ফিরে এসেছে ডিও-স্লিপ লেনদেন

খাতুনগঞ্জে ফের অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

কভিড-১৯-এর কারণে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ডিও বাণিজ্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। লেনদেনে স্থবিরতায় ডিও-কে কেন্দ্র করে স্লিপ বাণিজ্যও কার্যত বন্ধ ছিল। যার কারণে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতাও ছিল কম। তবে কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে ফের বেড়েছে ডিও এবং স্লিপের লেনদেন, যার প্রভাবে আবারো অস্থিরতা দেখা দিয়েছে ভোজ্যতেল, চিনি অন্যান্য পণ্যের বাজারে।

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত মার্চ। ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ভোগ্যপণ্যের বাজার খোলা ছিল সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে কড়াকড়ির কারণে সময় খাতুনগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ট্রেডিং ব্যবসাও কমে যায়। ফলে আমদানিকারক ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নিত্য ভোগ্যপণ্য অর্থাৎ ভোজ্যতেল, চিনি, গম মসলা পণ্য সংগ্রহ করতেন সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মধ্যস্বত্বভোগী ভ্রাম্যমাণ ডিও স্লিপ ব্যবসায়ী না থাকায় পণ্যের বাজারে যখন-তখন উত্থান-পতন ছিল না। সাধারণ ছুটি রোজার ঈদের আগে ভোগ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও পরবর্তী সময়ে দাম স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সর্বশেষ কোরবানির ঈদের আগে দেশের বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। তবে সম্প্রতি স্লিপ বাণিজ্য শুরু হওয়ায় ফের উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে ভোজ্যতেলের দাম। চিনির বাজারও গত দুই সপ্তাহে উল্লেখ করার মতো বেড়েছে। ভোজ্যতেল-চিনি ছাড়া ডিও কেন্দ্রিক অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামেও চাঙ্গা ভাব দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ না বাড়লেও দেশের বাজারে হঠাৎ করেই দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন পাইকারি ব্যবসায়ীরাও।

খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৫ মার্চের পর ব্যাংক লেনদেনের সময়সীমা কমে যাওয়া, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে পাইকারি বাজারে নগদ অর্থের সংকট, নগদ সুদের কারবার (টু-টু) বন্ধ থাকা এবং ব্রোকারদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় ডিও ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে আসে, যার ফল পেতে থাকে ভোক্তারাও। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের নজরদারি কমে গেলে দীর্ঘদিন বন্ধের পর ফের আগ্রাসী হয়ে উঠেছে ডিও ব্যবসায় জড়িত ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের তত্পরতার কারণে পর্যাপ্ত মজুদ সত্ত্বেও পণ্যের দাম বাড়ছে।

খাতুনগঞ্জে দুই সপ্তাহ আগেও প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম অয়েল বিক্রি হয়েছিল হাজার ৩৫০ টাকায়। বর্তমানে নিত্যপণ্যটির দাম বেড়ে হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে সরাসরি বিক্রি ফিউচার মার্কেটে বুকিং দর বেড়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে প্রায় প্রতিদিনই পণ্যটির দাম বাড়িয়ে চলেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাড়ছে চিনির দামও। দুই সপ্তাহ আগে প্রতি মণ চিনির দাম ছিল হাজার ৯৬০ টাকা, যা বর্তমানে হাজার ১০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ভোজ্যতেলের দাম বিশ্ববাজারে কিছুটা বাড়লেও দেশের বাজারে চিনির মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী আবদুর রব বণিক বার্তাকে বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে খাতুনগঞ্জে স্লিপ লেনদেন বন্ধ ছিল। সম্প্রতি স্লিপ ক্রয়ের হিড়িক শুরু হওয়ায় পণ্যের বাজারকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণের পুরনো চিত্র আবার ফিরে এসেছে খাতুনগঞ্জে। এর প্রভাবে অস্থির হতে শুরু করেছে বাজার।

খাতুনগঞ্জে ডিও স্লিপ বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ কয়েকটি স্পট হচ্ছে বাদশা মার্কেট, নবী মার্কেট, সোনামিয়া মার্কেট, ব্যাংক এশিয়া মার্কেট, জাফর মার্কেট, ইলিয়াস মার্কেট, চৌধুরী মার্কেটসহ বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের অফিসসংলগ্ন মার্কেটগুলো। এসব মার্কেটে প্রতিদিন কয়েক হাজার ভ্রাম্যমাণ ব্রোকার ডিও এবং স্লিপ কেনা-বেচার জন্য ভিড় করেন।

খাতুনগঞ্জে ডিওর বিপরীতে স্লিপ বাণিজ্য অনেকটা কাগুজে শেয়ার বিক্রির মতো। প্রক্রিয়ায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাজারে ডিও ছেড়ে অর্থ তুলে নেয়। ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ব্রোকাররা ওই ডিও হাতবদল করে লাভ করেন। একটি ডিও ক্রয় করতে অনেক টাকা লাগলেও শতকরা বা ১০ শতাংশ টাকা দিয়েই ওই ডিওর বিপরীতে স্লিপ ক্রয় করে ব্রোকাররা। স্লিপে বেঁধে দেয়া সময়ে পণ্যটির দাম আগে থেকে নির্ধারণ করে দেয়া দামের কম থাকলে লোকসান আর বেশি থাকলে লাভবান হয় ব্রোকার। সুবিধার কারণে একজন ব্রোকার ২০ হাজার টাকায় চাইলে ভোজ্যতেলের ১০টি স্লিপ সংগ্রহ করতে পারেন।

খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, খাতুনগঞ্জের ডিও বাণিজ্যের সেকেন্ড পার্টি হচ্ছে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান। ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিকারকদের কাছ থেকে ডিও কিনে ব্রোকারদের কাছে বিক্রি করে দেন। পাশাপাশি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো ডিওর বিপরীতে স্বল্পমূল্যে স্লিপ ছেড়ে বাজারে পণ্যটির দাম ওঠানামায় সহায়তা করেন। ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা ডিওগুলোর বিপরীতে মিল থেকে পণ্য উত্তোলন করার আগেই ডিও একাধিক হাত ঘুরে পণ্যের দামের উত্থান-পতন ঘটে। ব্রোকাররা এসব ডিও বা স্লিপ ক্রয়-বিক্রয় করেই মুনাফা করেন কিংবা অনেক সময় লোকসানে পড়েন। বর্তমানে ব্রোকারদের উপস্থিতি ৯০ শতাংশ কমে যাওয়ায় বাজারে ডিওর চাহিদা কম। ডিও কম থাকায় স্লিপ বাণিজ্যও শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে পাইকারি বাজারে থাকা অধিকাংশ ডিওর পণ্যমূল্য কার্যত স্থির রয়েছে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ট্রেডিং বাণিজ্য কিছুটা কমে যায়। তবে সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের বাজারেও ট্রেডিং শুরু হয়েছে। ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে ডিও স্লিপ কেনাবেচা করলে বাজার স্বাভাবিক আচরণ করে।একতরফা পণ্য বিক্রির পরিবর্তে চাহিদা জোগানের ওপর নির্ভর করে দামের ওঠানামা করে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি কমে যাওয়ার ঘটনাও স্বীকার করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন