নতুন বিশ্বের খোঁজে

সরকারগুলোর কি আরো অর্থ ব্যয় করা উচিত?

রঘুরাম রাজন

পরিবার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ের সহায়তার লক্ষ্যে মহামারী ত্রাণ তহবিল বাবদ উন্নত অর্থনীতিগুলো এরই মধ্যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের জুনের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে নগদ অর্থ ঋণ মিলিয়ে ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস জিডিপির প্রায় শতাংশ (রিপাবলিকানস) থেকে ১৫ শতাংশ (ডেমোক্র্যাটস) পর্যন্ত নতুন ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করছে। তাই চলমান মহামারীটি যতদিন আমাদের তাড়া করবে ততদিন পর্যন্ত সরকারের আরো বেশি অর্থ খরচ ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে।

এদিকে অর্থনীতিবিদরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে বর্তমানের কম সুদহারের অর্থ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সার্বভৌম ঋণের অবস্থা এখন সন্তোষজনক। তারা ঠিক বলেছেন, কথার মানে দাঁড়ায় যে নমিনাল জিডিপি প্রবৃদ্ধি যুক্তিসংগত পর্যায়ে ফিরে এসেছে, সুদহার কম রয়েছে এবং ভবিষ্যৎ সরকারগুলো তাদের ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়েছে। এমনকি প্রথম দুটি অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলেও তৃতীয়টি আমাদের বর্তমান ব্যয়ের গুণমান নির্ধারণের জন্য দায়িত্বশীল আচরণের কথা বলে।

স্বাভাবিক সময়ে দায়িত্বশীল সরকারগুলো ব্যবসায়িক চক্রের সময়কালের মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের লক্ষ্য রাখে। মন্দার সময়ে তারা যে ঋণ করে, তা পুনরায় পরিশোধ করে এবং প্রথম পর্যায়ের সুবিধাভোগীরা দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে তা পরিশোধ করে। তবে বর্তমান সংকটকালীন পরিস্থিতিতে শিগগিরই পুঞ্জীভূত ঋণ পরিশোধের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এমনকি ধনীদের ওপর উচ্চতর শুল্ক আরোপ নীতি তীব্র বাধার মুখে পড়বে এবং প্রবৃদ্ধি দমন কঠোরতাবিষয়ক যুক্তির সঙ্গে মিলিত হবেজমাকৃত ঋণের একটি বড় অংশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে।

অতীতে ধরনের ঋণ পরিশোধের বিষয়টি সহজ ছিল। কেননা শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা প্রতিটি প্রজন্মকে আগের তুলনায় আরো বেশি ধনী করেছে, আয়ের তুলনায় ঋণ সংকুচিত হয়েছে। এমনকি বর্তমানে সমাজে বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি, নিম্ন সরকারি বিনিয়োগ এবং ঈষৎ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সবকিছুই আমাদের তুলনায় আমাদের সন্তানরা যাতে অধিক ধনী হতে না পারে, তার বিরুদ্ধে কাজ করে। যাই হোক, এরই মধ্যে আমরা কিন্তু তাদের দিকে দুটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিআমরা যখন তহবিলসংক্রান্ত অধিকার খুইয়ে বসব তখন আমাদের দেখাশোনা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা, যদিও  জলবায়ুসংক্রান্ত লড়াইয়ে আমরা তেমন কিছুই করিনি। আরো খারাপ বিষয় হচ্ছে, তাদের স্বাস্থ্য শিক্ষায় বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের পরবর্তী বেশির ভাগ প্রজন্মকে উৎপাদনশীল জীবনযাপনের জন্য অপ্রস্তুত করে তুলছি।

পরবর্তী প্রজন্মের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষমতা হ্রাস করার পাশাপাশি আমরা তাদের ওপর যে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি, তা ভবিষ্যতে তাদের আয়ের পরিমাণকেও সংকুচিত করবে। তাই আমরা যদি এখনই সামগ্রিকভাবে আমাদের ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাকে নিঃশেষিত করে ফেলি তাহলে গত ১২ বছরে আমরা যে দুটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদিওয়ান্স ইন সেঞ্চুরিনামের একই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, তবে তখন তারা আর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করতে সক্ষম হবে না। আজ যারা জীবিত, তাদের ক্ষেত্রে আন্তঃসামাজিক ন্যাযতার মতোই আন্তঃপ্রজন্মগত ন্যায্যতার বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত।

ব্যবহারিক ভাষায় এর মানে দাঁড়ায়, সবাই সুবিধাপ্রাপ্ত হবে বা সুস্থ হয়ে যাবে, কারণ মহামারীর জন্য তারা কেউ দায়ী নয়এমন ধারণাটি তাত্ক্ষণিকভাবে বাতিল হয়ে যায়। যদিও অনেক দেশে বীমা করা না থাকলেও বন্যা বা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। দেশটির অন্য অংশের অধিবাসীরা দুর্যোগাক্রান্ত না হলেও স্বেচ্ছায় (উচ্চতর কর) প্রদান করে থাকে, কারণ তারা জানে যে আগামীতে তাদের জন্যও একইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হবে। তবে মহামারীর মতো বড় ধরনের অভিঘাতের ক্ষেত্রে ধরনের হিসাব আর কাজ করে না। বোঝাটা অনিবার্যভাবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর পড়ে যায়, যারা পরিষ্কারভাবেই মহামারী কিংবা তার প্রতিক্রিয়ার কোনো দায় বহন করে না।

অতত্রব, আমাদের অবশ্যই অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। মহামারী এবং এর ফলাফল যেহেতু স্থায়ী, আমাদের অবশ্যই কোম্পানিগুলোকে নয়, বরং কর্মীদের রক্ষা করতে হবে। সামগ্রিক কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধার শুরু না হওয়া পর্যন্ত কাজ হারানো প্রতিটি কর্মীকে অবশ্যই অবশ্যই একটি শোভন স্তরে সরকারি সহায়তা দেয়া উচিত। ধনী সমাজের পক্ষ থেকে সামাজিক সুরক্ষা জাল সরবরাহ করা এবং মহামারী চলাকালীন শ্রমিক তাদের পরিবারগুলোকে টিকিয়ে রাখা কিংবা তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা সবার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

আর এটি করতে কর্তৃপক্ষকে তাদের সমর্থিত সংস্থাগুলোর প্রতি অনেকটা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে হবে এবং বাজারগুলোকে তার বেশির ভাগ কাজই করতে দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সমৃদ্ধ এলাকাগুলোয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক কার্যক্রম সবসময়ই চালু বন্ধ হতে থাকে। মালিক বা উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যর্থ হওয়াটা যন্ত্রণাদায়ক হলেও অর্থনীতিতে এর স্থায়ী ক্ষতি খুব কমই হয়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হওয়ার পর যদি হঠাৎ করে ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পায় তাহলে পুরনো ফুলের দোকানগুলোর পাশেই নতুন কোনো পুষ্প বিক্রেতা তার একটি দোকান দিয়ে বসতে পারেন। কাজেই পুরনো ফুল বিক্রেতার দোকান ভাড়া, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা এবং তার কর্মীদের বেতন প্রদানের মাধ্যমে তার ব্যবসা ধরে রাখতে সাহায্য করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী হবে না। একইভাবে এয়ারলাইনস কিংবা হোটেল চেইনের মতো ব্যাধিগ্রস্ত বৃহৎ ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কর্মচারীদের ধরে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুদান কিংবা ঋণ ভর্তুকি দেয়া উচিত নয়। কেননা এসব ব্যবসা যতক্ষণ ভর্তুকি পাবে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই তারা তাদের অতিরিক্ত কর্মীদের চাকরিতে রাখবে।

অনির্দিষ্টকালের জন্য যখন কর্মীদের কাজগুলোই হারিয়ে গেছে, তখন তাদের ধরে রাখতে কোম্পানিগুলোকে অর্থ প্রদানের চেয়ে বেকার ভাতা দেয়ার মাধ্যমে চাকরি হারানো কর্মীদের সহায়তা করা সরকারের জন্য অনেক বেশি ব্যয়সাশ্রয়ী। টিকে থাকার জন্য বড় বড় সংস্থার যদি অর্থের প্রয়োজন হয়, তবে তারা বাজার থেকে ধার নিতে পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এটিকে উৎসাহিত করে। আর তারা যদি এতটাই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে নতুন করে তাদের আর কেউই ঋণ দিতে আগ্রহী নয়, তখন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার মাধ্যমে ঋণ পুনর্গঠন করে নতুন করে তারা আবার শুরু করতে পারেন।

তবে কিছু পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়া বাজারশক্তিকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হতে পারে। আর্থিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়গুলোর ক্ষেত্রে যেখানে তাদের ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো পুনর্সূচনা ওই ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জীবনধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে আর্থিক সামাজিক উভয় ধরনের সমর্থন প্রদান জরুরি। একইভাবে বাজারগুলো বৃহৎ কোম্পানির সঙ্গে যুক্তিসংগত আচরণ করলেও সক্ষম মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলোর জন্য তহবিলের সংস্থান করাটা কঠিন হতে পারে। আর্থিকভাবে সক্ষম একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে ১০০ কর্মী কাজ করেন, এটি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এর কারণ হচ্ছে বছরের বেশির ভাগ সময়ই এর কোনো আয় হয়নি। এতে প্রতিষ্ঠানটির দক্ষ কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়বেন, ধার পরিশোধ করতে যন্ত্রপাতিগুলো বিক্রি হয়ে যাবে এবং কোম্পানিটির নিয়ম রুটিন চিরতরে হারিয়ে যাবে। এমনকি ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রস্থান যদি বড় একটি অর্থনৈতিক ক্ষতও তৈরি করে, নতুন কোনো কোম্পানি এসে খুব সহজে সে শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না।

তবুও সরকারি সহায়তা বিনা মূল্যে মধ্যাহ্নের আহার বিতরণের মতো হওয়া উচিত নয়। যখনই সম্ভব সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে সরকারের সমর্থন গ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে বোঝা চাপানোর আগে বন্ডহোল্ডার কিংবা স্টকহোল্ডারদের বিদ্যমান মূলধন লোকসানের একটি ন্যায্য অংশ বহন করবে।

পরিশেষে, নতুন প্রজন্মের কাঁধে আমরা যে ঋণের বোঝা ছেড়ে যাচ্ছি, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে যখনই সম্ভব হবে তখনই তরুণদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি বিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে খুলে দেয়ার জন্য আমাদের অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং যাদের দূরশিক্ষণের (ডিসট্যান্স লার্নিং) বিকল্প নেই, ওইসব শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি ব্যয়ের আজ বড় প্রয়োজন। কিন্তু কারণে নয় যে সার্বভৌম ঋণের বাজারগুলো এখনো চূড়ান্তভাবে উচ্চহারে ঋণ গ্রহণ ব্যয়ের মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছেনি। মুহূর্তে আমাদের সন্তানদের দিব্যিআমাদের বাতাসে ঢিল ছোড়া একদমই উচিত হবে না।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

রঘুরাম রাজন: ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর শিকাগো ইউনিভার্সিটির বুথ স্কুল অব বিজনেসের ফিন্যান্সের অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন