সময়ের ভাবনা

করোনাকালের ‘রোমান হলিডে’

নীলোফার রাজা চৌধুরী

আমার স্বামী জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা এফএওর উপদেষ্টা নিযুক্ত হলেন আরো কয়েকজন বিশ্বনন্দিত গুণীজনের সঙ্গে। তাদের প্রথম সভা হবে রোমে, ফেব্রুয়ারির ২৫ ২৬ তারিখে। ঠিক হলো আমিও হব তার সফরসঙ্গী। মহা আনন্দে, আবেগে কাটছিল আমার পুরো জানুয়ারি মাসটা। প্রথমবারের মতো রোমে যাওয়ার সুযোগ হলো আমার। আমার বাবা সেই ১৯৫২ সালে রোমে গিয়েছিলেন, তাই আবেগটাও একটু বেশি। কত প্ল্যান, কত কিছু। টিকিট হলো ২৩ ফেব্রুয়ারি। প্রথমে রোমে যাব। দুদিন পর ভ্যাটিকান এবং তারপর ভেনিসে যাব এক সপ্তাহের জন্যএভাবেই  ঠিক  হলো আমাদের প্রোগ্রাম।

ডিসেম্বরের শেষের দিকেই শুনেছিলাম চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের খবর। কেন জানি না খবরটা মনে অতটা দাগ কাটেনি। ২০০২ সালে সোয়াইন ফ্লুর  কথা প্রচুর শুনেছিলাম। প্রায় সবাই বেশ কিছুদিন মুরগি খাওয়া থেকে বিরত ছিলাম। ২০০৯ সালে বেশ কয়েকটা দেশে সার্স মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। কিছুদিন পর সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

আমরা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে রওনা হলাম। এমিরেটসের ফ্লাইট দুবাই হয়ে রোম পৌঁছার কথা। দুবাইয়ে প্লেনে ওঠার আগে বোর্ডিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড়াতেই দেখলাম যাত্রীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরই মাস্ক পরা।  বুকটা কেঁপে উঠল।  আমরা তো সেসবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। অনেকের আবার গ্লাভসও পরা। প্লেনে ওঠার পর তো আরো অস্বস্তি শুরু হলো। আমার পাশের সিটে বসল মাস্ক পরা একটা ছেলে, দেখে মনে হলো চীনা হবে। কতক্ষণ পরপর ওরা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করছে।

দুবাই থেকে প্রায় ঘণ্টার পথ। লক্ষ করলাম মাস্ক পরা প্রায় সবাই চীনা। মনে প্রশ্ন জাগল, এত চীনা রোমে যাচ্ছে কেন?

রোমের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লিওনার্দো দা ভিঞ্চিতে আমরা অবতরণ  করলাম। বেল্টের কাছে দাঁড়িয়েছি মালপত্রের জন্য। মনে হচ্ছিল যেন চীনেই বেড়াতে গেছি। সুযোগমতো কাছে দাঁড়ানো একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ওরা আসলে তাইওয়ানের। কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সবাই। অনেকখানি স্বস্তি পেলামতাইওয়ানে তখনো নভেল করোনাভাইরাস দেখা দেয়নি।

আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ এফওর গাড়িতে করে আমরা হোটেলের  উদ্দেশে রওনা হলাম। ঘণ্টাখানেক লাগল হোটেলে পৌঁছতে। আমাদের হোটেলটা সিটি সেন্টারে, পুরনো রোমের প্রাণস্থল। বেলা ৩টা বাজে প্রায়। ভীষণ ভালো লাগছিল। বুটিক হোটেলে থাকতে আমি খুব পছন্দ  করি। নিচে রিসেপশনে যতক্ষণ ছিলাম, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম ওদের ডেকোরেশন। প্রতিটি আসবাবই মনে হয় বিশেষভাবে যত্ন করে বানানো হয়েছে। ডিজাইন, নানা রঙের সমাহারসবকিছুই দেখার মতো। কোন আসবাব কোথায় বসালে সুন্দরটা  ঠিকভাবে  ফুটে  উঠবে, ব্যাপারে ওরা যেন খুব সজাগ। নিখুঁত শিল্পের ছোঁয়া। আমি মুগ্ধ।  পৃথিবীর অনেক দেশের বিভিন্ন রকম হোটেলে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনেক হোটেল দেখেছি অত্যন্ত আধুনিকভাবে সাজানো, খুব নামিদামি আসবাব। আবার কোনো হোটেলে হয়তো আধুনিক আসবাবের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা অন্য রকম রুচিরও পরিচয় পাওয়া যায়। এখানকার আসবাব হচ্ছে অ্যান্টিক পর্যায়ের, রোমান ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে যেন বসানো হয়েছে। সুন্দর কোনো জিনিস স্বাভাবিকভাবেই মনটা কিছুক্ষণের জন্য কেড়ে নেয়। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সেখানে।

পাঁচতলা হোটেলের চারতলায় আমরা রুম পেলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে দেশে সন্তানদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ৬টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। দেশের বাইরে গেলে আমরা সাধারণত অনেক বেশি পায়ে হেঁটে বেড়াতে পছন্দ করি। তাতে নতুন জায়গাগুলো খুব ভালো করে দেখা হয়ে যায়, পছন্দমতো ছবিও তোলা যায়। দেশে তো এভাবে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ তেমন পাওয়া যায় না, দেশের বাইরে গেলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করি।

রিসেপ?শন থেকে ম্যাপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে প্রায় মিনিট দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছলামপিঁয়াজা ভেনেজিয়াস্কোয়ারে। পিঁয়াজা ভেনেজিয়া হচ্ছে রোমের কেন্দ্রে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক স্কোয়ার। স্কোয়ারে একটা  বিশিষ্ট  স্থাপনাওলটেয়ার ডেলা পেট্রিয়া,’ যা ইতালির প্রথম রাজার স্মরণে করা হয়েছে। স্কোয়ারের একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এখানে ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সময়ে অনেকবার ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি তার সমর্থকদের উদ্দেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতেন। 

সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। যেদিকেই দেখছি মনে হচ্ছে প্রতিটি বাড়িরই যেন কিছু একটা ইতিহাস আছে। প্রায় ২০-২৫ মিনিট হাঁটার পর মনে হলো আমরা রোমের একটি প্রধান বাণিজ্য এলাকা বা বিজনেস ডিস্ট্রিক্টে এসে গেছি। রাস্তার অন্যপাশে বেশ অনেকগুলো রেস্তোরাঁ দেখা গেল। এসব রেস্তোরাঁর বাইরে ভেতরেদুইখানেই বসার জায়গা আছে। বাইরে ওপেন এয়ারে বড় বড় ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিলগুলো সাজানো থাকে। দূর থেকে দেখতে পেলাম দুজন লোক একটা রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ারই হবেন। কথা বলে জানতে পারলাম তারা দুজনেই বাংলাদেশী, রেস্তোরাঁয় কাজ করেন।  মহাসমাদরে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। দুজনেরই নাম দেলোয়ার। ভালোই লাগল। আমরা ইতালিয়ান খাবাররিজুটোখেতে পছন্দ করি, তাই রিজুটোই খেতে চাইলাম। সঙ্গে তারা পিত্জাও দিলেন, ফ্রি। বিশ্ববাসীর জন্য পিত্জা ইতালির একটা উপহার। পিত্জার উত্পত্তি এখানেই। পিত্জার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় লন্ডনের পিত্জা হাটে, ১৯৮৩ সালে। এরপর আরো অনেক জায়গায় বহুবার পিত্জা খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে কানাডার টরন্টোতেমাদার পিত্জা স্বাদটা এখনো ভুলতে পারিনি।

ইতালির অরিজিনাল পিত্জা খাওয়ার সৌভাগ্য এই প্রথম। ওদের পিত্জা-ক্রাস্টটা খুবই পাতলা। আমার আবার ভারী স্টাফ? ক্রাস্ট পছন্দ, তাই ওটা খুব একটা ভালো লাগল না। অনেকটা আমাদের দেশী চায়নিজ খাবারের মতোই। আমারিকায় গিয়ে যেমন প্রথমে ওদের চায়নিজ খাবারটা পছন্দ হয়নি, চীনে গিয়েও ওদের খাবারটা তেমনই ভালো লাগেনি। আমাদের দেশের রেস্তোরাঁগুলোয় আসলে আমরা দেশীয় তেল, মসলা মিশিয়ে রান্না করা চায়নিজ খাবারে অভ্যস্ত কিনা।

লক্ষ করলাম, রেস্তোরাঁয় কাস্টমার শুধু আমরাই। দেলোয়ার সাহেবদের থেকে শুনলাম এই সময়টায় রেস্তোরাঁগুলোয় জায়গার অভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এখন বিদেশী পর্যটক প্রায় নেই। পরদিন আমরা আবার এখানে ডিনারে আসার প্ল্যান করলাম এবং দেলোয়ার সাহেবদের অনুরোধ করলাম আমাদের জন্য মাস্ক স্যানিটাইজার কিনে রাখতে। দোকানপাট খুঁজে বের করার ব্যাপার আছে তো

পরের দিন সকালে প্রাতরাশের জন্য নিচের তলায় রেস্তোরাঁয় নামলাম। ওখানে এফওর মিটিংয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা অনেকজনের সঙ্গে দেখা হলো। ৯টার দিকে আমার স্বামী কাজে বেরিয়ে গেলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। নিচে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প হলো। এত অমায়িক ব্যবহার। রিসেপশনিস্টদের  ব্যবহার সাধারণত ভালোই থাকে। কিন্তু যেন অন্য রকম। অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো ইংরেজিতে সে ঠিকভাবে বোঝাতে পারছিল না, কিন্তু আমি সুযোগ খুঁজতাম আসা-যাওয়ার পথে তার সঙ্গে একটু গল্প করার জন্য। ভালো লাগত। বাইরে বেরুলাম। ধারেকাছের জায়গাগুলোয় হেঁটে হেঁটে বেড়ালাম, অনেক ছবি তোলা হলো। রোমের সৌন্দর্য বর্ণনা করা কঠিন। দু-একটা রাস্তা পরেই একটা নদী। নদী আপন গতিতে বয়ে চলেছে। সাদা সাদা একঝাঁক সি-গাল নদীর ওপরে উড়ছে, কয়েকটা আবার চেষ্টায় আছে ছোঁ মেরে কীভাবে নদী থেকে মাছ ওঠানো যায়। নদীর পাশে বেঞ্চে ঘণ্টাখানেক বসেছিলাম। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। মিষ্টি মিষ্টি রোদে গাছের তলায় বেঞ্চে এতক্ষণ বসে থেকে উঠে আসাটা অনেক কষ্টের ব্যাপার। অনেককেই দেখলাম পাখিদের খাবার দিচ্ছে। আমারও খুব ইচ্ছে হলো ওদের খাবার দিয়ে কাছে টেনে আনি। কিন্তু আমার কাছে তখন ওদের দেয়ার মতো কোনো খাবার ছিল না। পকেটে কয়েকটা চীনাবাদাম ছিল। ভাবলাম এতগুলো সি-গালের মধ্যে এই কয়েকটা বাদাম না দিলেই ভালো। তাতে বাকিগুলোর মন খারাপ হয়ে যাবে। কিছু পুরনো কথা মনে পড়ল তখন। আমার ছেলের ছোটবেলা। আমরা তখন লন্ডনে। সুযোগ পেলেই তাকে নিয়ে আমাদের বাসা থেকে বেশি দূরে নয় এমন একটা লেকের পাড়ে যেতাম। সঙ্গে থাকত ছোট ছোট করে কেটে আনা রুটির টুকরো। যতক্ষণ রুটি শেষ না হবে ততক্ষণ ছেলেকেও আনা যেত না। মাঝে মাঝে সেও একটু মুখে দিয়ে দিত। মনে মনে হাসলাম। বেশ কয়েকটা বছর গড়িয়েছে মাঝখানে।

হোটেল থেকে মিনিট দশেকের ব্যবধানে আছি। দেখতে পেলাম একটা লাইনে অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কী জানার জন্য কাছে এগোলাম। ফুটপাতের এক পাশ থেকে দেখতে পেলাম গ্লাসের তৈরি চারকোণা ঘরটার ভেতরে চার-পাঁচ ফুট লম্বা একটা মার্বেলের মুখোশ দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম এটাইবোকা দেলা ভারিটি’, বাংলায় যাকে বলা যায় সত্যের মুখ। রোমান পৌরাণিকে এর এক ইতিহাস বর্ণিত আছে।  তার রেশ ধরে আজও এখানে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। এই মুখোশের ভেতরে হাত রাখলে একটা জিনিস প্রমাণিত হয়অনেকটা নির্মমভাবে। যদি সে মিথ্যাচারী হয় তাহলে তার হাত কেটে যায়। অবশ্য রকম কিছু কখনো ঘটেছে বলে তার হদিস ইতিহাসে নেই।  অনেকের হয়তো পঞ্চাশের দশকের সেই বিখ্যাত ছায়াছবিরোমান হলিডে কথা মনে আছে, যেখানে নায়ক গ্রেগরি পেক নায়িকা অড্রে হেপবার্ন দুজনেই পরস্পরের প্রতি প্রেমের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ইচ্ছা হচ্ছিল লাইনে দাঁড়িয়ে যাই, কিন্তু স্বামী সঙ্গে না থাকায় প্রেমের পরীক্ষা আর হলো না আমাদের রোমান হলিডেতে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হোটেলেই ফিরে আসতে হলো।

আমার স্বামী ফেরার পর ৬টার দিকে আবার বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য গতকালের সেই রেস্তোরাঁ। হাঁটতে গিয়ে রাস্তাগুলো অনেক পরিচিত মনে হলো। রেস্তোরাঁয় দেলোয়ার সাহেবদের সঙ্গে অনেক কথা হলো। খুব মজার পাস্তা দিয়ে ডিনার করলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম হোটেলে ফেরার আগে বিখ্যাত ট্রেভি ফাউনটেইন দেখে যাব। আমাদের কথা শুনে ছোট দেলোয়ার (যিনি একটু বয়স্ক, আমরা তাকে বলতাম বড় দেলোয়ার, আর অন্যজন ছোট দেলোয়ার), যার বয়স ২০-২৫ বছর হবে, সে খুব  উৎসাহী হয়ে উঠল আমাদের গাইড করার জন্য। ভীষণ চটপটে ছেলেটা। বেরিয়ে পড়লাম আমরা। দেলোয়ার আমাদের নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের সব অলিগলি দেখাল। ভাবলাম সুবর্ণ সুযোগ। যাকে বলে সোনায় সোহাগা। স্থানীয় কেউ সঙ্গে থাকার এটাই সুবিধা। রাত ১১টা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, মাথার ওপরে ছাতা নিয়ে রোম শহরের বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের সব অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাহ!   

অলিগলির ভেতরে অনেক নামিদামি রেস্তোরাঁ লোকে লোকারণ্য। পাব/বারগুলোয় লোকজন যেন উপচে পড়ছে। সারা রাত ধরে তাদের হইচই চলবে। আধো আলো আধো অন্ধকারে বাইরে থেকে এসব বোঝার কোনো উপায় নেই। অলিগলি ছেড়ে রাস্তায় উঠলাম। রাস্তার এক ধার ধরে চলেছি। কত যে পনিরের দোকান চোখে পড়ল। হাজার রকমের পনির। ইতালির বিখ্যাত পনিরের কথা সবাই জানি। কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।  তাই পনিরের চেয়ে ছবির সংখ্যাই বেশি হয়ে গেল। আমার স্বামীর অনবরত তাগাদা না থাকলে আমি স্বচ্ছন্দে আরো - ঘণ্টা এখানে কাটিয়ে দিতে পারতাম।

কিছু হাঁটতেই পৌঁছলাম বিখ্যাত ট্রেভি ফাউন্টেনে। এখানে নাকি প্রতিদিন কয়েক হাজার লোকের ভিড় থাকে, কিন্তু সেদিন বড়জোর দুই-তিনশ ছিল। কাজেই ফাউন্টেনের একেবারে কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। বিশাল ফাউন্টেন। কয়েকটা সিঁড়ি নামলেই পানির একপাশে দাঁড়ানো যায়। হালকা সবুজ রঙের পানি। প্রচলিত আছে যে এই ফাউন্টেনের পানিতে পয়সা ছেড়ে কিছু উইশ করলে সেটা পাওয়া যায়। ছোট দেলোয়ার অনেক বলছিল আমাকে ব্যাপারে। আমার কাছে খুচরা পয়সা না থাকতে পারে, তাই সে নিজের পকেট থেকে পয়সা বেরও করেছিল আমার জন্য। আমি হেসেছিলাম। পানির এক পাশে দাঁড়ালেই পানির নিচের পয়সার স্তর চোখে পড়ে। পানির অন্য পাশে পাথরের তৈরি বিশাল স্থাপনা। পানির তিন পাশেই লোকজন হাঁটাচলা করতে পারে। ১৭৩২ সালে স্থপতি নিকোলা সালিভ ফাউন্টেনটি তৈরি করেছিলেন।

এই ট্রেভি ফাউনন্টেনের সামনে কোনো ছেলে তার পার্টনারকে প্রপোজ করা নাকি বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল এমনই কিছু একটা দেখার। অনেক গানবাজনা। হইচই। দেশে ইন্টারনেটে এই ট্রেভি ফাউনন্টেন লাইভ অনেকবার দেখেছি। কিন্তু সামনাসামনি এমন একটা পরিবেশে নিজের চোখে দেখার ব্যাপারটা অন্য রকম।  রাত সাড়ে ১২টা বাজে প্রায়। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। ওদের আনন্দ-ফুর্তি এত উপভোগ করেছি যে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি যেন ধুয়ে মুছে গেছে।

পরের দিন সকাল ১০টার দিকে কোট গায়ে দিয়ে আমি আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার অন্য প্রান্ত দিয়ে হাঁটা শুরু। পশ্চিমা দেশগুলোয় সাধারণত সুউচ্চ ভবন থাকে অনেক, আধুনিকতার ছাপ দেখা যায় সর্বত্র। কিন্তু রোমে আমাদের দেখা ঐতিহাসিক এলাকাগুলোয় স্বাভাবিক কারণেই এগুলোর কোনো ছোঁয়া পাইনি। সব স্থাপনাই পাথরের তৈরি, যার থেকে এগুলোর বয়স সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আরেকটা জিনিস খুব চোখে পড়ল। খুব সুন্দর ছোট ছোট গাড়ি একজন বা দুজন বসার মতো। গাড়িগুলোর রঙ বা শেপ দেখে শিশুদের খেলনা গাড়িগুলোর কথা মনে হয়। অর্থনৈতিক কারণ এবং পরিবেশ রক্ষার্থে রোমে অনেকেই ধরনের স্মার্টকার ব্যবহার করে। জায়গায় জায়গায় বড় বড় গাছ ছাতির মতো দাঁড়িয়ে তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। মূল কাণ্ডের ওপরে গাছটা মনে হয় ছাতির মতো গোল করে কেউ কেটে কেটে রেখেছে। এতই  মুগ্ধ  হলাম যে বেলা ৩টার আগে হোটেলে ফিরতে পারলাম না। কিন্তু রুমে ঢুকে যখন ভাইবারে ঢুকলাম, ভয় পেয়ে গেলাম এতগুলো মিসড কল দেখে। দেশ থেকে এত মিসড কল কেন? নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে। খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে ফোন নিয়ে বসলাম। শুনলাম রোমে করোনা ধরা পড়েছে এবং একজন মারাও গেছে। তাড়াতাড়ি করে টিভি খুলে বসলাম। রোমের খবর শুনলাম। আর উহানের খবর শুনে তো আঁতকে উঠলাম। তিনদিনে একি পরিবর্তন। প্রচণ্ড একটা ভীতি কাজ করতে লাগল মনের ভেতরে। আবার নিচে নেমে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে খবরটা শেয়ার করলাম। এই মেয়েটা বেশ কথা বলতে পারে ইংরেজিতে। কিন্তু করোনার ব্যাপারে কোনো চিন্তা আছে বা বেশি কিছু জানে বলে মনে হলো না। হয়তোবা একজন বিদেশী হিসেবে আমাকে কিছু বলতে চাইল না। [চলবে]

 

নীলোফার রাজা চৌধুরী: সাবেক এনজিওকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন