেন্দ্র

বাংলাদেশী নাগরিকের তথ্য অনিরাপদ হাতে

তাসনিম মহসিন

বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিকদের পাসপোর্ট নবায়ন, জন্মসনদ নিবন্ধন, সত্যায়িতকরণ, প্রবাসী কল্যাণ কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের কনস্যুলার সেবা সরাসরি দিয়ে থাকে দূতাবাসগুলো। তবে সৌদি আরবে সেবা কার্যক্রমে আল মামল জেনারেল সার্ভিসেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এতে সেবা পেতে প্রবাসীদের অতিরিক্ত অর্থ যেমন গুনতে হচ্ছে, তেমনি নাগরিকদের তথ্য অনিরাপদ হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকরা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রবাসী সেবা কেন্দ্র বা এক্সপ্যাট্রিয়েট ডিজিটাল সেন্টার (ইডিসি) স্থাপনের পরিকল্পনা নেয় সরকার। ইডিসির মাধ্যমে দূতাবাসগুলোর কনস্যুলার সেবা কার্যক্রম আরো হাতের নাগালে আনা এবং সেবা সহজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের বিভিন্ন সেবা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া নিশ্চিত করতে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা সই করা হয়। এতে দূতাবাস প্রথম পক্ষ, আল মামল জেনারেল সার্ভিসেস দ্বিতীয় পক্ষ এবং এটুআই প্রোগ্রাম ছিল তৃতীয় পক্ষ।

ইডিসি নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা অনুযায়ী, ইডিসির উদ্যোক্তা দূতাবাস নির্বাচিত করবে। আর উদ্যোক্তা পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগকৃত হবে। উদ্যোক্তা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দূতাবাসের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। নতুন উদ্যোক্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বিকল্প উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মরত উদ্যোক্তা অগ্রাধিকার পাবেন। কোনো কারণে উদ্যোক্তা পরিবর্তনজনিত হলেও সেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে না। উদ্যোক্তাদের কোনো ধরনের আইনি জটিলতা তৈরি হলে বা অনাপত্তিপত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে দূতাবাস সহায়তা প্রদান করবে। এছাড়া উদ্যোক্তারা দূতাবাসের নির্ধারিত সেবার বাইরে কোনো সেবা দিতে পারবে না। সেই সঙ্গে দূতাবাসের ঠিক করে দেয়া নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত কোনো ফি নিতে পারবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আল মামল জেনারেল সার্ভিসেস বর্তমানে সাত ধরনের সেবা দিয়ে আসছে। এজন্য সরকারি ফির বাইরে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ অর্থ নিচ্ছে তারা। সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত প্রবাসীদের জন্য ফি কিছুটা কম হলেও অন্যান্য শহরে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশি ফি গুনতে হচ্ছে। বর্তমান সেবাগুলোর মধ্যে পাঁচ বছরের জন্য পাসপোর্ট রি-ইস্যুর ক্ষেত্রে সরকারি ফির বাইরে ৪০ থেকে ৬০ সৌদি রিয়াল অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের। এছাড়া পাসপোর্ট নবায়নে ১০ থেকে ১৫ রিয়াল, ট্রাভেল পারমিটের জন্য ২০ থেকে ৩০ রিয়াল, নথি সত্যায়িতকরণে ১০ রিয়াল, সৌদি পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য দূতাবাসের সুপারিশপত্র পেতে ১০ রিয়াল, নকল জন্ম নিবন্ধন সনদ সরবরাহে ১০ রিয়াল এবং প্রবাসী কল্যাণ কার্ডের জন্য অতিরিক্ত ৪৫ থেকে ৬০ রিয়াল গুনতে হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের।

কূটনীতিকরা বলছেন, ধরনের সেবা অনেক দেশ দিয়ে থাকে, তবে তা দেয়া হয় একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, কোনো দেশে যদি দূতাবাস না থাকে, তবে সে দেশে অনারারি কনসাল জেনারেল ধরনের কিছু সেবা দিয়ে থাকেন। তবে তা খুবই সীমিত। মূলত সত্যায়ন বা সুপারিশপত্র দিয়ে থাকেন তারা। কিন্তু দূতাবাস থাকলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ধরনের কনস্যুলার সেবা দেয়ার ঘটনা দেখা যায় না। আর সৌদি আরবে তো বাংলাদেশের পূর্ণ দূতাবাসসহ একটি কনস্যুলেটই রয়েছে।

সূত্র জানায়, ইডিসি পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে কিছু শর্ত দিয়েছিল দূতাবাস। শর্তগুলো হলো পাসপোর্ট অন্যান্য সরকারি কাগজপত্র পরিবহনের জন্য সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স থাকতে হবে। কমিউনিটিতে গ্রহণযোগ্যতা সুনাম থাকতে হবে। এনএসআই নিরাপত্তা ছাড়পত্র সৌদি সরকারের অনুমতিপত্র নিরাপত্তা ছাড়পত্র উতরাতে হবে। ইডিসি পরিচালনাকারীর বৈধ ইকামা থাকতে হবে। উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য শহরের উপযোগী স্থানে কার্যালয় নিতে হবে। স্থানীয় আইন অনুযায়ী কাগজপত্র থাকতে হবে এবং কারিগরি আইটি আরবি ভাষা জানা সম্পন্ন দক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। তবে শর্তের কোথাও কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হয়নি।

আল মামল জেনারেল সার্ভিসেসের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। রিয়াদে প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে এর শাখা কার্যালয় রয়েছে। ২৫ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ সেবা, তৈরি পোশাকের পাইকারি খুচরা ব্যবসা, বিভিন্ন অফিসের সাপ্লাই এবং রান্নাঘরের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে আসছে। সেই সঙ্গে এটুআইয়ের প্রকল্প ইডিসি সৌদি আরবের রিয়াদে বাস্তবায়ন হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মোট ১১টি কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রিয়াদেই তিনটি রয়েছে।

সৌদি আরবের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, এর আগে কনস্যুলার সেবা দেয়ার কোনো অভিজ্ঞতা আল মামল জেনারেল সার্ভিসেসের নেই। আর ধরনের সেবার সঙ্গে নাগরিকের গোপনীয় তথ্য জড়িত। ফলে তাদের ধরনের তথ্য ব্যবস্থাপনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবেও ধরনের সেবা তারা দেয়নি। ফলে তথ্যে গোপনীয়তা বোঝার অভিজ্ঞতা তাদের নেই।

আল মামল জেনারেল সার্ভিসেসের কাছে বাংলাদেশী নাগরিকদের তথ্য কতটা সুরক্ষিত বিষয়টি জানতে চাইলে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ২২ লাখ প্রবাসী সৌদিতে বসবাস করেন। আর সেখানে মিশনে আমাদের কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র ১০-১২ জন। ফলে প্রবাসীদের সেবা আরো সহজতর করতে ইডিসি করা হয়েছে।

বিষয়ে জানতে সৌদি আরবে বাংলাদেশের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর সঙ্গে যোগাযোগ করা বণিক বার্তাকে বলেন, আল মামল জেনারেল সার্ভিসেসের দুই বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখানে তারা দুই বছর ধরে সেবা দিয়ে আসছে।

সেবার ক্ষেত্রে নাগরিকের তথ্য বেহাত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ। তিনি বলেন, তারা মূলত এক্সপ্রেস পোস্ট অফিস হিসেবে কাজ করছে। তারা মূলত যে আবেদনগুলো পাবে তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। যেটি আগে আমরা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নিতাম। সৌদি সরকার থেকে আমাদের ভিএফএসের মাধ্যমে সেবাটি দেয়ার কথা বলেছিল। তবে ভিএফএসে সেবা পেতে আমার মতো রাষ্ট্রদূতকে লাইনে দাঁড়াতে হয়। সেখানে আমাদের শ্রমিকরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন