টেকসই উন্নয়ন

ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য ও প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

রবার্ট ওয়াটসন

গত মে মাসে বঙ্গোপসাগরে উদ্ভূত ঘূর্ণিঝড় আম্পান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সংলগ্ন উপকূলে আঘাত হানে। এটি ছিল চলতি বছরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নামকরণকৃত ঘূর্ণিঝড়। উপকূলীয় প্লাবনভূমিতে জীবনধারণকারী মানুষ এবং সংবেদনশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল প্রাণী, উদ্ভিদসহ বিপন্ন প্রজাতিগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছিল এটি। তবে প্রকৃতি নিজে থেকেই উল্লিখিত অঞ্চলের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যাশার চেয়ে এবার বাংলাদেশে অন্তত তুলনামূলক কম হয়েছে।

মানুষের তৈরি ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী দেয়ালের চেয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্যারাবন সুন্দরবন অধিকতর ভালো সুরক্ষা দিয়েছে। যখন আম্পানের ১৬ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস প্রকৃতিদত্ত এই চার হাজার বর্গমাইল আয়তনের জাতীয় উদ্যানটিতে আছড়ে পড়েছিল, তখন তার বিরুদ্ধে প্যারাবনটি প্রাণপণে লড়েছে; ঠিক যেমনটি অন্য দুটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আইলা সিডরের সময়ও করেছিল।

এদিকে বিশ্বের অন্য প্রান্তে ম্যানহাটনের নিম্নাংশে দীর্ঘদিন ধরে ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিঃশেষিত হয়ে এসেছে। জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষার ব্যাপারটি উপেক্ষা করে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা কয়েকশ একর এলাকাজুড়ে মাটি ভরাট করে এমনকি দ্বীপটিকে নিউইয়র্ক হার্বারের সঙ্গে সম্প্রসারিত করেছে। ফলে ২০১১ ২০১২ সালে যথাক্রমে যখন হারিকেন আইরিন সুপারস্টর্ম স্যান্ডি উল্লিখিত শহরে আঘাত হেনেছিল, তখন শহরটির আর্থিক জেলাসহ নিম্ন প্রান্তের ম্যানহাটন ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছিল।

নগর পরিকল্পনাবিদরা তখন থেকেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়গুলোর পরবর্তী তরঙ্গ কীভাবে প্রতিরোধ বা মোকাবেলা করা যায়, সেটি নিয়ে মার্কিন সরকারের সঙ্গে কাজ করে আসছে। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উচ্চ নির্মাণ ব্যয় (নিউইয়র্ক হার্বারজুড়ে একটি রিট্র্যাক্টেবল ওয়াল নির্মাণে অন্তত ৬২ বিলিয়ন ডলার লাগবে) যেকোনো পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা থেকে বিরত রেখেছে।

কভিড-১৯ সংকট-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আমরা যেমনটা দেখছি যে অবশিষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদগুলো সুরক্ষায় অবশ্যই আমাদের সর্বোচ্চ প্রাধিকার দিতে হবে। যদি তা না করি, তাহলে বাতাস নির্মল রাখা, পানি বিশুদ্ধ রাখা এবং প্রচুর খাদ্য সরবাহ জোগান দেয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ, প্রাণী অনুজীবগুলোর হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রুখতে পারব না আমরা। একই কথা সত্য প্যারাবন প্রবাল প্রাচীরগুলোর ক্ষেত্রেও। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আজকাল ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হচ্ছে। এসব প্যারাবান প্রবাল প্রাচীর ঘূর্ণিঝড় ঠেকাতে প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ হিসেবে কাজ করে। কাজেই সেগুলো কেন সুরক্ষা করা প্রয়োজন, তা উল্লেখ করার আবশ্যকতা আর খুব একটা নেই।

বিশ্ব ক্রমে বনশূন্য হয়ে পড়ছে; যেহেতু আমরা ভবন নির্মাণ করে চলেছি, শহরগুলো সম্প্রসারণ করছি, শস্যের জন্য বনগুলো উজাড় করছি, সড়ক নির্মাণে জলাভূমিগুলো শুকিয়ে ফেলছি এবং বাঁধ দিয়ে উপত্যকাগুলো প্লাবিত করছি। এই প্রাতিবেশিক ক্ষতির অর্থনৈতিক ব্যয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিসাবের বাইরে থেকে যায়। তবে প্রকৃতি যে পণ্য সেবা উৎপাদন করে, তার মূল্য ধরলে এটি সাংঘাতিক ব্যয়বহুল। সার্বিক প্রাতিবেশিক বিপর্যয়ের কারণে এক মিলিয়ন প্রজাতি এখন বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

সৌভাগ্যক্রমে, এসব ক্ষতির কিছু কমাতে এবং আমাদের বেড়ে চলা সংরক্ষণ সংকটের সমাধানে তুলনামূলকভাবে সহজ একটি উদ্যোগ জারি রয়েছে।থার্টি বাই থার্টি নেত্বত্বে ২০৩০ সাল নাগাদ কার্যকর স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আলোচ্য উদ্যোগ আমাদের ধরিত্রীর ৩০ শতাংশ ভূমি সাগর সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন বায়োডাইভার্সিটির সদস্যভুক্ত ২০-এর অধিক রাষ্ট্র এরই মধ্যে এই বৈশ্বিক টার্গেট সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্বজুড়ে ১০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী অর্থনীতিবিদের লিখিত একটি নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধরিত্রীর বিদ্যমান সুরক্ষিত এলাকা ৩০ শতাংশ সম্প্রসারণ করা গেলে গড়ে বার্ষিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদনে ২৫০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে। কোন এলাকাগুলো অধিক সুরক্ষিত আর কোনগুলো নয়, তার ওপর নির্ভর করে ব্যয় সুফলের পরিমাণ ভিন্নতর হওয়ায় আলোচ্য প্রতিবেদন প্রাক্কলন করে যে এটি ৬৪-৪৫৪ বিলিয়ন ডলার মাত্রার মধ্যে থাকবে। অধিকন্তু, গবেষণায় দেখা গেছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা জোগানো সুরক্ষিত এলাকা প্রকৃতিভিত্তিক কর্মকাণ্ডগুলো রয়েছে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে। ফলে কৃষিতে শতাংশ মত্স্য খাতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির তুলনায় উল্লিখিত খাতগুলোয় আনুমানিক বার্ষিক - শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

থার্টি বাই থার্টি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো বিপুল বনাঞ্চল প্যারাবনের অধিকারী দেশগুলো ইকোসিস্টেম সার্ভিসে প্রতি বছর গড়ে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৭০-৫৩৪ বিলিয়ন ডলার) সমপরিমাণ ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারবে। এই ক্ষতি হয় প্রধানত বন্যা, মাটিক্ষয়, জলোচ্ছ্বাস মজুদকৃত কার্বন নিঃসরণ থেকে; যখন প্রাকৃতিক সবুজায়ন-বনায়ন ধ্বংস হয়। বহু বছর ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও একটি বড় উপকূলীয় এলাকাকে সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সুন্দরবন অনন্যসাধারণ মূল্যবান সেবা দিয়ে এসেছে।

বিপরীতক্রমে, ব্রাজিল অংশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল আমাজনে পরিবেশগত বিপর্যয় বড় সুদূরপ্রসারী ক্ষতিসাধন করেছে। এমনকি আমেরিকাস অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোতে বিদ্যমান নিরাপদ খাবার পানির সংকট প্রত্যক্ষভাবে আমাজনের গাছপালা উজাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত।

কভিড-১৯ লকডাউনের পরে সরকারগুলো যেহেতু অর্থনীতি পুনরায় কীভাবে চালু করা যায় তাতে নিবিষ্ট, সেহেতু তাদের অবশ্যই বৃহত্তর সংরক্ষণ প্রাকৃতিক সম্পদের পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনটি সার্বিক পরিকল্পনায় সংস্থান করতে হবে। নাম পাওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ই একটি রিমাইন্ডার হিসেবে কাজ করে যে আমাদের সামনে আসলে বিপদ অপেক্ষা করছে, আমরা যদি কিছুই না করি।এভাব-নরমাল ২০২০ আটলান্টিক হারিকেন সিজনেরএকটি সাম্প্রতিক পূর্বাভাস মাথায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের এরই মধ্যে নিজে থেকে প্রস্তুত থাকা উচিত হবে।

ভারত বাংলাদেশ ভাগ্যবান যে তাদের একটি সুন্দরবন রয়েছে। তবে যে দেশে যতটুকু প্রাকৃতিক এলাকা রয়েছে, তা সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধার করা প্রতিটি দেশেরই দরকার। সব দেশেরই থার্টি বাই থার্টি টার্গেট গ্রহণই কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং নিজ নিজ দেশের প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলোয় অধিক বিনিয়োগ কীভাবে করা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করা উচিত। এমনটি করার মাধ্যমে এখন সরকারগুলো নিশ্চিত করতে পারে যে প্রকৃতিভিত্তিক খাতগুলো ইকোসিস্টেম সেবা বাকি অর্থনীতির সমান তালে ঘুরে দাঁড়াবে। আরেকটি ঝড় আঘাত হানার আগেই এসব কাজ শুরু করার চেয়ে অধিক ভালো সময় আর নেই।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

রবার্ট ওয়াটসন: দি ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্লাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসের (আইপিবিইএস) প্রধান

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন