দেশের ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি বন্যা চলছে এখন। ৩০টি জেলায় চলমান এ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে দেশের প্রায় ৩৬ শতাংশ এলাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামালপুর। জেলাটির প্রায় ৭৫ শতাংশই এখন পানির নিচে।
উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় উত্তরাঞ্চলে। এতে অন্যান্য জেলার সঙ্গে জামালপুরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে যমুনা অববাহিকা অঞ্চল জামালপুরে এবারের বন্যার অভিজ্ঞতা বেশ ভয়াবহ। সব জায়গায় পানি, রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। পানি এখনো ওঠেনি এমন রাস্তায় কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। খোলা স্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেখা দিয়েছে মানুষ, গবাদিপশুর খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। এর মধ্যে ৫৬ হাজার মানুষকে এক হাজারের বেশি আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে জামালপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বণিক বার্তাকে বলেন, জামালপুর জেলার মানুষ বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করেই জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। কিন্তু চলতি বছরের বন্যা একেবারে ভিন্নমাত্রায় দেখা দেয়ায় মানুষ বেশ বিপাকে পড়েছে। এলাকা থেকে পানি সরছেই না। প্রতিটি ঘরে পানি উঠেছে এবার। রাস্তাঘাটে গতবার যেখানে পানি ওঠেনি চলতি বছরের বন্যায় সেসব জায়গাও তলিয়ে গেছে। ত্রাণের সহায়তা পর্যন্ত দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এ জেলার মানুষকে রক্ষা করতে হলে বাঁধ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ নির্মাণ করলে প্রতি বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাঁধ নির্মাণ এখন জেলার ছয়জন সংসদ সদস্য ও জনগণের প্রাণের দাবি।
কৃষি, খাদ্য, পানিসম্পদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয়কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এরই মধ্যে দেশের ৩০টি জেলায় ৫৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ লাখ ৫৯ হাজার ২৯৫টি বাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার ৮৫৯ জন মানুষ। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ১ হাজার ৯০০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৯ লাখ ২৮ হাজার ৬০টি টিউবওয়েল এবং ১ লাখ ২২৩টি ল্যাট্রিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জামালপুর জেলায় সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে বলে জানান জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নায়েব আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বন্যার পানি নিম্নমুখী হওয়ায় অনেকেই তাদের বসতবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বন্যা মোকাবেলায় জেলায় এ পর্যন্ত ৭৮৪ টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল নগদ ৫ লাখ টাকা, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা এবং গো-খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আমরা শুরু থেকেই কঠোরভাবে মনিটরিং করে আসছি। ত্রাণের সংকট নেই।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জি, আসাম ও ত্রিপুরা এবং চীন ও নেপালের পানি এসে বাংলাদেশে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর এই সময়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেশের গ্রামীণ জনপদের খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা, অবকাঠামো বিশেষ করে রাস্তাঘাট ও আর্থসামাজিক কাঠামোয় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে।
চলমান বন্যার স্থায়িত্ব এরই মধ্যে ৩৫ দিন অতিক্রম করেছে। এবারের বন্যা ১৯৯৮ সালের মতো হলেও বিস্তৃতির দিক থেকে এটি এখনো অতটা বড় রূপ নেয়নি। এখন পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ এলাকা।
স্থায়িত্ব ও ক্ষতির দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হয়েছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৮ সালের বন্যায় দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। অন্যান্য বছরের বড় বন্যাগুলোর মধ্যে ১৯৮৮ সালে ৬৩, ২০০৭ সালে ৫৩, ১৯৮৭ সালে ৪০, ১৯৭৪ সালে প্রায় ৩৭, ২০০৪ সালে ৩৭ দশমিক ২৭, ১৯৫৫ সালে প্রায় ৩৬ এবং ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।
১৯৯৮ সালে বন্যার স্থায়িত্বকাল ছিল ৩৩ দিন। এরপর ২০১৯ সালের বন্যার স্থায়িত্ব ছিল প্রায় তিন সপ্তাহ। এছাড়া চলতি বছরের মতোই বন্যা হয়েছিল ২০০৪ সালে। ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৯৮ ও ১৯৮৮ সালের বন্যা। ওই দুই বছরই ফসল ও অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
চলমান বন্যায় নতুন করে ৮৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতির শিকার হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৯০০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির শিকার হয়েছে। বন্যার ফলে দেশের প্রায় আট লাখের বেশি শিক্ষার্থী এখন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের বাইরে রয়েছে। অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ খাতেও বেশ ক্ষতির শিকার হয়েছে। এরই মধ্যে ৭ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ১৬ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমির ঘাস নষ্ট হয়ে গেছে।
ভূপ্রাকৃতিক কারণেই প্রতি বছর চরে বন্যা দেখা দেয়। এবারো তা-ই হয়েছে। প্রায় এক মাস ধরে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কুড়িগ্রামের প্রায় তিন শতাধিক চরাঞ্চলের চার লাখ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ঘর-বাড়ি ডুবে যাওয়ায় নৌকা, কলাগাছের ভেলা ও ঘরের মাচানে কোনো রকমে দিন পার করছে দুর্গতরা।
জামালপুরের বন্যাদুর্গতরা জানান, বন্যা এত দীর্ঘ হবে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। পানি সামান্য কমার পর আবারো বৃদ্ধি পায়। কাজকর্ম নেই। ঘরে খাবার নেই। বউ, বাচ্চা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি। কোনো ত্রাণ পাইনি। ত্রাণ না পেলে আর বাঁচার উপায় থাকবে না।
এবারের বন্যায় দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বন্যা আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষের জীবিকা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বাজারের ৪৩ শতাংশই অকার্যকর হয়ে গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সুষ্ঠু ও দক্ষতার সঙ্গে সরকারের ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। অনিয়ম রুখতে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ত্রাণসহায়তা দেয়ার মতো সক্ষমতা সরকারের আছে। গতকাল বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে ৮ হাজার ২১০ টন চাল, ২ কোটি ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৭৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, গো-খাদ্য কেনার জন্য ৪৮ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৪৮ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়িতে ফিরেছে। শুধু রান্না করা খাবার তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে ৫ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যত বড় দুর্যোগ আসুক না কেন, দুর্যোগ যত দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, দুর্গত মানুষের পাশে ত্রাণসহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াবে সরকার।