রেলপথ মন্ত্রণালয়

সেবার মান বাড়াতে চলমান সংস্কার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক

সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রেলপথ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে লক্ষণীয় পরিমাণ। লোকবল ঘাটতি সমাধানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নতুন জনবল। সবচেয়ে বড় কথা, রেল ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে রেলপথ মন্ত্রণালয় নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, সেবার মান বাড়িয়ে রেল খাতকে মুনাফার ধারায় ফেরানো। কিন্তু পরিকল্পনাহীনতা দুর্বৃত্তায়নের চক্রে আলোচ্য উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। সেবার মানে আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, তবে মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারা, টিকিট পেতে ভোগান্তি, কালোবাজারি, ছেঁড়া-নোংরা আসন, যাত্রীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশন প্রভৃতি অভিযোগ এখনো নিত্য বিষয় হিসেবে ছিল। শুধু বিনিয়োগ নয়, এসব সমস্যার সমাধান রেলের অভ্যন্তরীণ সুশাসন উন্নতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। সুশাসন উন্নয়নের লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পদবিন্যাসে নানা সময়ে রদবদল হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেলকে জনবান্ধব করা অনিয়ম রুখতে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে আছে টিকিট কাটতে এনআইডি বাধ্যতামূলক করা, অনলাইনে টিকিটের টাকা রিফান্ড করা, রেলসেবা অ্যাপের মাধ্যমে ফটো/ভিডিও যুক্ত করে তাত্ক্ষণিক অভিযোগ প্রদানের ব্যবস্থা ইত্যাদি। অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থাকে উন্নত করা তার মধ্যে অন্যতম। ভিআইপি টিকিট ব্যবস্থাপনাও সংস্কার এসেছে কিছু ক্ষেত্রে। এসব সংস্কার ব্যবস্থাপনা উন্নত করায় যার অবদানের কথা বেশি আলোচিত হয়েছে তাকে সম্প্রতি ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার খবর মিলেছে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে রদবদল হওয়াটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নিয়ে বিতর্কের খুব একটা সুযোগ নেই। তবে রেলওয়েকে কেন্দ্র করে তার নেয়া সংস্কারগুলো যেন ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। রেলে সেবার মান বৃদ্ধির স্বার্থেই তা প্রয়োজন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রেলওয়েতে বিগত সময়ে বিনিয়োগ সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। কেননা রেলপথে যাত্রী বাড়ানো, আয় বাড়ানো লাভজনক করাএই তিন বিবেচনা গৃহীত প্রকল্পগুলোয় তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা সংশ্লিষ্টদের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে বিনিয়োগের কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি। অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন জরুরি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইউরোপ কিংবা এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর বড় শহরে কেন্দ্রীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা রেলভিত্তিক এবং বাসসেবা তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। এমনকি ভারতেও একই অবস্থা। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতির পুঁজিপন্থী সংস্কারে দেশটির বিশাল রেলওয়ে গভীর সংকটে পড়েছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে রেলওয়ে ভিন্ন যাত্রা দিয়ে নিজেকে রক্ষা শুধু নয়, আরো বিকশিত করে। ফলে সময়ের আবর্তে দেশটিতে গড়ে উঠেছে সুন্দর চমত্কার সেবাবান্ধব রেল ব্যবস্থা। বেশিদূর যেতে হবে না, পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের সুবিশাল হাওড়া স্টেশনের যে ঐতিহ্য সেবার সুনাম আমরা এখানে বসে শুনি, সেটি সুবিবেচিত উদ্যোগেরই ফল। অথচ আমাদের দেশের বৃহৎ রেলস্টেশন কমলাপুর তার তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই, শৌচাগার বেহাল, টিকিট কাউন্টারের অপ্রতুলতা, টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, মাদকসেবীদের নিত্য আনাগোনায় যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তাহীনতাসহ খুবই শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছে। সর্ববৃহৎ রেলস্টেশনের হাল হলে দেশের অন্য রেলস্টেশনগুলোর কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। সেবার মান বাড়াতে এবং যাত্রীদের স্বস্তি দিতে প্রতিটি রেল টার্মিনালকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সজ্জিত করা এবং পারিপার্শ্বিক নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সক্রিয়তা কাম্য। রেলওয়ের ভূমি বেদখল হওয়ার নেপথ্যে থাকা কারিগরদের খুঁজে বের করার এখনই সময়। রেলওয়ের দখল হওয়া জায়গা ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে উদ্ধার করা জরুরি। রেলওয়ের জায়গা বেদখলে যারা সহযোগিতা করেছে সেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা দরকার। রেলওয়ের যত বড় বড় ব্রিজ রয়েছে যেমন ভৈরব, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, বঙ্গবন্ধু সেতুসহ সব ব্রিজের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ দরকার। রেল দুর্ঘটনার পর কিছুদিন বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর আবার থেমে যায়, কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয় না। রেলওয়ের প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে এবং সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

রেললাইন, রেলস্টেশন, রেল-কারখানা ভূমিসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামো এখনো দেশের বৃহত্তম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য রেলপথের বেশির ভাগের অবস্থা ভালো নয়। রেলসেতুর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে। আশা করি, সরকারের ভাবনাও আমাদের মতো। তাই সেক্টরে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া দরকার এবং জরুরি ভিত্তিতে এর সংস্কারে এগিয়ে আসা উচিত। বাস্তবতা বলছে, বিগত সময়ে বিনিয়োগ বাড়লেও সুপরিকল্পনা ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকার কারণে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারেনি। যাত্রী বাড়ানো, আয় বাড়ানো লাভজনক করার ক্ষেত্রে প্রকল্পগুলোর প্রতি তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন অভিযোগ সর্বত্র। অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। তাই প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনকে সংস্কার করে যাত্রীদের জন্য স্বস্তিদায়ক মনোরম পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রকম শক্তি দুর্বলতা থাকে। প্রয়োজন হলো শক্তির জায়গাটা কাজে লাগানো আর দুর্বলতা বা সমস্যার জায়গাটা কমানো। বাংলাদেশ ছোট আয়তনের দেশ, মানুষ বেশি। যে দেশে জনসংখ্যা বেশি, জমি কম, স্বভাবতই সেখানে জনগণের পরিবহন হিসেবে রেলই সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। কম গুরুত্ব পায় সড়ক পরিবহন ব্যক্তিগত গাড়ি। ঐতিহ্যিকভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘ রেলপথের অধিকারী হলেও এখানে হয়েছে উল্টোটা। অথচ এটিই ছিল আমাদের একটি বড় শক্তির জায়গা। অনেক পরে হলেও সরকার এটা উপলব্ধি করতে পেরে সাম্প্রতিক সময়ে রেল খাতকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। যাত্রীসাধারণেরও রেলে ভ্রমণ পরিবহনের ক্ষেত্রে আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। নীতিনির্ধারকদের সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনায় রেল ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াক, সেবার মান বাড়ুকএটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন