হাস্নাহেনা

শামীম আজাদ

ঢাকা শহর তখন সাদাকালো ছবির মতো সুন্দর। তখন বিশ্বও আজকের মত এত উষ্ণ কিংবা এত করোনা বিষাক্ত হয়ে উঠেনি। গাড়িতে এসি লাগতো না। স্নান শেষে টাঙাইল সুতি শাড়ি পরে গাড়িতে উঠেই জানালায় ভেজা চুল মেলে হেয়ার ড্রায়ারের কাজ সারতাম। চুল শুকোতে শুকোতে বিচিত্রা অফিসে পৌঁছতাম। 

তখন গুলশান থেকে তেজগাঁ শিল্প এলাকায় গাড়ির চাকা পড়লেই শুরু হয়ে যেত গন্ধ ও ঘ্রাণের পালা। গাড়ির টায়ার, প্লাস্টিক কন্টেনার, ওষুধ, নিউজ প্রিন্ট, কসকো সাবান। একের পর এক নাকে এসে লাগতো। কিন্তু নাবিস্কোর সামনে থেকে এমন এক মিষ্টি সুগন্ধ আসতো যে সে ঘ্রানই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হতো। আমি করতাম কি- ওখানে আসার আগে থেকেই একটু একটু করে বুকের ভেতর থেকে শেষ বিন্দু শ্বাস ধাক্কা মেরে বের করে ফুসফুস খালি করে দম বন্ধ হয়ে থাকতাম। আর কারখানার কাছাকাছি আসতে শুরু করতেই শুরু করতাম একটু একটু করে সুগন্ধ ভরে ভরে নিঃশ্বাস নেয়া। সে নিতেই থাকতাম আর নিতেই থাকতাম দম আটকে না যাওয়া পর্যন্ত। নিজের নাককেই দাঁত বানিয়ে গন্ধ চিবুতাম। গন্ধ-চাতকের মত আমি সুগন্ধ জল পান করতে থাকতাম। গাড়ির চালক রুস্তুমও কৌতুকময় হাসিতে গাড়ির গতি ধীর করে দিতো। অসাধারণ সে সুগন্ধীতে ফুসফুস ভরে তুলতে তুলতে আফসোস করতাম, আমার শ্বাস কেনো আরেকটু দীর্ঘ হল না! আমি কেন শহীদ হলাম না!

বিলেত বসবাসের তিন দশকেও সে রকম কোন সুগন্ধের জন্য শহীদ হতে ইচ্ছে করেনি। করোনার জন্য বন্দী থেকে যে গাছগুলোর পরিচর্যা করি তাতে ফুল এলেও কোন সুগন্ধ আসে না। কিন্তু গত বছর ঠিক এমনি আষাঢ়ের প্রথম দিকে যখন আমার মন বেশ ম্লান তখন একদিন এক অদ্ভূত মাপের চমকে দেয়া উপহার বাক্স এসে হাজির। এমন সুন্দর তার প্যাকেজিং যে তাতেই আমি তিন মিনিট স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। আমার এক প্রিয়জন ফোন করে বলেছিলো, একটা জিনিস পাঠাচ্ছি তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। আমি ছিলাম ফুলের অপেক্ষায়। কিন্তু খুলে দেখি আস্ত এক ন্রম সবুজ পাতা ভরা গাছ। হাস্নাহেনা! বাক্স খুলে হতভম্ব হয়েছিলাম পাঁচ মিনিট! 

ওরে আমার দেশের গাছ রে! ওরে তোর গোড়ায় আমার দেশের মাটি যে! বুক ভেঙে আবেগ আসে, চোখ টলটল করে। দেশের মাটির এক চিমটি তুলে কপালে ঘষতে থাকি। বাইরে বিলেতের বৃষ্টি আমার মন আরো দ্রব করে দেয়। আমি উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে ফিরে এসে দেখি কি আশ্চর্য, ওর গোড়ায় উঁকি দেয়া নরম শাখার নিচে এক জীবন্ত অনু কীট! দিব্বি পাসপোর্ট আর ভিসা ছাড়া এসে পড়েছে ইংল্যান্ড! শীত লাগছে বলেই বোধ হয় আবার সেঁধে যাচ্ছে গাঢ় খয়েরী মাটির কোটের ভেতরে। এবার আমি আমার ফক্স মগে চা বানিয়ে মিউজিয়ামে জিনিষ দেখার মত করে সে হাস্নাহেনা গাছ দেখতে থাকলাম।ওর শিকড় ও মাটি ধরে আছে একটি প্লাস্টিকের পাত্র। তার নিচে আবার মিষ্টি একটা এলুমনিয়ামের বালতি! কতদিন আমি বালতি দেখি না! ওরে আমার দেশের বালতিরে!

সব কটা পাতা টিয়ে রঙা। কুঁড়িও এসে গেছে? তা’হলে ফুটলেও ফুটতে পারে। না ফুটলেও ক্ষতি নেই যা পেয়েছি তাতে আরো সত্তরদিন মন ভালো থাকবে। তবু আশা করতেতো ক্ষতি নেই যে তারা একদিন ফুটে নাবিস্কোর সুগন্ধে ভরে তুলবে আমার লন্ডনের লগন। ইংরাজিতে লেখা তরিবত অনুসরন করতে থাকলাম। কিন্তু বিস্ময় কাটে না। সত্যি কি এ পরীবাগের গ্যারাজের ধারের আমার বাংলাদেশের সেই সতেজ সুকুমারী হাস্নাহেনা, রাতের রাণী? কেন যেন ভাবতাম রাতের বেলা ঐ ফুলের গন্ধে সাপ আসে।

আমার আদরে ও প্রলাপে গাছের উচ্চতা দ্রুত বাড়তে থাকে। শাখা দুটো থেকে তিনটি হয়। কলির থোক বড় হয় আর প্রতিটি কলি টর্চলাইটের মত লম্বা হয়ে যায়। চশমা পড়ে দেখি সেই সুশ্রী সবুজ হাতলের গোড়ায় গড়ে উঠছে হালকা সবুজ নাকফুল। তারপর একদিন সত্যি আমার আকাঙ্খা আড়মোড়া ভেঙে পুরো সজাগ হয়ে যায়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসবার ঘরের বন্ধ দরোজা যেই না খুলেছি অমনি নাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাপের মদালসা গন্ধ। আমার ৩০ বছর আগে হারানো পরীবাগের রাত। 

তারপর আর কি, প্রতিরাতে শুরু হয়ে গেল আমার সেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সার্কাস। কারন দিনে তো ওরা চোখ বুজে ঘুমায়। তখন ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখেছি বাবারে বাবা কী ঘুম কী ঘুম বান্দাদের! তাই রাতে দম নিয়ে বন্ধ দরজার এপাড়ে ইক্টু ইক্টু বুক পুরো খালি করে রেডি হয়ে ওয়ান টু থ্রি বলে সব টুকু নিঃশ্বাস পুঁজি করে টান দিয়ে দরজা খুলি। আর তীব্র মধুর সে সুগন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার নাকে মুখে গায়ে। সুগন্ধের জোয়ারে আমি সুগন্ধী বাংলাদেশ হয়ে যাই। বাপরে বাপ! কি সৌন্দর্য সে ঘরানে! 

মজা হলো এই যে আমার ঘরতো আর গাড়ি না যে চলে যাবে। তাই শুরু করলাম গন্ধ বন্ধ করার ব্যবস্থা। প্যাসেজের দ্বারও দিলাম আঁটকে। তাতে ঘরভরা সুমন্দ্র গন্ধ থাকে শেষরাত পর্যন্ত। এঘরে কোন শোবার উপায় নেই। আর যা ঠান্ডা! তা না হলে আমি মেঝেতেই মটকা মেরে শুয়ে থাকতাম। চিন্তা কি বদ্ধ কাচের দরজার সামনে বিলাতী সাপ বিলাপ করলেও প্রবেশ করতে পারবে না। মা মনসার সুতানলী সাপ লাগবে এবং তার কিন্তু পাসপোর্ট লাগবে!

তাই রাতে কয়েক বার উঠে উঠে শোবার ঘর থেকে ঐ অতিপ্রাকৃত মিষ্টি গন্ধ নিতে যাই। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে বন্ধ দরজার এপার থেকে রেডি হয়ে এক দুই তিন বলে ঝপাৎ করে দরজা খুলে সঙ্গে সঙ্গে পেছন আঁটকে দিই। যাবি কোথায় বান্দা? তোরা আমার ক্যাপটিভ ফ্রেগরেন্স। তারপর অন্ধকারে ঘরে সে কি মজার ঘোর। একদম হুমায়ুন আহ্মদীয় কারবার। এ তো শাওন বা লতার করার কথা এবং স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী এসময় একজন খালাম্মার ও ঘুম ভেঙে উপস্থিত হয়ে আমাকে জেরা করার কথা।

-শামীম এই মাঝরাতে অন্ধকারে দরজায় হাত দিয়া দাঁড়ায়ে আছ ক্যান।

- চুপ করেন!
-ক্যান, ওই ঘরে কে?
- সুগন্ধ!
- কি বলো এসব ? সে কখন আসলো আর আমাদের ড্ররিংরুমে ঘুমাইলো?
- সুস্ খালা! সুগন্ধ মানুষ না।

এরপর তিনি হয়তো জোর করে ঘরে প্রবেশ করে ঘরের কোনার লাল নীল কোমল বাতি ছাড়া আর কিছু দেখবেন না। সুগন্ধের গায়ে কোন আঁচড় পড়বে না। ঘন পর্দা টানা কাচের দেয়ালের বাইরে রাত ও দম বন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। মহিলা বিরক্ত হয়ে চলে যাবেন। ঘরে রইবো শুধু সুগন্ধ আর আমি! আমার আর ফুলের গন্ধে ঘুম আসবে না। আমি একলা জেগে রইবো। 

লেখক: কবি, লেখক ও গল্পকথক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন